হয়তো একদিন তোমার বিলাপ হ'য়ে উঠবে এক অনবদ্য বীণার সুর!
Published : 12 Feb 2025, 12:26 AM
------------------
নরকের মৌমাছি
-----------------
নরকের প্রহরগুলো দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর। তারার আলোতে এখানে একটি গাছের পাতাকেও নড়তে দেখা যায় না, ফলে এমন বোধ জাগা স্বাভাবিক যে ওগুলো ইস্পাতের তৈরি।
এখানকার সাপগুলোও ভোগে বিষণ্ণতা রোগে, ঘুমের মধ্যেও ওরা কোনো স্বপ্ন দেখে না। কিন্তু এবারকার গ্রীষ্মে বিস্ময়করভাবে স্বপ্নের মতো কিছু মৌমাছি নরকে ঢুকে পড়েছে।
মৌমাছিগুলো নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দেয় আর উড়তে থাকে সূর্যমুখী ফুলের ওপর। এদের সব কিছুই রহস্যে ঢাকা, তাই এরা নরকের বাসিন্দাদেরকে পৌঁছে দেয় ঈশ্বরের কাছে।
------------------
মৃত্যু ও ছায়া
------------------
শুক্রমন্দিরের ছাদে আততায়ীরা ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। পৌরাণিক পাথর ও ঝরা পাতার ওপর দিয়ে আমরা ছুটছি এবং বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছি পৃথিবীর বেহালাগুলোর আর্তনাদে মন দেওয়ার।
নিচে আরব সাগরের জলের ওপর নক্ষত্রমালা ও খেজুরগাছের প্রতিবিম্বগুলো অনবরত নড়ছে, অথচ আমরা শুধুই অন্ধকারে পালিয়ে বেড়াচ্ছি আর রাত্রির নীলিমার দিকে তাকিয়ে থেকে অপেক্ষা করছি মৃত্যুর।
------------------
মহানিশা
------------------
ঘুমন্ত মরুভূমিতে নিরন্তর নড়ছে দীর্ঘ শেষরাত্রির অনন্ত বৃক্ষসারির অগণিত পাতার দূরাগত ছায়া। তুমি বের হ'য়ে এসেছ প্রৌঢ়া মাতার ঘর থেকে এবং নিঃশব্দে অতিক্রান্ত হয়েছে কয়েক যুগ।
একটি প্রতিবন্ধী শিশু তুমি, তোমার আত্মা হামাগুড়ি দিচ্ছে ছায়ালোকের অনন্ত সাগরের কালো জলে। কোনো শব্দ তোমাকে বিভ্রান্ত করবে না, কেননা মৃত রাত্রে কোনো পাখির চিৎকার শুনতে পাবার সম্ভাবনা নেই। শুধু প্রবাহিত হবে হাওয়ার দীর্ঘশ্বাস এবং নক্ষত্রের আবছা আলোতে বিমুগ্ধ বৃক্ষেরা একে একে ঢ'লে পড়বে ঘুমে।
------------------
ইমহোটেপ ও তাঁর আবিষ্কার
------------------
কাচের জানালার ওইপাশে সাহারা মরুভূমিতে সিংহের দীর্ঘ ছায়া পড়েছে, মাংশাসী গুবড়ে পোকার দল মুহূর্তের মধ্যে তাকে কংকালে পরিণত করলো। ইমহোটেপ বুঝতে পারলেন আমাদের ক্ষণকালের জীবনে নক্ষত্রেরা অক্ষয়, কিন্ত ছায়ারাজি কিংবা শিল্প নশ্বর, তুচ্ছ। তিনি খাতা নিয়ে বসলেন এবং আবিষ্কার করলেন সেই পদ্ধতির যার মাধ্যমে ছায়ারা প্রকৃতির চেয়েও বড়ো হ'য়ে ওঠে এবং জীবনকে পরিণত করে খাদ্যে।
আমি যেখানে লুকিয়ে থাকি আমার সে-চিলেকোঠায় রোজ সন্ধ্যায় বিকীর্ণ হয় ধুতুরার শুভ্রতা, স্নায়ুতন্ত্রের অন্ধকার থেকে উঠে এসে এক নিগূঢ় বাণী ধ্বনিত হয় সেখানে : লাশবাহী খাটিয়াকে মরা রজনীগন্ধার পাপড়িতে ঢেকে দাও, দেখবে স্মৃতিভারাতুর সৌরভের সাথে উত্থান ঘটবে অন্য এক সূর্যের।
------------------
পাশুটে চোখ
------------------
ওই ডাইনি বিড়াল পাশুটে চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, ও আমাকে ব্যঙ্গ করে! ওই ধূসর বিড়াল হয়তো শয়তানের ছদ্ম রূপ, যে ইভকে প্রলোভিত করেছিলো। হয়তো আদিপতনের জন্যে ওই দায়ী!
