বান্দা রেলস্টেশন পর্যন্ত গিয়ে আমি ফোন দিলাম সহিদুল হককে। স্টেশনের গেইট পর্যন্ত না যেতেই দেখি সহিদুল সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন।
Published : 07 Sep 2017, 09:56 AM
তিনি তার গাড়ি নিয়ে এসে স্টেশনের সামনে পায়চারী করছিলেন। মি. হকের ছোট গাড়িতে চেপে বসলাম। সামনে পুরো দুইদিন জাপানে ছুটি। আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের কোথাও না কোথাও রাত কাটানোর কথা। আমরা দু’জন এখন ফ্রি। একজন সংসারপ্রেমী, আর একজন সংসার বিরাগী। তারপরেও দু’জনের নেশা- দেশ ঘুরে বেড়ানো। পেশায় আমি লেখক বা সাংবাদিক, আর সহিদুল হক ফটোগ্রাফার।
জাপানের অধিকাংশ এলাকা আমার ঘুরে দেখা হয়েছে আর সহিদের পুরোটা। তারপরও একসঙ্গে নতুন করে ঘুরে বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম দু’জনে। যেখানে আমাদের রাত হবে, সেখানেই কাত হবার পরিকল্পনা। আমি লিখবো আমার চোখে দেখা জাপানের বিভিন্ন এলাকার সৌন্দর্য আর ইতিহাস। সহিদুল তুলবেন তার ছবি।
এসবের সমন্বয়ে পরবর্তীতে বই করার পরিকল্পনা। সেই দেশ ঘুরে দেখার পরিকল্পনা আমাদের এরমধ্যেই যে শুরু করা হয়েছে! আজ কোথায় থাকবো, সেটার সিদ্ধান্ত তখনও নেওয়া হয়নি। যেহেতু বলা হয়েছে, যেখানে রাত হবে গভীর, সেখানেই টানানো হবে তাবু। সেই তাবুতেই হবে রাত যাপন।
জাপানে প্রতি বছর আনুষ্ঠানিকভাবে পরিবারের সবাই কিংবা বন্ধু-বান্ধব মিলে সমুদ্র সৈকতে যাবার জন্য একদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। সেটা হলো ১৭ জুলাই। যেহেতু এবার ১৭ জুলাই রোববার অর্থাৎ সাপ্তাহিক ছুটির দিন, তাই সেই উপলক্ষে রোববার দিনের পরিবর্তে সোমবার দিন ছুটি নির্ধারণ করা হয়েছে।
আতামি পৌঁছার পর সেখানে গিয়ে দেখি ছেলেমেয়ে সবাই সমুদ্রের তীর ঘেঁষে সাঁতার কাটার জন্য ছোট কাপড় পরে পানিতে দৌড়-ঝাঁপ করছে। ইচ্ছে হলো গিয়ে লাফিয়ে ওদের সাথে পানিতে নামি। ওদের দেখে জিহ্বায় পানি না জমে মনে জমে যায়, আনন্দ করার ইচ্ছের রঙিন পানি। ওদের দেখতে দেখতে চলে গেলাম আরও সামনে। সামনে গিয়ে রাস্তার শেষ প্রান্তে গিয়ে দেখি, পাশেই আতামি কোরাকোয়েন হোটেল। বহু বছর আগে এখানে এসে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা আছে।
সেই হোটেলের সামনে ঘণ্টা হিসাবে গাড়ি পার্কিং করার জায়গা খুঁজে গাড়ি রাখলাম। গাড়ি রেখে একটা রিসোর্টের সামনে গিয়ে সোফায় বসলাম। ততক্ষণে ক্ষুধায় শরীর দুর্বল হচ্ছিল। সহিদুল হক আমার জন্য দুপুরের খাবার কিনে আনলেন। সেখানে বসেই দু’জনে খাবার খেলাম। ক্লান্ত শরীর যেন আর চলছিল না। এলাকার আশপাশে সমুদ্র সৈকতের তীর পুরোটা ঘুরে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সেখানে আবার বিশ্রাম নিলাম।
আমার কষ্ট সহিদুল বুঝতে পেরে বললেন, আমরা একদিন ওই দ্বীপে যাবার পরিকল্পনা নিয়েই আসবো। সম্ভব হলে সেখানেই রাত কাটাবো। ওখানে সব সময়ই লোকজনের ভিড় থাকে। বললেন, চলেন আমরা শিমাদা যাই। ওখানে আরও বেশি আনন্দ হয়। রাতেও দেখবেন ছেলেমেয়েরা সৈকতে কতো আনন্দ করছে। ওদের সঙ্গে কথা বলতে পারলেও আনন্দ লাগবে আপনার।
ভ্রমণকারীদের নিয়ে দোতলা এক জাহাজ দ্বীপের দিকে রওনা দিয়েছে। আমি আর সহিদুল সেই জাহাজ ও যাত্রীসহ ছবি তোললাম। ছবি তুলে চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে দেখছিলাম সেই জাহাজটিকে। এরপর রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে বড় হোটেলের সামনে থেকে স্মৃতি রাখার জন্য ছবি তুলে গাড়ি আনতে গেলাম। পাশেই রোফ ওয়ের স্টেশন। চড়বো কি চড়বো না, ভাবতে ভাবতে কাউন্টার পর্যন্ত গিয়ে খবর নিলাম নিচ থেকে উপরে পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত যেতে ভাড়া কতো?
ভাড়া সম্পর্কে ও অন্যান্য তথ্য জানলেও আমাদের বলা হলো আজকে চড়ার সময় শেষ হয়ে গেছে। এখানেও এবার ব্যর্থ মন নিয়ে সেখান থেকে কিছু ব্রুশিউর নিয়ে চলে গেলাম গাড়ির কাছে। আমরা যেখানে গাড়ি পার্কিং করেছি, সেখান থেকে সাগরের গর্জন শোনা যায় স্পষ্ট। বেশ উপভোগ করার মতো ছিল সাগরের সেই গর্জন।
কিছু সময় গাড়িতে বিশ্রাম নিয়ে সহিদুল বললেন, এবার চলেন শিমাদা যাই। শিমাদা এখান থেকে কতদূর রাস্তা জানতে চাইলে, প্রথম ভুল করে মনে হয় বলেছিলেন বিশ-পঁচিশ মিনিট সময় লাগবে। কিন্তু রাস্তায় যখন গাড়ি চলতে শুরু করে, তখন গাড়ি চলতে দেখে বুঝে গেছি, সেখান থেকে শিমাদা এখনও যে অনেক দূরের পথ। কিছু দূর যেতে রাস্তার উপরে নীল রঙের সাইনবোর্ডে লেখা দেখলাম, শিমাদা এখনো ৬৯ কিলোমিটার পথ!
আমাদের ডান দিকে ছিল সবুজে ঘেরা পাহাড়, বামে সাগর। থেকে থেকে ঢেউ এসে কিনারায় আছরে পড়ছিল। উপরে আকাশ। দূরে চোখ ফেললে বোঝার কোনও উপায় নেই সাগর আর আকাশ যে আলাদা। শিমাদা যেতে যেতে পৃথিবী অন্ধকার হতে থাকে। আমরা সেখানে দিনের শেষে রাতের সাগর উপভোগ করতে পারবো মনে করে কিছুটা কষ্ট ভুলে গেলাম। মাত্র বলছিলাম, এই এলাকার মানুষজন ম্যাকডোনাল্ড চিনে না নাকি। ওদের পছন্দের খাবারের তালিকাতে মনে হয় ম্যাগডোনাল্ড নেই। বলে শেষ করতে না করতেই চোখে পড়ল ম্যাগডোনাল্ডের হলুদ রঙের ‘এম’ লেখা বিশাল সাইনবোর্ড।
সহিদুল প্রশ্ন করলেন, ম্যাগডোনাল্ড খাবেন নাকি? আমার যে খেতে ইচ্ছে করছে সেটা আর তাকে মুখ ফুটে বলতে পারছিলাম না। গাড়ি চলছে। এখানে রাস্তার দু’ধারে এত বেশি ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক কানে আসছে যে সমুদ্রের গর্জন পর্যন্ত হার মানছে। পাশে নিচের দিকে তাকালে চোখে পড়ছে ফেলে আসা আতামির সেই জাহাজ, যেটাতে চড়ে আমাদের নিকটেই হাৎস্যুশিমা দ্বীপে যাবার কথা ছিল। জাহাজ আর আমাদের গাড়ি সমানে সমানে চলছে। যেনো প্রতিযোগিতায় মেতেছি আমরা।
গাড়ি চলছে তো চলছেই। আমার শরীর ততক্ষণে আর মহাশয় থাকলো না। মনে হচ্ছে সুগার বাড়ছে। কষ্ট লাগছে ভেতরে ভেতরে। আনন্দ করতে এসে যদি শরীর নিয়ে ভাবতে হয়, তাহলে পুরো আনন্দটাই মাটি হবার সম্ভাবনা। তাই চুপ করে গাড়িতে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ড্রাইভিং সিটের পাশে বসলে আমি না ঘুমিয়ে থাকতে পারি না। এমনকি ড্রাইভিং সিটে বসেও কখনও কখনও ড্রাইভ করা অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ি। আমার স্ত্রী এজন্য আমাকে কখনোই গাড়ি চালাতে দিতে রাজি হয় না। যা-ও চালাতাম, একবার বড় ধরনের সড়ক দুর্ঘটনার পর কোনোভাবে আমাকে আর গাড়ি চালাতে দেয় না। তাই অন্যের পাশে বসেই ঘুরে বেড়াই মাঝে মধ্যে।
