সুপ্রিম কোর্ট থেকে বঙ্গভবন-গণভবন কত দূর: আপিল বিভাগ

সরকার আড়াই বছরেও অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ সংক্রান্ত বিধিমালার গেজেট প্রকাশ না করায় উষ্মা প্রকাশ করেছে সর্বোচ্চ আদালত।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 May 2017, 05:01 AM
Updated : 8 May 2017, 12:55 PM

প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা সোমবার প্রশ্ন রেখেছেন, সুপ্রিম কোর্ট থেকে একটি ফাইল বঙ্গভবন ও গণভবনে যেতে কতদিন সময় লাগে।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এর আগে গত ৪ এপ্রিল গেজেট প্রকাশের জন‌্য সরকারকে ৮ মে পর্যন্ত সময় দিয়ে বলেছিল, ওই সময়ের পর আদালত সরকারের আর কোনো ‘অজুহাত’ শুনবে না।

কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সোমবার আপিল বিভাগের কাছে আরও দুই সপ্তাহ সময়ের আবেদন করেন।

এ বিষয়ে শুনানির পর প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ সরকারকে আরও এক সপ্তাহ সময় দেয়।

সকালে আদালত বসার পর অ্যাটর্নি জেনারেল একটি ফাইল উপস্থাপন করলে প্রধান বিচারপতি বলেন, “এটা কি সময়ের আবেদন? আমরা তো ভেবেছি গেজেট।”

বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহাব মিয়া এ সময় বলেন,“অবকাশের আগে আপনাকে লম্বা সময় দেওয়া হয়েছিল। তখন আপনি আমাদের কী বলেছিলেন? আবারও সময় চেয়ে আবেদন দাখিল করলেন।”

এরপর তিনি অ্যাটর্নি জেনারেলকে প্রশ্ন করেন-“বলেন তো, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শহর কোনটা? নিউ ইয়র্ক না টোকিও?”

অ্যাটর্নি জেনারেল জবাবে বলেন, তার মনে হয় টোকিও।

এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন,“কেউ কেউ বলে নিউ ইয়র্ক। আপনি কি জানেন, টোকিও বা নিউ ইয়র্ক শহরের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে যেতে কত ঘণ্টা সময় লাগে?

অ্যাটর্নি জেনারেল চুপ করে থাকলে প্রধান বিচারপতি বলেন, “আমার তো মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শহর ঢাকা।”

তিনি আবার জানতে চান- “সুপ্রিম কোর্ট থেকে বঙ্গভবন আর গণভবনের দূরত্ব কত?”

এবারও নিশ্চুপ থাকেন মাহবুবে আলম।

প্রধান বিচারপতি বলেন, “আমার মনে হয় লক্ষ মাইলেরও বেশি, কারণ একটি ফাইল সুপ্রিম কোর্ট থেকে বঙ্গভবন আর গণভবনে যেতে আড়াই বছরের বেশি সময় লাগে। মনে হয়, আড়াই বছরেও যেহেতু এই দূরত্ব পাড়ি দেওয়া সম্ভব হয়নি, আড়াই হাজার বছরেও তা সম্ভব হবে না।”

সময় বাড়ানোর আদেশ দেওয়ার আগে প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেন, “এর আগেও আপনি সময় চেয়েছিলেন, আমরা মঞ্জুর করেছি। আপনার কাছে এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ যা, দুই বছরও একই। সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এটা আমরা করব।”

পরে অ্যাটর্নি জেনারেল তার কার্যালয়ে এক  ব্রিফিংয়ে বলেন, “নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরি সংক্রান্ত বিধিমালার বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত কি আসে, বিষয়টি উল্লেখ করে আমি আবার সময় প্রর্থনা করেছিলাম। আদালত এক সপ্তাহের সময় দিয়েছেন।”

ঘটনাক্রম

মাসদার হোসেন মামলার চূড়ান্ত শুনানি করে ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করতে ঐতিহাসিক এক রায় দেয়।

ওই রায়ে আপিল বিভাগ বিসিএস (বিচার) ক্যাডারকে সংবিধান পরিপন্থি ও বাতিল ঘোষণা করে। একইসঙ্গে জুডিশিয়াল সার্ভিসকে স্বতন্ত্র সার্ভিস ঘোষণা করা হয়। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করার জন্য সরকারকে ১২ দফা নির্দেশনা দেয় সর্বোচ্চ আদালত।

মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। আপিল বিভাগের নির্দেশনার পর গত বছরের ৭ মে আইন মন্ত্রণালয় নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালার একটি খসড়া প্রস্তুত করে সুপ্রিম কোর্টে পাঠায়।

সরকারের খসড়াটি ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার অনুরূপ হওয়ায় তা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থি বলে গত ২৮ আগাস্ট শুনানিতে জানায় আপিল বিভাগ।

এরপর ওই খসড়া সংশোধন করে সুপ্রিম কোর্ট আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেইসঙ্গে তা চূড়ান্ত করে প্রতিবেদন আকারে আদালতে উপস্থাপন করতে বলা হয় আইন মন্ত্রণালয়কে।

এরপর দফায় দফায় সময় দেওয়া হলেও সরকার মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে ওই বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ না করায় গত ৮ ডিসেম্বর দুই সচিবকে তলব করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

দুই সচিবের হাজিরার আগে ১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে একটি নোটিসে বলা হয়, নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ সংক্রান্ত বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে রাষ্ট্রপতি ‘সিদ্ধান্ত’ দিয়েছেন।

আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হক পরদিন আদালতের তলবে হাজির হলে প্রধান বিচারপতি বলেন, বিধিমালা নিয়ে “রাষ্ট্রপতিকে ভুল বোঝানো হয়েছে।”

সেদিন শুনানি করে গেজেট প্রকাশের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দেয় আপিল বিভাগ। এরপর আরও আট দফায় প্রায় পাঁচ মাস সময় পেল সরকার।