নিজেকে আমি পরামর্শ দিই: হত্যা করো ওকে! মহান কবি শার্ল বোদলেয়ার যেমন তাঁর কবিতা এবং নন্দনতত্ত্বে স্যাডিজমকে বেছে নিয়েছিলেন, তুমি তেমনি স্যাডিজমকে বেছে নিয়েছ জীবন যাপনের ক্ষেত্রে! আর একজন স্যাডিস্টের আত্মতৃপ্তির জন্যে প্রয়োজন অন্তহীন দুঃখ।
তাই তোমার শিকারের সাথে তুমি একাত্ম হও, ভাগীদার হও তার দুর্ভাগ্যের। হয়তো একদিন তোমার বিলাপ হ'য়ে উঠবে এক অনবদ্য বীণার সুর!
------------------
স্বগতোক্তি
------------------
প্রতিটি নৌকা মৃত্যুউপত্যকার দিকে ভেসে চ'লে যাক, প্রতিটি ফুল সঞ্জীবিত হোক, দিগন্তের দরোজা খুলে অপার্থিব আলো পৃথিবীর এই গহীন বিবরে প্রবেশ করুক, কিন্তু তোমাকে অবশ্যই নির্বাসন মেনে নিতে হবে।
মৃত বালকদেরকে যেরকমভাবে সজোরে ধাক্কা দিয়ে নরকের আগুনে ছুড়ে ফেলা দেওয়া হয় ঠিক সেরকমভাবেই (অথবা কোনো ইঁদুড়কে বলিকাষ্ঠে চেপে ধরার মতো) অন্ধকারে ডুবে যাওয়া তুষার-শুভ্র ধ্রুপদী কারাগারে আত্মার প্রলাপগুলোকে তুমি শৃঙ্খলিত করবে এবং নিজেকে তুমি জীবন্ত কবর দেবে।
অবিরাম শূন্যে নৃত্য করবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না নাক দিয়ে রক্ত উঠে আসে। তুমি শুধু সেদিকেই দৌড়বে যেদিকে তোমার জন্যে কবর খোড়া রয়েছে।
নিজেরই আত্মা ব্যতীত অন্য কোনো স্থান তোমার গন্তব্য নয়, যেনো তুমি সেইসব আতঙ্কিত বানরদের একজন, দরোজার পর দরোজা খুলে যারা বাইরে বেরুতে চায়, কিন্তু বৃত্তাকার কবরের বিভ্রমের মধ্যে অনন্তকাল ধ'রে একই পথে ঘুরে চলে।
অদূরে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে বিস্মরণীর ঘুমন্ত নৌকা আর তার কংকালসার মাঝি কারন। অবারিত কালো জলরাশি পাড়ি দিয়ে তুমি ঢুকে পড়বে রক্তরঞ্জিত কাফনে আচ্ছাদিত কুটিল নরকে।
------------------
বিকৃত চিৎকার
------------------
উন্মাদাশ্রম থেকে ফিরে এসে বৃদ্ধা মাতাকে হত্যা করেছি। ঠাণ্ডা শয্যায় শায়িত অবস্থায় জাহান্নামের গহ্বরে তিনি তলিয়ে গেলেন। ইস্পাতের ঠাণ্ডা হাতিয়ার দ্বারা তার কপালে এবং গণ্ডদেশে আঘাত করার পর বিস্রস্ত আত্মার গভীরে অস্ফুট শব্দ উচ্চারিত হয়েছিলো এবং এক পেয়ালা রক্ত গড়িয়ে পড়েছিলো শুভ্র চাদরে। আমার শিশু ভগ্নী সূর্যাস্তের সমান রক্তিম খেলাটি দেখে হেসে উঠলো আর আমি তার পেট ফেড়ে অন্ত্রতন্ত্র বের ক'রে আনলাম।
বৃক্ষের শাখা-প্রশাখায় সন্ধ্যার শুভ্র ফুল প্রস্ফুটিত হচ্ছে। রাত্রির সাগর চতুর্দিকে বইয়ে দিচ্ছে উন্মত্ত হাওয়া। সম্ভবত অনন্তকাল ধ'রে দুইটি মৃতদেহের পাণ্ডুর অস্থি ও শিরাতে আমি ঘুরপাক খাবো। আমার কদাকার বানরের মতো দেহ এবং ক্ষীণ আর্তনাদ যেনো পঞ্চভূতে বিলীন হয়!
দুঃস্বপ্নে আমি ভ্রমণ করেছি আদিম আকাশে। দেখতে পেয়েছি স্ফটিক এবং জ্যোতি, লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র বা মোম আপনাপন কক্ষপথে সানন্দে ঘূর্ণায়মান ছিলো, শুধুমাত্র আমার মৃতদেহ নীরব শূন্যে নির্যাতিত হয়েছে। আমার আত্মা স্পিনোজার বৃদ্ধ ঈশ্বরের অনন্ত নাস্তির কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, কিন্তু আমি বিচ্যুত হয়েছি।
কান্নার মতো সুর আমার কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে প্রবাহিত হচ্ছে। দুঃখ এবং পাপের দুর্বহ বোঝা থেকে মুক্তি পেতে নিজের গলায় আমি ছুরি চালাবো, কিন্তু তার আগে হৃদয়ে স্মৃতিবিনাশী ধুতুরা ফুটে উঠুক।
******
বিকৃত জীবনের উন্মত্ত বীণার ঝংকার
এবং প্রাচীনতম স্বচ্ছ হ্রদের অন্ধকার,
আমার আত্মার হাওয়াতে ঝরাও সিক্ত পাতা।
গতকাল আমার স্নায়ুর হ্রদে ফুটলে যে-ফুল
বা ডুবলে যে-তুমি, স্তনহীন নিগ্রো পুতুল,
পেষো আমাকে, ঘোরাও তোমাদের দীপ্র জাঁতা।
------------------
ওবেলিস্ক
------------------
মৃত্যুলীন স্ফিংক্সের পাশে শ্রমিকেরা গ'ড়ে তুলেছিলো ওবেলিস্কটি। সম্ভবত সে ছিলো দণ্ডায়মান প্রহেলিকা, মরুভূমির ধাঁধা এবং অসীম ও ঈশ্বরের প্রতি আগ্রাসী এক কালো প্রজাপতি।
সব বস্তুই নশ্বর, কিন্তু স্থানীয়রা বিশ্বাস করতো এই ওবেলিস্কটি চিরকালই দাঁড়িয়ে থাকবে মরুভূমির নিষ্ঠুরতা ও রহস্যের কেন্দ্রে, সহস্র ফারাওয়ের স্মৃতিচিহ্ন দেহে ধ'রে এবং অনন্তকাল এর রহস্যময় হায়ারোগ্লিফিক বর্ণমালা সাম্রাজ্যের সূর্যের বন্দনা ক'রে যাবে।
নিশ্চয়ই বিশ্বাসগুলো হাস্যকর, কিন্তু ওবেলিস্কটির ধ্বংসটা ছিলো সত্যিই অলৌকিক এবং মর্মান্তিক। এক অন্ধ কিন্নর মরুভূমিতে আসলেন এবং স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে বীণা বাজাতেই গুড়ো হ'য়ে গেলো ওই প্রহেলিকা। এর দাসেরা ভেবেছিলো ব্রহ্মাণ্ড ধ্বংস হ'য়ে যাবে, কিন্তু ওরা জানতো না যে সঙ্গীতের আগমনের সাথেই এক নতুন মৃত্যুর সূচনা ঘ'টে গেছে, তাই অন্য কোনো মৃত্যুর প্রতিমার প্রয়োজন নেই।
অবশেষে সহস্র বছর পরে এক বিকারগস্ত কবি মায়াবী আফ্রিকার রঙ্গালয়ে ঢুকলেন এবং এক পঙ্গু নৃত্যশিল্পীর দেহে আবিষ্কার করলেন ওবেলিস্কের ধ্বংসাবশেষ। তাছাড়া, অনেকেই বলে, ইসাডোরা ডানকানের চোখের মণিতে দেখা যেতো ওই ওবেলিস্কের ছায়া।