আমি দেশে ও জাপানে বহুবার সাগর তীরে গিয়ে বহু সময় কাটিয়েছি। জাপানে তো এমন সময় ছিল যে প্রতি সপ্তাহে একবার হলেও সাগরের কাছে গিয়ে বসে থাকতাম। মন তখন আমার ছিল ভীষণ খারাপ। সেটা জাপানে আসার কয়েক বছর পরের কথা। যতবারই সাগর পাড়ে গিয়েছি, ততবারই সাগরের গর্জন দেখেছি ও শুনেছি। কিন্তু শিমাদার আজকের এই ঢেউয়ের ধরন এবং গর্জন কোনটাই আমার কাছে ভালো লাগেনি।
দূর থেকে ঢেউ উঠে সাপের মতো দ্রুত কাছে এসে আছড়ে পড়ছিল। সে এক অন্য রকম দৃশ্য। আমি আগে কখনও এমনটা দেখিনি। পানি থেকে দূর দিয়ে হাঁটলেও কয়েকবার ঢেউয়ের পানি এসে আমার পা ভিজিয়ে দিয়ে গেলো। কয়েকজন ভারতীয় নাগরিক সেখানে ছেলেমেয়েসহ ঝাড়বাতি জ্বালিয়ে আনন্দ করছিল। পুলিশ এসে ওদের সতর্ক করে দিয়ে গেলো। এভাবে ওদের সতর্ক করার কারণ বুঝলাম না।
আরও সামনে গিয়ে দেখি দু’টি মেয়ে, হাতে বিয়ার। খাচ্ছে আর মজা করছে। সহিদুল ওদের সঙ্গে কথা বলে ক্ষণিকের মধ্যেই জমিয়েছে। আমি পাশে দাঁড়িয়ে সাগরের ঢেউ দেখছিলাম। বালুচরে অনেক সময় হাঁটাহাঁটি করে চলে গেলাম সামনে আরও ভেতরের দিকে পাহাড়ি এলাকায়। সেখানেও সৈকত। অন্ধকারে দূরের কিছু দেখা যাচ্ছিল না। সেই এলাকায় কোন কারণে সম্ভবত অনিরাপদ মনে করায় রাস্তা থেকে সাগর তীরে যাবার সব পথ বন্ধ করে রেখেছে।
সেখানে সাগরের গর্জন ছাড়া অন্য আর কোন কিছুর শব্দ শোনা যাচ্ছিল না। থেকে থেকে সামনে দিয়ে গাড়ি আলো জ্বেলে দ্রুত গতিতে চলে যাবার শব্দতেই আমরা নিজেদের উপস্থিতি টের পাচ্ছিলাম। সহিদুল বললেন, চলেন যাই সামনে ক্লাব আছে। কিছু সময় ক্লাবে ঘুরে আপনাকে হাকনে নিয়ে যাই। হাকনের কথা বলাতে মনে পড়লো, কয়েক বছর আগে আমার জাপানিজ স্ত্রী ইউকিকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম ওখানে।
বড় চমৎকার জায়গা। পুরো পরিবেশই পাহাড়ের উপর তৈরি করা হয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য। হাকনে হচ্ছে জাপানের উল্লেখযোগ্য একটি ন্যাশনাল পার্ক। হাকনে যাবার কথা শুনে বুঝতে পারি, সেখানেই যে আমাদের রাত কাটানো হবে। গেলাম সুসজ্জিত এক ক্লাবের সামনে। বেশ জমজমাট পরিবেশ সেখানে। পাশাপাশি কয়েকটি ক্লাব। বাইরে থেকে দেখেই বুঝতে পারি, ভেতরে লোকভর্তি। লম্বা তিনদিনের ছুটিতে এখানে আজ লোকে লোকারণ্য থাকার কথা। কিন্তু পরিবেশ দেখে তা মোটেও মনে হচ্ছে না।
ক্লাবগুলোতে একবার করে ঢুকে ঘুরে বাইরে আসতেই দেখলাম দলে দলে মেয়েরা হেঁটে যাচ্ছে। গায়ের কাপড় দেখে মনে হলো সাগর থেকে উঠে এসেছে। হয়তো সাগরে শেষ সময়ের সাতারু ছিল ওরা। গায়ের পোশাকের কারণে না চাইলেও চোখ চলে যাচ্ছিলো ওদের দিকে। আমাদের গাড়ি যেখানে থামানো, সেখান থেকে সামান্য দূরে বড় এক সাইনবোর্ডে লেখা আছে ‘এক মিনিট ১০০ ইয়েন’। পুরোটা জাপানিজ ভাষায় লেখা থাকার কারণে সহিদুল বুঝতে না পেরে মনে করেছেন, গাড়ি পার্কিং এক মিনিট ১০০ ইয়েন পরিশোধের কথা লেখা আছে বুঝি!
একটা মেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছিলো। কফি খেতে খেতে আমাদের গাড়ির পাশে পার্কিং করা গাড়ির ছাদ খুলে ভাঁজ করছিলো। ওকে দেখে মনে হলো একজন ছেলের চেয়েও বলবান এবং পাংকু টাইপের মেয়ে। একটু পর আরও একজন মেয়ে এসে সেই গাড়িতে উঠে বসলো। আমাদের সঙ্গে ওরা গাড়িতে বসেই কিছু সময় কথা বললো। এরপর গাড়ি টান দিয়ে শা করে ছুটে চলে গেলো সামনে থেকে। ওদের সামনে আমাদের গাড়ি কম দামি বলে খুব একটা ভাব নিয়ে কথা বলার সাহস হয়নি। সেখানে দাঁড়িয়ে আরও কিছু সময় আমরা আড্ডা দিয়ে গাড়ি নিয়ে ছুটলাম হাকনের পথে।
যে পথে এসেছিলাম, সেই পথেই আবার ছুটে চলা। আসার সময় ছিল বেলা আর এখন সন্ধ্যা। সামনে পিছে ডানে-বামে শুধু অন্ধকার। থেকে থেকে সামনে থেকে আসা গাড়ির হেড লাইট আমাকে উচ্ছ্বল করে তোলে। যেতে যেতে আরও একবার ঘুমিয়ে নেবার ইচ্ছে হলো। অনেক দূরের পথ, তাই মাঝ পথে একবার গাড়ি থামিয়ে ম্যাগডোনাল্ডে ঢুকে হালকা খাবার খেয়ে নিলাম। খেয়ে তো নিলামই, সাথে আবার কিছু নিয়েও নিলাম। গাড়িতে বসে খাবার জন্য কফির কাপ নিলাম দু’জনে। কফিপাগল মানুষ আমি। আজকাল ডাক্তার আমাকে নিষেধ করেছেন কফি আর না খেতে। তার মানে কতোটা নেশায় পেয়ে বসেছে, যার জন্য শারীরিক অসুস্থতাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ডাক্তার নিষেধ করতে পারেন। কফি খেতে যতটুকু সময় লাগলো। এরপর কফি খেয়ে দিলাম আবার ঘুম।
ঘুমের আগে নিশ্চিত হলাম যে আমরা শিমাদা ছেড়ে আতামি এলাকাও ছাড়লাম। যখন হাকনে এলাকায় ঢুকলাম তখন শুধু উপরের দিকে উঠছি। রাতের রাস্তা, তার মধ্যে পুরোটাই পাহাড়ি এলাকা। গাড়ির অবস্থানেই বলে দিচ্ছিল আমরা যে উপরের দিকে উঠছি। প্লেনে চড়লে বায়ুর চাপে যেমন কান ব্যথা হয়, এখানেও যত উপরে উঠছি ততই যেন বাতাসের চাপের কারণে কান ব্যথা করতে শুরু করেছে। আশপাশের শব্দও শোনা যাচ্ছিল না। কান একরকম বন্ধই হয়ে গেলো যেন তখন। কান ধরে বসে আছি।
একসময় তো আর কিছু জানি না। না জানার রাজ্যে ঢুকলাম। যখন ঘুম ভাঙলো তখন সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি পুরোটা পথই যেনো কুয়াশায় ছেয়ে আছে। সত্যি বলছি, আমি হলে সেই রাস্তায় কোনোভাবেই গাড়ি চালাতে পারতাম না। গত কয়েক বছর আগে টোকিওর বাইরে ইবারাকি প্রিফেকচারে রাতের বেলায় গাড়ি চালাতে গিয়ে এমন কুয়াশার মধ্যে বেশ বিপদেই পড়েছিলাম। সেই কথা মনে পড়লো। কুয়াশা ভেঙ্গে আমরা উপড়ে উঠতেই থাকলাম। অবশেষে গিয়ে পৌঁছলাম পাহাড়ের চূড়ায়, যেখানে রয়েছে লেক ও দর্শনার্থীদের জন্য আনন্দ করার জায়গা।
গাড়ি থেকে নেমে চেষ্টা করলাম এলাকা ঘুরে দেখতে। কিন্তু আশপাশের কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। লেকের পাড় ঘেঁষে আমরা দু’জনে বসলাম। কাছে নারী-পুরুষের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছিল। চোখ বড় করে তাকিয়েও সেখানে কোন মানুষের চেহারা দেখা যাচ্ছিল না, এতটাই অন্ধকার। একটু পরে মাথায় হাত দিয়ে দেখি, পুরো মাথা বৃষ্টিতে ভেজার মতো ভিজে গেছে। গলায় ছিল আমার লম্বা গামছা। সেই গামছা দিয়ে মাথা মুছে হেঁটে গেলাম সামনে অন্য ঘাটে।
সেখানে যাবার পর দেখি ভিন্ন চিত্র। সেখানে কোন কুয়াশাই নেই। কুয়াশা না থাকলেও দূরের ঘাটের সব কিছুই অস্পষ্ট। সহিদুলসহ এগিয়ে গিয়ে ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকা এক দোকানে ঢুকে রাতের খাবার কিনে নিলাম। ভাবলাম, পুরো রাতটাকে কাজে লাগানো যায় লেখালেখি করে। আর আমার রাতজাগা মানে একটু পরপর কিছু খাওয়া। তাই নিজের মতো করে বাড়তি কিছু খাবার কিনে নিলাম।
স্থির করেছিলাম যে কোনও একটা বিষয় নিয়ে লিখে শেষ করে তবে ঘুমাবো। চিন্তা অনুযায়ী লিখতে শুরু করলাম। সেই লেখা শেষ হতে হতে সকাল সাড়ে ৬টা বেজে গেলো। ৭টার সময় ঘুমানোর আশায় চোখ বন্ধ করলাম। ঘুম আর হয় না। রাত জেগে যখন গাড়িতে বসে লেখালেখি করছিলাম, তখন যে কি পরিমাণ ভয় পেয়েছি সেটা বলে বোঝানো যাবে না। তবে এটুকু মনে বিশ্বাস ছিল, এখানে কোনো মানুষ কেন, কোনো জন্তু-জানোয়ারও আসবে না আমার উপর হামলা করতে।
এটা হচ্ছে জাপান, বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ দেশ মনে করি। বলাও হয় তাই। জাপান বিশ্বের এক নম্বর নিরাপদ দেশ কি না জানি না, তবে জাপান আসার পর থেকেই এমনটা মনে করে আসছিলাম বলে এই রাতে পাহাড়ি এলাকায় রাত যাপনের কথা স্থির করেছিলাম। তা না হলে চিন্তাই করতাম না। দেশে এটা কখনোই সম্ভব হতো না।
চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাইরে গেলে নিজের হাতই নিজে দেখতে পাই না, এতটাই অন্ধকার। তারপরও সাহস করে মাঝে মধ্যে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটাহাঁটি করে রিলাক্স করেছি। সেখানে আমাদের মতো আরও পাঁচ-ছয়টা গাড়ি পার্কিং করা ছিল। বুঝতে পারলাম, ওসব গাড়িতেও যে লোক ঘুমাচ্ছে!
তবে একটা গাড়িতে দু’জন নারী-পুরুষ ভালোবাসা করছিল, তা স্পষ্ট দেখা না গেলেও বোঝা যাচ্ছিল। সেটা আমাদের গাড়ির পাশের গাড়িতেই। সকাল পর্যন্ত ওরা যেন ছিল ভালোবাসায় বিভোর।
লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি
এই লেখকের আরও লেখা
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |