পুলিশের কাছে ‘আরও কিছু আলামত’

জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ‘আরও কিছু আলামত’ পাওয়ার কথা জানিয়ে ঢাকার পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার সম্ভাবনার পাশাপাশি আরও কয়েকটি দিক তারা খতিয়ে দেখছেন যা এখনই বলা সম্ভব নয়।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 April 2016, 10:20 AM
Updated : 28 April 2016, 12:21 PM

বুধবার নিজের কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “তারা (নিহতরা) একটি সংগঠন করত। সেখানে কোনো আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত সমস্যা অথবা কোনো সংঘবদ্ধ জঙ্গি গোষ্ঠী ঘটনাটি ঘটিয়েছে কি না- কোনো সম্ভাবনা আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না।

“তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে আছি। দুই-চারদিন গেলেই এই বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারব। কাউকে সন্দেহের বাইরে রাখা হচ্ছে না। সব ডাইমেনশন মাথায় নিয়ে এগোচ্ছে পুলিশ।”

সোমবার বিকালে কলাবাগানের লেকসার্কাসে নিজের বাসায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় ইউএসআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী তনয়কে। সমকামীদের অধিকারের পক্ষের সাময়িকী ‘রূপবান’ সম্পাদনায় যুক্ত ছিলেন জুলহাজ।

তাদের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের ভাষ্যমতে,  যেভাবে দুজনকে আঘাত করা হয়েছে তাতে ‘দক্ষ, প্রশিক্ষিত’ হাতের কাজ মনে হয়েছে।

গত ফেব্রুয়ারিতে লেখক অভিজিৎ রায় থেকে শুরু করে ঢাকায় যে কয়েকজন লেখক, ব্লগার ও প্রকাশককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে তাদের ময়নাতদন্তকারী এই চিকিৎসক বলছেন, ওই সব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জুলহাজ-তনয় খুনের মিল রয়েছে।

হত্যাকাণ্ডের পর পাঁচ থেকে সাতজনকে ‘আল্লাহু আকবার’ বলতে বলতে গুলি ছুড়ে পালিয়ে যেতে দেখার কথা জানিয়েছেন একজন প্রত্যক্ষদর্শী।

তারপরেও এ ঘটনায় আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি সন্দেহে রাখার কারণ ব্যাখ্যায় ডিএমপি কমিশনার বলেন, “তদন্তের স্বার্থে আরও কিছু কথা আপনাদের বলতে পারছি না। আমরা আরও কিছু আলামত পেয়েছি। একজন হত্যাকারী এমন ঘটনা ঘটাতে পারে যাতে তার দায় এড়িয়ে ইঙ্গিত অন্যদিকে যায়, সেটিও তো হতে পারে।”

পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকার পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া।

আছাদুজ্জামান বলেন, “তদন্তকারী অফিসার হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে এর যৌক্তিকতা ও সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা। একজন খুন করে অন্যকে ফাঁসানোর জন্য অন্য ধরনের ডাইমেনশন দেবার একটি অপচেষ্টাও হতে পারে। বাট বিষয়টা হলো তদন্তের বিষয়, বাস্তবতার বিষয়, যুক্তির বিষয়। প্রত্যেকটির তদন্ত হচ্ছে। হত্যার আসল উদ্দেশ্য কী ছিল, কারা জড়িত ছিল তা খুঁজে বের করব।”

সেদিনের ঘটনার বিবরণে তিনি বলেন, সোমবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে এক লোক কুরিয়ার সার্ভিসের একটা আইডি কার্ডসহ দুটি পার্সেল নিয়ে কলাবাগানের ওই বাড়িতে যায়।

“সে গিয়ে রিসিপশনে বলেছে যে, জুলহাজ মান্নানের সঙ্গে কথা হয়েছে। এরপর জুলহাজ নিচে নেমে এসেছে। ওই লোককে নিয়ে ওনার বাসায় গেছে। তখন মেইন গেইটের কলাপসিবল গেইট দিয়ে চারজন হঠাৎ ঢুকে পড়ে। তিনজন দারোয়ান তাদের বাধা দিলে দুইজনকে কুপিয়ে আহত করা হয় এবং গেইটের পাশে একটি রুমে তালাবদ্ধ করে রাখে।

“তিনজন সন্ত্রাসীর কাঁধে ব্যাগ ছিল, নীল গেঞ্জি পরা ছিল। কোনো কিছু বোঝার আগে দোতলায় উঠে যায়। ঘড়ি ধরে মাত্র পাঁচ মিনিট তারা সেখানে ছিল। জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু তনয়কে নির্মমভাবে কুপিয়ে আহত করে। একই পথ ধরে চলে যায়। ডলফিন গলি থেকে ঘটনাস্থল প্রায় ৩০০ গজের মতো। সেখান দিয়ে তারা চলে যায়।”

ঘটনার খবর পেয়ে সাত মিনিটের মধ্যে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায় জানিয়ে পুলিশ কমিশনার বলেন, “সেখানে একজন এসআই ও এএসআই মমতাজ তাদের প্রতিরোধ করে। তখন মমতাজকে সন্ত্রাসীরা চাপাতি দিয়ে কোপায়।

“সন্ত্রাসীরা চলে গেলেও পুলিশ তাদের একটি ব্যাগ রেখে দিতে সক্ষম হয়েছে। সেখানে একটি পিস্তল, একটি মোবাইল, কিছু আরবি লেখা কাগজপত্র পাওয়া গেছে। যে পথ দিয়ে গিয়েছে সেখানের কিছু ফুটেজও পাওয়া যায়, সেটি পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে।”

ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও খুনিদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে না পারাকে পুলিশের ব্যর্থতা বলতে নারাজ ডিএমপি কমিশনার।

এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, “পুলিশ গুলি চালালেও তাদের গায়ে লাগেনি। কারণ ওই সময় আসরের নামাজ শেষে রাস্তায় মুসল্লিরা বেরিয়ে যায়। তখন সন্ত্রাসীরা জনগণের ভিড়ে হারিয়ে যায়। এটি ব্যর্থতা বলব না, দুঃখজনক বলব।”

পুলিশ সদস্যরা যখন ‘এক খুনিকে জাপটে’ ধরল তখন মানুষ সহযোগিতা করলে তাদের ধরা যেত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এই ঘটনাকে সরকার ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে নিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এদের শনাক্ত করতে চৌকস কর্মকর্তারা কাজ করছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ করছে।

“অতীতে ঘটনাগুলো যেভাবে ‘ডিটেকশন’ করেছি। এটিও করব। এতে আতঙ্কগ্রস্ত হবার কিছু নেই।”

ডিএমপি কমিশনার বলেন, “দেশের এক ধরনের বিপথগামী লোক দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি করতে, অশান্তি তৈরি করতে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড করে দেশে নৈরাজ্য তৈরি করতে একটা অপপ্রয়াস কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে করছে। সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে আমাদের কলাকৌশল আছে। নব্বই ভাগ ক্ষেত্রে সফলতা রয়েছে।

“বর্তমানে যা ঘটছে এটিও উদঘাটন হবে। অপরাধীদের শনাক্ত করে ধরে আইনের আওতায় আনতে পারব। সেজন্য কিছুটা সময় দিতে হবে।”

জঙ্গিবাদ দমনে সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, “দেশবাসীকে অনুরোধ করব জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসতে হবে। জঙ্গিরা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে সাময়িকভাবে বাসা ভাড়া নিচ্ছে। বাসা ভাড়া নেবার সময় তথ্য থাকলে তারা অপরাধ করতে পারবে না। যদি করে তাদের উদঘাটন করা যাবে।”

‘আনসার আল ইসলাম’-এর এই হত্যার দায় স্বীকার নিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে দায় স্বীকার করা হয়। এর যৌক্তিকতা এবং বাস্তবতা কতটুকু আছে, তা ভেবে দেখা দরকার। এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”