হিলারি-ট্রাম্প জ্বরে ভুগছে মধ্যপ্রাচ্যও। প্রবাসীদের মাঝেই দেখি জ্বরের উত্তাপ। ওমানের আমজনতার মাঝে এই উত্তাপ নেই।
Published : 15 Nov 2016, 04:12 PM
ওমানরা রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, গণতন্ত্র ওদের মাথার উপর দিয়ে যায়। সেটা জানার বা বোঝার তেমন আগ্রহও ওদের মাঝে নেই।
মিডিয়ার কল্যাণে হিলারি ক্লিনটনের সফেদ মুখটাই পৃথিবীবাসী বেশি দেখেছে। উইকিলিকসের তথ্য ফাঁসও হিলারি ভক্তদের মাঝে তেমন একটা প্রভাব ফেলেনি। বাঙালি প্রবাসী হিলারি বলতেই অজ্ঞান। বুক ভরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ট্রাম্পের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধারে সবাই ব্যস্ত।
কেউ ঘুণাক্ষরেও হিলারির অপরাধের কথা বলছে না। সবার মুখেই ট্রাম্পের বেফাঁস উক্তি আর তার নৈতিক স্খলনের কাহিনী। বাঙালি কোন আড্ডায় বসবেন আর হিলারি-ট্রাম্পের ঝড় সইবেন না- এটা অসম্ভব।
আমি মোটামুটি বিরক্ত। তাই সকল ধরনের আড্ডা থেকে গা বাঁচিয়ে চলেছি। কারণ আমি মার্কিন মুল্লুকের আমজনতা হলে ‘চিহ্নিত অপরাধী’ আর ‘সম্ভাব্য অপরাধী'র মাঝে ‘সম্ভাব্য অপরাধী’কেই বেছে নিতাম। আরো সহজ করে বললে ‘মিষ্টভাষী দুষ্টে’র চেয়ে আমি বেফাঁস কথা বলা ‘গর্দভ’কেই বেছে নিতাম।
আন্তর্জাতিক চেইন শপ বা কোম্পানিগুলো বেতন ভালোই দেয়। কিন্তু সেই বেতন যায় সাপ্লাই কোম্পানি বা রিক্রুট এজেন্টের পকেটে। যে শ্রম দিচ্ছে তার পকেটে যাচ্ছে মূল বেতনের মাত্র চল্লিশ শতাংশ। ষাট শতাংশ যাচ্ছে সাপ্লাই কোম্পনির পকেটে।
এই সাপ্লাই কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে যারা ওমান আসে তারা নিজেদের শেষ খড়কুটো বাজিতে রেখেই আসে। তাই বেতন নিয়ে এই তামাশা মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।
একটু ভাল করে বাঁচতে এরা মাসে কোন শুক্রবার ছুটি নেয় না। ওভারটাইম করে। প্রতিদিন চৌদ্দ ঘণ্টা কাজ করে। তারপরেই মেলে মূল বেতনের চল্লিশ শতাংশ। তা না হলে বেতন আরও কমে যায়। এদের সাথে আমি যতবার কথা বলেছি নিজেকে বড় বেশি অসহায় লেগেছে। কিছুই করার নেই শুধুই হাহাকার শোনা।
দুঃখজনক কিন্তু নির্মম সত্য এটাই-মধ্যপ্রাচ্যের আইন শ্রমবান্ধব নয়। পৃথিবীর সর্বত্রই দাস প্রথা ছিল এবং তা বিলুপ্তও হয়েছে। আরবীয়রা সহজে তা ছাড়তে পারেনি।
মধ্যপ্রাচ্যে থাকার সুবাদেই এর হাল-হকিকত কিছুটা আমার জানা। আইনত দাস প্রথা বিলুপ্ত হলেও, আরবীয়রা এখনও দাস প্রথায় আসক্ত। তাই আরবীয় সমাজে যারা আছেন, তারা জানেন ‘আরবাব’ বা ‘স্পন্সর’ (‘আরবাব’ শুধু মধ্যপ্রাচ্যের নাগরিকরাই হতে পারে ) কতটা শক্তিশালী। সে ইচ্ছে করলেই আপনাকে দেশ থেকে বিদায় জানাতে পারে। তাই তাকে খুশি রাখা আপনার দায়িত্বের মাঝে পড়ে।
ব্যবসা করুন অথবা রাস্তা সাফাই, যা-ই করুন না কেন, ‘আরবাব’ আপনার মাথার উপরে আছেই। আইন কিন্তু সব জানে। তবু ইচ্ছে করেই এই মডারেট দাস প্রথার প্রচলন।
এখানে অনেক বাঙালি বা ইন্ডিয়ান আছেন, যাদের মূল ব্যবসা কফি শপ। ইনভেস্টমেন্টও শত ভাগ তাদেরই। অথচ ব্যবসাটা চলে আরবীয়দের নামে। আরবীয়দের সুযোগ-সুবিধায় একটু হেরফের হলেই পুরো ব্যবসা আপনার লোপাট।
এ তো গেল ব্যবসায়ীদের কথা। এবার চাকরিজীবীদেরে খবর জানাই। এদের অবস্থাও আশাব্যাঞ্জক নয়। ইনভেস্টরদের সুখী করতেই যেন চাকরিজীবীদের জন্য খড়গ হাতে দাঁড়িয়ে আছে আরবীয় আইন।
আপনার পাসপোর্ট থাকবে কোম্পানির দখলে। বছরের পর বছর কাজ করে গেলেও মুক্তি মিলবে না। কারণ আপনার কোম্পানি যদি আপনাকে এনওসি ('নো অবজেকশন সার্টিফিকেট' বা কাজের ছাড়পত্র) না দেয়, আপনি কোথাও জয়েন করতে পারবেন না। সে আপনার যত বড় যোগ্যতাই থাক না কেন !
আর জেনে রাখা ভাল, কোম্পানি বিপদে (দেউলিয়া) না পড়লে সাধারণত কাউকেই এনওসি দেয় না, এটা মধ্যপ্রাচ্যের চিরাচরিত আইন। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্য নিজেও হারাচ্ছে দক্ষ শ্রমিক। অথচ এ বিষয়ে তারা একেবারেই উদাসীন।
আবার আছে ফ্রি ভিসার কিছু পেশাজীবী। ফ্রি ভিসা হচ্ছে যারা ইচ্ছেমতো বাইরের কাজ করতে পারে। এর বিনিময়ে তাকে আরবাবকে মাসে মাসে ফায়দা দিতে হয়। অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যের ফ্রি ভিসার প্ররোচণায় চলে আসেন। আসার পর বুঝতে পারেন, কাজ যোগাড় করা কতটা কষ্টসাধ্য। এর ওপর 'মরার উপর খাঁড়ার গা'র মতো আছে প্রতি মাস শেষে আরবাবের ফায়দা। সেখানে উনিশ-বিশ হলেই ক্যান্সেল দিয়ে আপনাকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করাবে। তাই যে করেই হোক, আরবাবের ফায়দা ষোল আনা বুঝিয়ে দিতে হয়।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, সাধারণ মুসলমানদের মাঝে আরবীয়দের নিয়ে বেশ ভক্তি-ভক্তি একটা ভাব আছে। তাদের উদ্দেশ্য করেই লেখা, মূল আরবীয়রা এশিয়ানদেরকে 'খারেজি' (যারা কোরআন ও হাদিসের পথ থেকে বেরিয়ে পড়ে,তাদেরকে খারেজি বলা হয়) হিসেবে মূল্যায়ন করে। যা মোটেও সম্মানজনক নয়।
একমাত্র সে-ই জানে আপনজনের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য কতটা মরিয়া হয়ে একজন মানুষ ‘অধিকারহীন’ হয়ে বাঁচতে ছুটে চলে আসে মধ্যপ্রাচ্যে।
লেখক: হেড অফ মার্কেটিং,প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ (সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমান)
ফেসবুক: https://www.facebook.com/faruk.hossain.108