বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম পাঠকপ্রিয়; জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমও। কিন্তু নিরপেক্ষ কি? কতোটা নিরপেক্ষভাবে খবর পরিবেশন করতে পারেন আপনারা? – পাঠকের এই প্রশ্নে মোটেও বিচলিত হলেন না ইন্টারনেটভিত্তিক পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী।
Published : 09 Jun 2015, 01:36 PM
তিনি স্পষ্ট করেই বললেন, “না, আমরা মোটেও নিরপেক্ষ নই। আমাদেরও একটি পক্ষ আছে, তা প্রবলভাবেই আছে। আমাদের পক্ষপাত পাঠকের প্রতি। আপনি করপোরেট সংস্কৃতির কথা যদি বলেন- আমাদের পক্ষপাত ভোক্তাদের প্রতি। আরেকটি ঘোষিত পক্ষপাত আমাদের আছে। সেটি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি।”
তিনি বলেন, “আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। আমরা নিরপেক্ষভাবে ‘বস্তুনিষ্ঠ’ খবর পরিবেশন করি।”
রোববার সন্ধ্যায় টরন্টোর ডেনফোর্থে মিজান কমপ্লেক্স অডিটরিয়ামে প্রবাসী সমাজের মুখামুখি হয়েছিলেন ব্যক্তিগত সফরে আসা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী।
‘নতুন দেশ’ এর প্রধান সম্পাদক শওগাত আলী সাগরের সঞ্চালনায় এই অনুষ্ঠানের প্রায় পুরোটা জুড়েই ছিল প্রশ্নোত্তর পর্ব।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ভূমিকা, দেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, সাগর-রুনির খুনীদের চিহ্নিতকরণে গণমাধ্যমের ভূমিকাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অকপটে প্রশ্ন করেন সুধীজন। প্রশ্নের পর প্রশ্নে আয়োজনটি ‘পাঠকের কাঠগড়ায় সম্পাদক’ অনুষ্ঠানে পরিণত হয়।
শুরুতে অতিথিকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য রাখেন স্থানীয় বাংলা টেলিভিশনের কর্ণধার সাজ্জাদ আলী, লেখক আকতার হোসেন, লেখক-গবেষক ইকবাল করীম হাসনু, সাবেক ছাত্রনেতা মাহাবুব আলম, মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া। ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তব্য রাখেন সাবেক ছাত্রনেতা মিনারা বেগম।
“বাংলাদেশে মিডিয়ার স্বাধীনতা আসলে মালিকদের স্বাধীনতা; মালিকদের স্বার্থ, রাজনীতির স্বার্থ- ইত্যাদি অনেক কিছুর সাথে একীভূতভাবে ভাবা হয়। বাংলাদেশের মতো দেশে মিডিয়ার সত্যিকারের স্বাধীনতার রূপ বোঝানোও অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে।”
তিনি বলেন, পেশাদারিত্ব, মালিকদের স্বার্থসংশ্লিষ্টতা ও পাঠকের প্রতি অঙ্গীকারের উপর গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নির্ভর করে।
বিগত সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের উদাহরণ টেনে তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, তখন শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়াসহ রাজনীতিকদের চরিত্র হনন করে বিশেষ সংস্থার তৈরি করা বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রধান শিরোনাম করে দিনের পর দিন প্রকাশ করেছে দেশের প্রধান প্রধান পত্রিকাগুলো।
“বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমই একমাত্র মিডিয়া যারা সেই সংবাদগুলো প্রকাশ করেনি। সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের শাসনামলে ‘বিডিনিউজ’ উর্দিপরা লোকদের কোনো ‘হুকুম’ একবারের জন্যও শোনেনি।”
বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে বেনামি সূত্রের বরাত অসত্য খবর পরিবেশিত হয় বলে মন্তব্য করে এ প্রসঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সংবাদ পরিবেশনের নীতিমালা তুলে ধরেন প্রধান সম্পাদক।
তিনি বলেন, “বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রচলিত এই ধারা থেকে বেরিয়ে এসে ‘ট্রু সোর্স থিওরি’ অনুসরণ শুরু করে। ‘সূত্র জানায়’ বলে বিডিনিউজ কোনো খবর পরিবেশন করে না। প্রতিটি খবরেই সূত্রের উল্লেখ করে দেওয়া হয়।
“কখনো যদি কোনো সূত্রের উল্লেখ না করে সংবাদ পরিবেশন করা হয়- সেক্ষেত্রে খবরের প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি হাতে নিয়েই সেটা করা হয়।”
সাগর-রুনির হত্যাকারীদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারেনি- এমন অভিযোগের জবাবে এই বিষয়ে মিডিয়াকে ঢালাও অভিযুক্ত করার আগে এর কার্যপরিধি ও ক্ষমতা বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী।
তিনি বলেন, “যে কোনো হত্যাকাণ্ডের তদন্ত হচ্ছে ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন। মিডিয়ার সেই দক্ষতা, সক্ষমতা থাকে না। রাষ্ট্রের আইনও সেটি অনুমোদন করে না। এটি পুরোপুরিভাবেই রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর এখতিয়ার।
“তাদের কাজে কোনো গাফিলতি থাকলে মিডিয়া সেটি তুলে ধরতে পারে। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রেও মিডিয়া এই দায়িত্ব পালন করেছে।”
সাংবাদিক সাগর সারোয়ারের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সাগর-রুনি দম্পতির নৃশংস খুনের কূল-কিনারা না হওয়া আমাদের নিজেদের নিরাপত্তা সম্পর্কে শঙ্কিত করে তুলে। বাংলাদেশে কেবল সাগর-রুনিই নয়, আরো অনেক হত্যাকাণ্ডেরই কোনো কূল কিনারা হয়নি। সেগুলো নিয়েও প্রশ্ন তোলা উচিৎ।”
অপরাধ তদন্তের বিষয়ে পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে সহায়তা নেয়, কিন্তু বাংলাদেশে এমনটি দেখা যায় না।
এক পাঠকের এই পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম সম্পাদক বলেন, “উন্নত বিশ্বের মিডিয়া এবং মিডিয়াকর্মীদের যে ধরনের লজিস্টিক সাপোর্ট থাকে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটি অনুপস্থিত।
দেশে অনেকগুলো টেলিভিশন চ্যানেল গণমাধ্যমের প্রসারে কী ভূমিকা রাখছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টিভির লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে অপেশাদার, অযোগ্য লোকদের।
“রাজনীতিকরা মিডিয়াকে দুর্বল দেখতে চায় বলেই অযোগ্যদের হাতে লাইসেন্স দেয়। কিন্তু এতে আখেরে রাজনীতিকদের কোনো লাভ হয় না। খালেদা জিয়ার শাসনামলে রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য লোকদের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এসব মিডিয়া তার রাজনৈতিক উপকারে আসেনি। আওয়ামী লীগের আমলেও একই ঘটনা ঘটেছে।”
ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের কর্তৃত্ব নিয়ে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, প্রেসক্লাবের ঘটনার সঙ্গে গণতন্ত্র থাকা না থাকার কোনো সম্পর্ক নেই।
গত ১০ বছরে প্রেসক্লাবের অনেক নেতাই গণমাধ্যমে কোনো প্রতিবেদন, কোনো উপসম্পাদকীয় এমনকি কোনো মন্তব্যও লিখেননি উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমের মান নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তৌফিক খালিদী বলেন, “বাংলাদেশের মিডিয়ার পরিমণ্ডল বদলে যাচ্ছে। মানুষ হাঁটছে, দৌড়াচ্ছে; দৌড়াতে দৌড়াতে সংবাদ জানার চেষ্টা করছে। ৮০ শতাংশ লোক স্মার্টফোনে খবর দেখে। ফলে সংবাদ পরিবেশনের পদ্ধতিও পাল্টে যাচ্ছে।
“সংবাদকর্মীদের পেশাগত দক্ষতা না বাড়ানো গেলে পরিবর্তনের হাওয়ায় টিকে থাকা যাবে না।”