স্ত্রী মুক্তি জহির আর দুই সন্তান অগ্নি-জলকে নিয়ে তিনি বর্তমানে বসবাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে। এবারের বইমেলায় এসেছে নতুন সাতটি বই। এর মধ্যে রয়েছে দুই খণ্ডে আট’শ পৃষ্ঠার ভ্রমণসমগ্র এবং দুটি নতুন কবিতার বই। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৪০।
এই ১০ ফেব্রুয়ারি কবি পা রেখেছেন পঞ্চাশ বছরে। তার জীবনের এই সুন্দর সময়কে সামনে রেখে কবির মুখোমুখি হই। সাক্ষাতকারটি বিডিনিউজ টোয়েন্টফোর ডটকমের পাঠকদের জন্য।
কবি কাজী জহিরুল ইসলাম, অসংখ্য ধন্যবাদ সময় দেওয়ার জন্যে। শুরুতে জানতে চাই, কেন আপনি কবি?
আমার মধ্যে একটা সৃজনতাড়না আছে। ছবি আঁকতে ইচ্ছে করে, মুভি বানাতে ইচ্ছে করে, লিখতে ইচ্ছে করে। তো এগুলোর মধ্যে কবিতাই ভাল পারি বোধ হয়, অন্যগুলো আমাকে দিয়ে হয়নি, তাই কবিতা লিখি।
কীভাবে আপনি কবিতার জগতে এলেন? শুরুর সময়টার কথা জানতে চাই।
ছেলেবেলায় আমার গৃহশিক্ষকের নাম ছিল শাহজাহান। তার অনু্প্রেরণায় মূলত কবিতা লিখতে শুরু করা। স্কুলে পড়ার সময় মিল দিয়ে দিয়ে কবিতা লিখতাম। তখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। এক পড়ন্ত বিকেলে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে বসে আছি। আমার মামারা তামাকের চারা লাগাচ্ছেন। টেরছা আলো এসে আমাদের লম্বা লম্বা ছায়া তৈরি করেছে। খানিক দূরে শ্মশানঘাট। বটগাছের তলে বসে কেউ একজন বাঁশি বাজাচ্ছে। বাঁশির করুণ সুর ভেসে আসছে। হঠাৎ দুটি লাইন আমার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো, ‘হাত নেড়ে নেড়ে তামাকের চারা লাগায় ক’জন চাষি/ বটছায়াতলে বসে কে বাজায় অমন মধুর বাঁশি?’
লেখাপড়া ও নিজেকে গড়ে তোলার সময়কার কথা জানতে চাই।
খুব ওপেন প্রশ্ন। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া আমার খুব ভাঙাচোরা। বহু স্কুলে পড়েছি, আবার বহুদিন স্কুলে যাইনি। আবার দেখা গেলো অনেকদিন পর স্কুলে গিয়ে শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে আমি নিজের ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের পড়াচ্ছি। কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্য দিয়ে আমি বেড়ে উঠিনি। জীবনের প্রথম দশ বছর প্রাচুর্য না থাকলেও স্বচ্ছলতা ছিল, এরপর অর্থনৈতিক টানাপোড়নে পড়ে সংসার।
সব সময়ই মনে হতো এই কষ্টটা সাময়িক, খুব ভালো দিন আমার সামনে অপেক্ষা করছে। মনে হতো কেউ একজন আমাকে নিয়ে খেলছেন, আমাকে দিয়ে তিনি বড় কোনো কাজ করাবেন বলে আমাকে তৈরি করছেন। আসলে আমি খুব ছোটবেলায় নবী-রাসূলদের জীবনী পড়ে ফেলেছিলাম। সেই প্রভাব হয়তো আমার মধ্যে কাজ করতো। যাই হোক, শেষমেশ পড়বো না পড়বো না করেও মাস্টার্স করে ফেলেছিলাম।
গড়ে ওঠার এই অভিজ্ঞতায় আমার শৈশব–কৈশোর আমাকে সাহায্য করেছে। আমি সম্ভবত জানতাম আমার গন্তব্য। এই আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমার মায়ের একটি বড় ভূমিকা ছিল। অনেক দৈন্যতার মধ্যেও আম্মা আমার মধ্যে এই বিশ্বাস তৈরি করতে পেরেছিলেন যে, আলোটা তিনি দেখতে পাচ্ছেন। কাজেই আমি আলোর দিকেই হেঁটে গেছি। কিন্তু এখন আমি জানি, আলোর কেন্দ্রে আছে খুব অন্ধকার, অন্ধকারই শেষ গন্তব্য।
আবারো আসি কবিতা প্রসঙ্গে। শব্দ নিয়ে খেলা করতে আপনি ভালোবাসেন। কিন্তু, কেন?
সৃজন তাড়না। একই ধরণের লেখা লিখতে লিখতে পানশে লাগে, তাই নতুন কিছু লিখতে চাই।
“ক্ষেপা জেব্রা কর্পোরেট বারান্দার সুনসান নির্জনতায়/ ব্রিডিং সন্ধ্যায় প্রগাঢ় অন্ধকার অন্বেষণ/ সারি সারি গাধার খোঁয়াড়!/ মার্চের পাগলা হাওয়ায় অস্থির কোয়াগার মায়াবী চোখ/ এ অরণ্যে কোনো স্টালিওন নেই।” এমন অনেক সাবলীল পঙক্তি আপনি তৈরি করেছেন ক্রিয়াপদ বাদ দিয়ে। এমন কবিতা সম্পর্কে একটু ধারণা দেবেন কি?
ত্রিশের কবিরা ক্রিয়াপদকে ছোট করে চলিত রীতির প্রচলন করেছেন। আমি কবিতা থেকে ক্রিয়াপদই তুলে দিয়েছি। এটি একটি নিরীক্ষামূলক কাজ। ক্রিয়াপদ পুরোপুরি তুলে দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে আমি লক্ষ করে দেখেছি ক্রিয়াপদের বাহুল্য কবিতাকে দুর্বল করে ফেলে, নাট-বল্টু খুলে যাওয়া গাড়ির মতো লাগে।
‘ক্রিয়াপদহীন ক্রিয়াকলাপ’ বাংলা ভাষার প্রথম ক্রিয়াপদহীন কবিতার বই। এটি প্রকাশ করে কলকাতার ‘সৃষ্টিসুখ প্রকাশন’। এতে ৩৫টি কবিতা আছে। আমার মূল লক্ষ্য কবিতা থেকে ক্রিয়াপদ কমিয়ে ফেলা। এতে পাঠকের ভাবনার জায়গাটি প্রসারিত হবে। তেমন একটি কবিতা ‘স্পর্শের প্রতীক্ষা’।
আমি বৃষ্টি, তুমি?
খরা, বুকে আজন্ম তৃষ্ণার ক্ষত।
সেই বিকেলের কথা, আজ কত কত বছর!
এখন তুমি টলমলে বর্ষা
আমি খরাক্রান্ত পাহাড়
তোমার স্পর্শ এখনো দূরের ভবিষ্যৎ।
জলোচ্ছ্বাসের কি সুতীব্র প্রতীক্ষা।
দেহকাব্য বলতে কী বোঝাচ্ছেন? একটি দেহকাব্য শোনাবেন?
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ হচ্ছে মানবদেহ। দেহের মধ্যেই সব আছে। পাহাড়, নদী, অগ্নিগিরি, আকাশ, সবকিছু। দেহের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য অনুসন্ধানই দেহকাব্যের মূল ভিত্তি।
মানবাত্মা যে এক সুবৃহৎ পরমাত্মার সঙ্গে সংযুক্ত, আমি তা বিশ্বাস করি। কাজেই সব মানবাত্মাও পরমাত্মার মাধ্যমে একে অন্যের সাথে যুক্ত। আমরা সবাই কানেক্টেড। দেহকাব্যের এটিও একটি লক্ষ্য, মানবাত্মার মধ্য দিয়ে পরমাত্মার অনুসন্ধ্যান। সেই দিক থেকে দেহকাব্যকে সুফি-সাহিত্যও বলা যেতে পারে। এটা দেহকাব্য ১৪-
অন্ধকার হাতড়ে আমি কি খুঁজে পাই আর
বুকের সাথে চেপে ধরি বুক পাঁজরের হাড়
দুইশত ছয় এক থেকে হয় একের মহিমায়
কোন জোনাকী অন্ধকারে আচমকা চমকায়?
হাড়ের খাঁচা মাংস কাঁচা চামড়াতে রূপ জ্বলে
মন মাজারে জ্বলে না সই জ্বলছে দেহতলে
দেহের ভিতর বাত্তি আছে সক্কলে কি দেখে
যে না জানে ফুলগুলো যায় ভুল বেদিতে রেখে
বাহিরে সে মাংস-খাঁচা ভেতরে লাল আলো
দেহের ভেতর দেহ রেখে অন্য আগুন জ্বালো।
আপনি ক’বচন নামে কিছু উপদেশ-কাব্য লিখছেন। ভাষাভঙ্গি দেখে কেউ কেউ আপনাকে ভুল বুঝতে পারেন। যেমন আপনি ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করছেন।
ঊনপঞ্চাশে এসে আমি ক’বচন লিখতে শুরু করেছি। হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। এগুলো উপদেশকাব্য। জীবনের এই পর্যায়ে এসে আমি আবিস্কার করলাম সব সমস্যার সমাধানের জন্য আমাকে কারো কাছে যাওয়ার দরকার নেই। আমার ভেতরেই কেউ একজন আছেন যার কাছে সব সমস্যার সমাধান আছে।
সেই একজন কে, আমি তাকে চিনি না। কিন্তু যখন আমি কোনো একটি পরিস্থিতিতে পড়ি, তখন তিনি বেরিয়ে আসেন এবং আমাকে কিছু উপদেশ দেন। ক’বচন বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে আমার কাছে আসে। এগুলো আমার প্রতি তার উপদেশ। আমি তা লিখে রাখছি এবং সবাইকে জানাচ্ছি। জানাচ্ছি এই ভেবে যে, একই পরিস্থিতিতে অন্যরাও যখন পড়বে তখন এই উপদেশগুলো তাদেরও কাজে লাগতে পারে।
সম্প্রতি আপনার অনুবাদে জালাল উদ্দিন রুমির কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদে কেন আগ্রহী হলেন?
কবিতা এমন এক মৌলিক সাহিত্যকর্ম যা প্রকৃতপক্ষে কবির অবচেতন মনের কাজ, চেতন মনের কোনো নিয়ন্ত্রণ এখানে থাকে না। তাই কেউ চাইলেও কবিতা লিখতে পারে না। আমি অন্যভাবে বলি কবিতা নাজেল হয়। যখন নাজেল হয় না, কবি তখন অস্থির হয়ে পড়েন। ঠিক সেই সময়টাতে অনুবাদ কর্মে আত্মনিয়োগ করে আমি কিছুটা অস্থিরতা কাটাতে পারি।
‘রুমি ডেবুক’ আমার স্ত্রী আমার জন্য কিনে আনেন ইস্তানবুল থেকে। পড়তে পড়তে মনে হল, আমার পাঠ-অভিজ্ঞতা বাংলা ভাষার পাঠকদের জানাই। প্রথমে প্রবন্ধ আকারে লিখতে চেয়েছিলাম। পরে ভাবলাম, না সরাসরি অনুবাদই করি। আগেও আমি কিছু কবিতা অনুবাদ করেছি। রুডিয়ার্ড কিপ্লিং, স্যুলি প্রুধোম ও বিয়র্নস্টিয়ের্ন বিয়র্নসন কবিতা করেছি।
গদ্য সাহিত্যেও আপনার বিচরণ রয়েছে। এ নিয়ে কিছু বলুন।
ন্যাচারালি আমার গদ্যে গতি সঞ্চার হয়। এটা কোনো দক্ষতা নয়, স্বাভাবিকতা। তাই আমার গদ্য পাঠক পছন্দ করে। এটা আমাকে গদ্য লিখতে উৎসাহিত করে। তাছাড়া পত্র-পত্রিকাগুলোর একটা ভূমিকা আছে।
আমার ইচ্ছে আছে বিভিন্ন দেশ ঘোরার অভিজ্ঞতা, নানা বর্ণ ও ধর্মের মানুষের সঙ্গে আন্তক্রিয়া হওয়ার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে উপন্যাস লিখবো। ‘লুতের শহর’ নামে একটি উপন্যাস লিখছি। ইব্রাহিম এবং লুত নবীর সময়কালের পাশাপাশি আজকের পৃথিবীর গল্প। প্যারালাল স্টোরি। কেন্দ্রে থাকবে সমকামিতা। একটি অফট্র্যাকের গল্প। আশা করি এটি একটি ভালো উপন্যাস হবে।
পৃথিবীর কাজের কারণে বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়ানোয় ভ্রমণ সাহিত্যে আপনার অবদান তৈরি হয়েছে। ভ্রমণ লিখতে কেমন লাগে?
ভ্রমণে আমি সৃজনশীলতা যোগ করি। যে কারণে আমার ভ্রমণগুলোকে সৃজনশীল ভ্রমণগল্পও বলা যেতে পারে। আর যেটা চেষ্টা করি তা হলো, ভূখণ্ডটি সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা দিতে। এর নৃতত্ত্ব থেকে শুরু করে অর্থনীতি পর্যন্ত। যাতে পাঠক মোটামুটি সেই দেশের মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা নিয়ে অন্যের সঙ্গে গল্প করতে পারে। আর পাঠকের মনে ভ্রমণের ক্ষেত্রতো তৈরি হয়ই।
ব্যক্তিগত জীবনে আপনি জাতিসংঘের বড় কর্মকর্তা। পেশাগত জীবন সম্পর্কে কিছু ধারণা দেবেন কি?
আমি জাতিসংঘের একজন কর্মী হিশেবে কাজ করি, মোটেও বড় কর্মকর্তা নই। তেমন কোনো সম্ভাবনাও নেই, কারণ আমি আমার গন্তব্য ঠিক করে ফেলেছি। আমি বড় লেখা লিখতে চাই। বড় কর্মকর্তা হতে চাই না।
একদিন আমার এক পুরনো সহকর্মী আবদুল মোমিন আমার কাছে আসেন ওর সিভিটা দেখে দিতে, জাতিসংঘে আবেদন করবে। আমি ওর সিভিটা দেখে দিই এবং ওর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে আমিও একটা দরখাস্ত করে দিই। সেটা ২০০০ সালের কথা। কসোভোতে প্রচুর লোক নিচ্ছিলো। আমার হয়ে গেলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মোমিনের হল না।
এভাবেই শুরু। তিন বছর কসোভোতে কাজ করে ফিরে যাই ঢাকায়। ঢাকার ইউএনডিপিতে যোগ দিই, কিছুদিন পরে ইউএনএফপিএ-তে, দু’বছর পর আবার উড়াল। এবার পশ্চিম আফ্রিকায়, আইভরিকোস্টে। সাড়ে পাঁচ বছর আইভরিকোস্টে কাটিয়ে যাই সুদানের দারফুরে। ওখানে দু’বছর, এরপর নিউ ইয়র্কে। এখন সদর দফতরে কাজ করছি। জাতিসংঘের একটি আয়কর অফিস আছে। এই অফিসটির দায়িত্বে আছি।
আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পণা সম্পর্কে বলুন।
একসময় ভাবতাম জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল হতে হবে। সেক্রেটারি জেনারেলতো আর হওয়া যায় না, ওটা পলিটিক্যাল। এখন অবশ্যওসব আর ভাবি না। এখন ভাবি জন্ম এবং মৃত্যুর মাঝখানে যে জীবন, এই জীবনে এমন কিছু করে যেতে হবে যাতে পৃথিবীর অগ্রযাত্রায়, মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রায়, আমার একটি আঁচড় থাকে। আমি যে কাজটি ভাল পারি তা হচ্ছে লেখা। হয়ত পারবো, হয়ত পারবো না। কিন্তু চেষ্টাতো করতে পারবো। এইটুকু আমার দখলে।
আপনাকে পঞ্চাশতম জন্মদিনের শুভেচ্ছা। পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
ভাল পাঠক কখনো কখনো লেখককে গাইড করেন। ফেইসবুকের কারণে এখন অনেক পাঠকের সঙ্গে সরাসরি আন্তক্রিয়া হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই আন্তক্রিয়া আমাকে আনন্দ দেয়, আমাকে অনুপ্রাণিত করে। পাঠকপ্রিয়তা একজন লেখককে বাণিজ্যিকভাবে সফল করে। কেবল সে কারণেই নয়, কবি লিখেন পাঠকদের জন্যে। পাঠকদের প্রতি আমার অফুরান ভালবাসা।
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |