‘হানামি’ বা ‘ফুল উৎসব’ জাপানিদের অতি প্রাচীন এক জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক উৎসব। জাপানি ভাষায় ‘হানা’ অর্থ ‘ফুল’ আর ‘মি’ অর্থ ‘দেখা’। অর্থাৎ ফুল ফোঁটা দেখার উৎসব বা গাছে ফুল ফোঁটা কেন্দ্রিক উৎসব হল ‘হানামি’।
সেই ঐতিহাসিক হেইয়ান (৭৯৬-১১৮৫ খ্রিস্টাব্দ) শাসনামল থেকে বসন্ত বরণের এই হানামি উৎসব অতি জনপ্রিয়। পরবর্তীতে এই হানামি উৎসব, জাপানিদের কাছে ‘সাকুরা’ নামে সমাদৃত হয়। অনেক সময় পাম জাতীয় এক ধরনের ‘উমে’ গাছ, যা চেরি ফুলের মত একই সময় ফুল দেয়, তার সাথে মিলে ‘উমে’ উৎসব হিসাবেও সাকুরা উদযাপিত হয়।
চেরি ফুল ফোঁটাকে কেন্দ্র করে এই সাকুরা উৎসব শুরু হয় জানুয়ারিতে, জাপানের সর্ব দক্ষিণের ওকিনাওয়া থেকে। আর শেষ হয় মে মাসে, সর্ব উত্তরের হোক্কাইডো’তে। সত্যিই, চেরি ফুল ফোঁটার অপার সৌন্দর্য বিমোহিত করবে যে কোন মানব হৃদয়কে!
চেরির বিমুগ্ধ সৌন্দর্যকে উপভোগ করার জন্য সারা জাপানে সরকারিভাবে সপ্তাহব্যাপী কর্মবিরতি পালিত হয়। তখন মনে হবে, সপ্তাহব্যাপী এই সাকুরা উৎসব যেন কর্মব্যস্ত জাপানিদের অবসর উদযাপন ও বিনোদনের একান্ত উপলক্ষ্য। কর্মব্যস্ত জাপানিদের জীবন যে কত উৎসবমুখর হতে পারে, তা এই সাকুরা উৎসব দেখলে অনুধাবন করা যাবে।
এ সময় জাপানিদের মধ্যকার হাসি-ঠাট্টা, নাচ-গান আর আড্ডাবাজিতে মুখরিত থাকে পুরো চেরি বাগান। খাওয়া-দাওয়া, খোশ-গল্প, ঐতিহ্যগত পোশাক পরিধান আর প্রিয় চেরি ফুলের সাথে ছবি তুলে কেটে যায় তাদের পুরো সপ্তাহ। চেরি ফুলের সাথে বিভিন্ন আঙ্গিকে ছবি তুলে মুহূর্তগুলো ফ্রেমবন্দি করার যে অভিলাষ, সেটা দেখলেই বোঝা যায় ‘চেরি উৎসব’ বা ‘সাকুরা’র প্রতি জাপানিদের আবেগ ও ভালোবাসা। চেরি উৎসব যেন জাপানিদের এক সাংস্কৃতিক মিলনমেলা।
অতি উৎসাহ-উদ্দীপনার মাধ্যমে এই উৎসব পালনের লক্ষ্যে এই সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মবিরতি চলে। সাকুরার জাতীয় গুরুত্ব অনুবাধন করা যায় জাপানি একশ’ টাকার কয়েনে চেরি ফুলের প্রতিচ্ছবি দেখে। তাছাড়া বসন্ত উৎযাপনে জাপানিরা যে প্রথাগত পোশাক ‘কিমোনো’ পরে, সেগুলোতেও চেরি ফুলের অলঙ্করণ লক্ষ্যণীয়।
চেরি ফুল আবার বেশ কয়েক রঙের হয়ে থাকে, তবে গোলাপী চেরি বেশি পরিলক্ষিত হয়। সাদা-লাল বা মিষ্টি রঙের বাহারী চেরির সৌন্দর্যও কম নয়। পুরো গাছ জুড়ে শুধু ফুল আর ফুল, কোথাও কোন পাতার অস্তিত্ব নেই। চেরির এই অপার সৌন্দর্য অবশ্য অল্প কয়েকদিনেই শেষ হয়ে যায়। দমকা হাওয়া ও তার সাথে বৃষ্টির তোপ চেরিকে ঝরিয়ে দেয়। অবশ্য গাছের সবুজ পাতার কুড়িও তখন উঁকি দেয়, সবুজের সমারোহে সাজানোর উন্মাদনা পেয়ে বসে তাকে।
চেরি ফুলের সৌন্দর্যের টানে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ বিদেশি পর্যটক আসেন সূর্যোদয়ের দেশ, চেরির পীঠস্থান এই জাপানে। ক্রমবর্ধমান বিদেশি পর্যটকদের এই সংখ্যা জাপানিদের এই চেরি উৎসবকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়, দিয়েছে এক বৈশ্বিক মাত্রা।
সঠিক ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে সাকুরা উদযাপন ও বিনোদনের জন্য জাপানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দিক-নির্দেশনামূলক সরকারি-বেসরকারি সহযোগী সংস্থা। ফলস্বরূপ এই সাকুরা উৎসব জাপানি পর্যটন শিল্পের উৎকর্ষ সাধনে ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে এক অনন্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। এই ফুল উৎসব জাপানিদের আন্তঃসাংস্কৃতিক মিথষ্ক্রিয়ার পাশাপাশি জাপানি সংস্কৃতি সত্ত্বাকে এক বৈশ্বিক পরিচিত এনে দিয়েছে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট এবং গবেষক, হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়, সাপ্পোরো, জাপান।
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |