বিপরীত মেরুর দুটি জগত, চির বৈরী মতবাদের দুটি পরিচয় নিয়ে সদা মৃত্যু ঝুঁকিতে জীবন কেটেছে মর্টেন স্টোর্মের। পৃথিবীতে এমন দৃষ্টান্ত সম্ভবত বিরল।
Published : 16 Sep 2014, 09:25 PM
ডেনমার্কে কৈশরে ইসলাম গ্রহণ করে এক সময় হয়ে উঠেছিলেন আল কায়েদার বিশ্বস্ত যোদ্ধা। আবার আল-কায়েদার হয়ে যুদ্ধ করা অবস্থাতেই মত পাল্টিয়ে যোগ দেন পশ্চিমের সন্ত্রাস বিরোধী লড়াইয়ে।
তবে সম্প্রতি স্টোর্ম ঝুঁকিপূর্ণ দুটি পথই ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান। জীবন যাপন করতে চান সমাজের অন্য ১০ জনের মতো।
সম্প্রতি গোয়েন্দা জীবনের ইতিবৃত্ত নিয়ে বই লিখেছেন স্টোর্ম। ‘এজেন্ট স্টোর্ম: মাই লাইফ ইনসাইড আল কায়েদা অ্যান্ড সিআইএ’ শিরোনামের বইটি প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন সিএনএন এর সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক বিশ্লেষক পল ক্রইকসাঙ্ক ও টিম লিসার।
স্টোর্মের সঙ্গ আলাপের পর সম্প্রতি তার গোয়েন্দা জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে খবর প্রকাশ করে সিএনএন।
“একাধিক নাম ও পরস্পর বিরোধী একাধিক জীবনাচরণ ছিল আমার। একেক সময় একেক রকম ব্যক্তিত্ব ছিল। এক সময়ের মর্টেন স্টোর্ম পরে মুরাদ স্টোর্ম, আবু ওসামা আবার কখনো আবু মুজাহিদ নামে জীবন যাপন করেছি”।
ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুরাদ স্টোর্ম নাম নিয়ে ইয়েমেনে যাওয়ার পর আল কায়েদার শীর্ষ নেতাদের কাছে বেশ বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
জঙ্গি সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ নেতা আনওয়ার আল আওলাকির জন্য ইউরোপ থেকে একজন ‘স্ত্রী’ও সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন তিনি। ওই সময়েও তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র চর।
ইংরেজি ও আরবি ভাষায় লেখা আরেকটি বই ‘ট্রাভেলিং বিটুইন এথিজম অ্যান্ড হার্ডলাইন ইসলাম’।
“অর্ধযুগ ধরে আমি দুই জগৎ ও দুটি ভিন্ন পরিচয়ের মধ্যে চষে বেড়িয়েছি। ওই সময় একটি ভুল শব্দচয়ন, অসংলগ্ন বাক্য মুখ থেকে খসলেই তা আমার মৃত্যুর কারণ হতে পারত,” বইতে লিখেন স্টোর্ম।
তার মতে, সেটি ছিল এক ধরনের ভগ্নমনস্কতা বা স্কিজোফ্রেনিক জীবনধারণ ।
ডেনমার্কের করসর শহরে স্টোর্মের জন্ম। সেখানেই বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। বাবাকে হারিয়েছিলেন শিশুকালেই।
ছোট বেলাতেই বিপত্তির মুখোমুখি হতে শুরু করেন তিনি। ১৫ কি ১৬ বছর বয়সে অস্ত্রধারী ডাকাত দলের হয়ে ছিনতাই শুরু করেন। ১৮ বছর বয়সে পেয়েছিলেন জেলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা। জেল থেকে বেরিয়েই যোগ দেন একটি বাইকার দলে (মোটরসাইকেল রেসিং)।
‘সত্যের’ সন্ধান
নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনী বিষয়ক বই স্টোর্মের জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। করসর শহরের প্রধান লাইব্রেরি থেকে তিনি বইটি সংগ্রহ করে পড়েছিলেন।
“সেটা (জীবনীগ্রন্থ)আমার জীবনকে বদলে দেয়। বইটি পড়ে অনেক কিছু জানতে পারি। এটাই সত্য, আমি সত্যের সন্ধান পাই”, বলেন স্টোর্ম।
আর এভাবেই স্টোর্ম ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে নাম পরিবর্তন করে নাম রাখেন মুরাদ স্টোর্ম। ডেনমার্ক ছেড়ে তিনি চলে যান ইয়েমেন। সেখানে আরবি শেখেন, ইসলামের জটিল বিষয়গুলো সম্পর্কেও পড়াশোনা করেন। আল কায়েদা গুরু ওসামা বিন লাদের নামেই রাখেন ছেলের নাম।
মধ্যপ্রাচ্যের জিহাদিদের সঙ্গে স্টোর্মের পরিচয় হয় তার সংবাদিক বন্ধু নাগিব খাজার হাত ধরে। জিহাদিদের জীবন নিয়ে একটি সিনেমা তৈরি করতে তিনি স্টোর্মকে নিয়ে প্রথম ইয়েমেন যান।
সেখানে গিয়ে পরিচয় আল-কায়েদা নেতা আনোয়ার আল-আওলাকির সঙ্গে। ধীরে ধীরে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এভাবে ধীরে ধীরে আল কায়েদার আরব অঞ্চলের একজন সক্রিয় যোদ্ধা হয়ে ওঠেন তিনি।
জিহাদে অংশ নিতে একবার সোমালিয়ায় পাড়ি দেয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন স্টোর্ম। পরে অবশ্য শীর্ষ ব্যক্তিদের অনুমতি না মেলায় সেখানে যাওয়া হয়নি তার।
পক্ষ বদল, সিআইএ চর
জঙ্গিদের সঙ্গে সখ্য চলাকালেই নানা কারণে ইসলাম ধর্মের প্রতি অনীহা জন্মে যায় স্টোর্মের মনে। এর মধ্যে একটি ছিল কোরআনের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য।
বিভিন্ন ওয়েবসাইটে কোরআনের পরস্পর বিরোধী বক্তব্য নিয়ে বিভিন্ন লেখা পড়ার পর নিজের মধ্যে নতুন পরিবর্তন আসতে শুরু করে বলে জানান স্টোর্ম।
তিনি বলেন, “বেশ কিছুদিন গবেষণা করার পর আমি বুঝতে পারি, আসলেই সেখানে কিছু মতোবিরোধ (কন্ট্রাডিকশন) রয়েছে। আর এভাবেই আমার বিশ্বাস পুরোপুরি মুছে যেতে থাকে। বিশ্বাসে, চেতানায় ইসলামি ভাবধারা ত্যাগ করি আমি।”
স্টোর্ম তখন ডেনিস গোয়েন্দা সংস্থা পিইটি’র সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। সন্ত্রাসের (ইসলামি চরমপন্থা) বিরুদ্ধে বিশ্ব নেতাদের যুদ্ধে তথ্য দিয়ে সহায়তা করার প্রস্তাব দেন তিনি।
ডেনমার্কের গোয়েন্দারাও তার ওই প্রস্তাব লুফে নিতে দেরি করেনি। এমন কী যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’ও স্টোর্মের দিকে নজর দেয়।
হানস জর্জেন বনিচেসেন নামে পিইটি’র সাবেক প্রধান তার সংগঠনের সঙ্গে স্টোর্মের যোগাযোগের কথা সিএনএন’র কাছে স্বীকার করেছেন।
স্টোর্মের ওই ঘটনা সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি সিআইএ কর্মকর্তারা। একইভাবে পিইটি ঘটনাটি স্বীকার করেনি কিংবা নাকচও করেনি।
উভয় পক্ষেই পরীক্ষিত স্টোর্ম
পরীক্ষায় উত্ত্বীর্ণ হয়েই আল কায়েদা ও সিআইএ’র কাছে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টি করেছেন স্টোর্ম।
কায়েদা নেতা আওলাকির অনুরোধে তার তৃতীয় স্ত্রী হিসাবে ক্রোয়েশিয়ার এক নারীকে এনে দিতে গিয়ে দুই পক্ষের আস্থাভাজন হন তিনি।
ক্রোয়েশীয় নব মুসলিম আমিনাকে আওলাকির তৃতীয় স্ত্রী হতে রাজি করিয়েছিলেন স্টোর্ম। ইসলাম গ্রহণের আগে আমিনা ইরিনা হরেক নামে পরিচিত ছিলেন।
ইরিনাকে আওয়ালাকির বউ করে পাঠানোই ছিল পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ফাঁদ যাতে পা দিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছিল আওলাকিকে।
স্টোর্মের মধ্যস্থতায় আমিনা আর আওলাকির মধ্যে সাংকেতিক ভাষায় ইমেইল আদান-প্রদান হয়। ভিডিও আলাপের মাধ্যমে তারা পরস্পরকে বিয়ে করতে রাজি হন।
আমিনা-আওলাকির বিয়ে আয়োজনে ভূমিকা রাখার জন্য স্টোর্মকে দুই লাখ ৫০ হাজার ডলার দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। ক্রোয়েশিয়া থেকে আমিনাকে ইয়েমেন পৌঁছে দিয়ে তিনি সেই অর্থ পেয়েছেনও।
ইয়েমেনে আমিনাকে বিয়ের পর আওলাকি একটি ইমেইলে স্টোর্মকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আমিনা তার ধারণার চেয়েও অনেক ভাল বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন এতে।
আমিনাকে আওলাকির কাছে পাঠানোর সময় তার স্যুটকেসে গোপনে একটি ডিভাইস জুড়ে দেয়া হয়েছিল পশ্চিমা গোয়েন্দাদের ইচ্ছায়। কিন্তু ওই নারী আওলাকির কাছে পৌঁছার পর তার লোকজনের নির্দেশে ওই স্যুটকেসটি ছুঁড়ে ফেলে দেন তিনি।
পশ্চিমা লোকজন স্যুটকেসে করে কোনো ট্র্যাকিং ডিভাইস দিতে পারে; এমন আশঙ্কা থেকেই সেটি ফেলে দিতে বলেছিলেন আওলাকির লোকজন। অনেকদিন পরে এক ইমেইল বার্তায় আমিনা স্টোর্মকে এমনটিই জানিয়েছিলেন।
স্টোর্ম জানান, ডিভাইসটি লক্ষ্যস্থলে না পৌঁছানোয় সিআইএ কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তার ওপর। এজন্য দুই পক্ষের মধ্যে প্রায় ছয় মাস যোগাযোগ বন্ধ ছিল।
পরে অবশ্য তার তথ্যের ভিত্তিতেই ২০১১ সালে আনোয়ার আল আওলাকিকে ড্রোন হামলা চালিয়ে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র।