অথচ আমাদের দেশে মাছিদের উৎপাত বাড়ে গরমকালে। অবশ্য পলিমাটির বাংলার সাথে উত্তপ্ত মরুর তুলনা না করাই ভাল।
ধর্মীয় বিশ্বাস এক হওয়া স্বত্ত্বেও আমাদের মাঝে চিন্তা চেতনায় যোজন যোজন পার্থক্য। পলিমাটির বাংলার মুসলিমদের চোখে উত্তপ্ত আরবদেশগুলো পায় পবিত্র ভুমির মর্যাদা। এর অন্যতম কারণ আরব ভূমিতে জন্মেছেন অনেক নবী-রাসূল এবং অধিকাংশের সমাধি এসব অঞ্চলেই।
ওমানের মাস্কাটে কোন নবী-রাসূলের কবর নেই। তবে সালালায় আছে। ওমানের সবুজ শহরের নাম সালালা। যার অধিকাংশ আগে ইয়েমেনের দখলে ছিল।
মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মগ্রন্থে ইয়েমেনের অনেক উল্লেখ আছে। অনেক নবী-রাসূল ইয়েমেনে জন্মেছেন। ইয়েমেনের কিছু অংশ ওমান দখল করে ফেলায়, নবী-রাসূলদের কয়েকজনের কবর পড়েছে সালালায়।
যেমন আইয়্যুব নবীকে খ্রিস্টান ও ইহুদীরা বলে ‘যব’। সালালা শহর থেকে প্রায় ৪০ কি. মি. দূরে ইত্তিন পাহাড় চূড়োয় আইয়্যুব নবীর মাজার। মাজারের ফলকে আইয়্যুব নবীর নাম কিন্তু ইংরেজিতে ‘যব’ নামেই লেখা আছে। আরবিতে আছে আইয়্যুব।
খ্রিস্টান-মুসলিম-ইহুদি সবাই সম্মান জানাচ্ছে। যদিও অধিকাংশ আরবীয়রা কোন মাজারে যায় না। আলাদাভাবে কোন সম্মানও প্রদর্শন করেন না। সম্মান জানান ভিনদেশিরা।
আইয়্যুব নবীর মাজারে যেতে, পাহাড়ি বাঁকের কারণে গাড়ির গতি ২০ থেকে ৩০ কি.মি.’র বেশি রাখা যায় না। যেখানে ওমানের অধিকাংশ এলাকার গড় গতি প্রায় ১০০ থেকে ১২০ কি.মি.। মাজারে প্রবেশের আগেই নজরে পড়বে আইয়্যুব নবীর পায়ের চিহ্ন, যা এখন বাধাই করে রাখা হয়েছে।
সবাই পায়ের চিহ্ন ও মাজারের ছবি তুলে নিচ্ছে। বলে রাখা ভাল, আরব দেশে কিন্তু মসজিদ কিংবা নবীদের মাজারে ছবি তোলা নিষিদ্ধ নয়। প্রথম প্রথম ছবি তুলতে আমার মাঝে এক দ্বিধা কাজ করত। পরবর্তীতে সেটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি।
ইত্তিন পাহাড়ের আরেক কোণে ছিল ওয়াস আল কুরুনি (রা.) কবর। ‘ছিল’ বলছি। কারণ বর্তমানে সেটি ভেঙে দেয়া হয়েছে।
ধূ ধূ পাহাড়ের মাঝখানে এক মাজার। সেখানে মূলত পাকিস্তানি, ভারতীয় আর বাংলাদেশিদের ভিড় ছিল । ওয়াস আল কুরুনি (রা.) সম্পর্কে ছোটবেলায় অনেক গল্প শুনেছি। অনেক হাদিসে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.) এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা দেখেছি তাঁর সম্পর্কে।
তাই তাঁর পরিচর্যাহীন অবহেলায় পরে থাকা কবরখানা দেখে বেশ কষ্ট হয়েছিল। কিছুদিন পর অবশ্য কবরখানা ভেঙ্গে দেওয়া হয়। এ কারণে আমার ভিতরে অনেক ক্ষোভও জমা হয়েছিল। কবরটার তো একটা ঐতিহাসিক মূল্য ছিল। কেন ভেঙ্গে দেয়া হল?
পরে অবশ্য আমার ভুল ভাঙে। পড়াশোনা করে জানতে পারি, ওটা আসলে ওয়াস আল কুরুনি (রা.) কবরই ছিল না।
তাঁর জন্ম ইয়েমেনে হলেও, মৃত্যুবরণ করেছিলেন সিরিয়ায় এবং সেখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। এ মাজার তবে কীভাবে হল- আমার জানা নেই। এমন হতে পারে তাঁর জন্মস্থানে হয়ত গায়েবি কবর খোঁড়া হয়েছিল। সে কারণেই আদি অধিবাসী, ওমানিরা অব্দি এঁকে ওয়াস আল কুরুনি (রা.) মাজার নামেই চিনতো।
এমন আরেকটি 'মাজার' আছে সালালা শহরের আওকাদ এলাকায়। ইউনুস নবীর মাজার। যাকে খ্রিস্টান ও ইহুদীরা 'যোনাহ' নামে চেনে। অথচ ইউনুস নবী মৃত্যুবরণ করেছিলেন ইরাকে এবং তাঁকে সেখানেই সমাধিস্থ করা হয়।
পরে জানতে পারি আওকাদ এলাকায় ইউনুস নবী মাছের পেট থেকে মুক্তি পায়। তাই সেই স্মৃতিকে ধরে রাখতেই আরব সাগরের পাশে এই 'মাজার'।
এই মাজার দেখে অনেকেই ভিমড়ি খায়। এতো লম্বা মাজার! ৩৩ মিটার বা ১০৮ ফুট লম্বা!
অনেকের মন্তব্য, আগেকার মানুষ অনেক লম্বা ছিল। আসল ঘটনা কিন্তু তা নয়। মূলত নবী ইমরানের কবর ভেঙে যাবার পর, এর নির্দিষ্ট জায়গাটা বোঝা যাচ্ছিল না। যে কারণে কবর বেশ লম্বা করে করা হয়, যাতে ভুল করেও তাঁর কবরে অসম্মান জানানো না হয়।
একটা তথ্য জানিয়ে রাখা ভাল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রায়ই নবী ইমরানের মাজারকে আদম (আ.) এর মাজার বলে প্রচার করা হয়। এটা অজ্ঞতা থেকে নাকি দুষ্টবুদ্ধি থেকে করা, বলা মুশকিল।
সালালা শহর থেকে প্রায় ১৭০ কি.মি. দূরে হাসিক ও সাদাহ শহরের নিকটবর্তী এলাকায় রয়েছে নবী হুদের কবর। যার পুরো নাম সালেহ বিন হুদ (আ.)। তাঁর নামকরণে কোরান শরীফের ১১ তম সুরা হূদ।
নবী হূদের মাজার পাহাড় চূড়োয়। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পৌঁছতে হয় নবী হূদের সমাধিতে। হূদ (আ.) ছিলেন নূহ (আ.)-এরই বংশধর। ইসলাম ধর্ম মোতাবেক, আল্লাহর গজবে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিশ্বের প্রধান ছয়টি জাতির মধ্যে নূহ (আ.)-এর পরেই হূদ (আ.)-এর জাতি ‘আদ’ ছিল।
প্রতি ধর্মের দেব-দেবতাদের কিছু অলৌকিক ক্ষমতা ছিল বলে সেসব ধর্মের অনুসারীরা মনে করেন।
ইসলামের অনুসারীরাও বিশ্বাস করেন তাদের কয়েকজন নবী-রাসুলের আল্লাহর অনুগ্রহে অলৌকিক ক্ষমতা ছিল, যাকে বলা হয় 'মাজেজা'।
সালালা শহরের মাঝেই রয়েছে সালেহ নবীর মাজেজার নিদর্শন।
সালেহ নবী তখন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন এবং পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসলো কাঙ্খিত উট। সালেহ নবীর সেই মাজেজা, কাতেবা পাহাড়ের কিয়দংশ যেখান থেকে উট বেরিয়ে এসেছিল- তা সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে।
ইতিহাসে ঘুরে বেড়াতে আমার মন্দ লাগে না। ঐতিহাসিক স্থানগুলোর প্রতি রয়েছে দুর্বলতা। ওমানে নবী-রাসুলদের কবর ঘুরেফিরে দেখার মূল কারণ সেটাই।
এই লেখায় অজান্তে কারো অনুভুতিতে আঘাত করে থাকলে মার্জনার চোখে দেখার অনুরোধ রইলো।
লেখক: হেড অফ মার্কেটিং, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ (সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমান)
ফেসবুক : https://www.facebook.com/faruk.hossain.108