প্যারিসবাসী শিল্পী শাহাবুদ্দিনের আতঙ্ক এখনও কাটেনি। তার একমাত্র মেয়ে চিত্র ছিলেন শুক্রবার রাতের হামলার সাক্ষী।
Published : 14 Nov 2015, 10:47 PM
তিনি একটি ফেইসবুক পোস্টে তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশের পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সহকারী সম্পাদক রাজু আলাউদ্দিন টেলিফোনে যোগাযোগ করেন তার সঙ্গে। ফেইসবুক পোস্ট ও শিল্পীর সঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের কথোপকথন নিচে তুলে ধরা হল।
ভয়ঙ্কর রাত কাটালাম। ভয়ঙ্কর! এখনও থেকে থেকে শিউরে উঠছি। আতঙ্ক কেমন একটা ঘোর লাগিয়ে দিয়েছে। রাত তখন সাড়ে ৮টা। ডিনারের জন্য আমরা প্রস্তুত হচ্ছি। আমার মেয়ে চিত্র তখনও ফেরেনি। বাস্তিলের দিকে গিয়েছে। প্রত্যেক উইকএন্ডে-ই সে বন্ধুদের সঙ্গে বাস্তিলের দিকে যায়। তরুণ প্রজন্মের ভিড়ভাট্টাই ওদিকে বেশি। উইকএন্ডে ভিড় আরও বেশি থাকে।
আমিও সন্ধ্যাবেলা বাস্তিলের দিকেই গিয়েছিলাম। তরুণ চিত্রীদের একটা প্রদর্শনী চলছে। সেটা দেখে তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরেছি। জানি চিত্রর ফিরতে রাত হবে। সে ডিনার করেই ফিরবে। তাই আমি আর আমার স্ত্রী ডিনারের জন্য তৈরি হচ্ছি। চিত্র ফোন করল। ত্রস্ত কণ্ঠস্বর। সে জানাল, খুব বিপদ। বাস্তিল এলাকার একটি ক্যাফের বেজমেন্টে সে লুকিয়ে রয়েছে আরও অনেকের সঙ্গে। সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। চিত্র বলছিল, “খুব গোলাগুলি চলছে। মনে হচ্ছে যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে।”
আমার তো বিশ্বাস হচ্ছিল না। স্ত্রীকে বললাম টিভি চালাতে। নিউজ চ্যানেল দেখে আমরা হতবাক। একটু আগেই যেখান থেকে ঘুরে এলাম, সেখানে এ কী অবস্থা! রীতিমতো যুদ্ধ চলছে। সেনাবাহিনী ছোটাছুটি করছে। গোলাগুলি চলছে। জানতে পারলাম ভয়ঙ্কর জঙ্গি হামলার শিকার হয়েছে প্যারিস। খুব টেনশন শুরু হয়ে গেল। শুধু ভাবছি মেয়েটাকে কখন দেখতে পাব। আদৌ দেখতে পাব তো? খুব অসহায় লাগছিল আমাদের।
তবে চিত্র মাঝেমধ্যে সুযোগ মতো ফোন করে নিজের খবর দিচ্ছিল। ওরা ক্যাফেতে বেশিক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারেনি। আলো নিভিয়ে সবাই বেজমেন্টে চলে গিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু যুদ্ধ এমন ভয়ঙ্কর আকার নিচ্ছিল যে ওরা ভয় পেয়ে যায়। যে রাস্তায় ওই ক্যাফেটা, সেই রাস্তাতেই বাতাক্লাঁ কনসার্ট হল। ফলে, বিস্ফোরণ, গোলাগুলি, আর্তনাদ, মৃত্যু— সব চলছিল চিত্রদের ঘিরেই। ওদের মনে হচ্ছিল ক্যাফেটাতেও বোমা হামলা হতে পারে। তাই পিছনের দরজা দিয়ে লুকিয়ে বেরিয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে কোনওক্রমে পিছন দিকের একটা গার্ডেনে পৌঁছয় চিত্ররা। তার পাশে সার সার বাড়ি। কিন্তু সব অন্ধকার। শুধু স্ট্রিট লাইটগুলো জ্বলছে। জঙ্গি হামলার ভয়ে বাড়ি-ঘর, দোকানপাট, ক্যাফে-রেস্তোরাঁয় সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। দরজা-জানালা সব বন্ধ। কারও বাড়ির ভিতরে লুকিয়ে যে প্রাণ বাঁচাবে, তারও উপায় নেই। কিছুক্ষণ পর চিত্রর ফোন পেলাম। শশব্যস্তে ফোন ধরেছি। দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়।
চিত্র বন্ধুদের থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। প্রবল আতঙ্কে পালানোর সময় কে কোথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছে, কেউ জানত না। একে একে আশ্রয় খুঁজে নেওয়ার পর তারা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করা শুরু করে। মোবাইলে। কারও পক্ষেই একা বাড়ি ফেরা সম্ভব ছিল না। একা কাউকে রাস্তায় দেখলে সেনা তাকেও জঙ্গি বলে ভাবতে পারে। তাই সবাই এক জায়গায় জড়ো হতে চাইছিল।
রাত ১২টা নাগাদ পুলিশ জানাল, জঙ্গিরা শেষ। চিত্ররাও ততোক্ষণে একত্র হতে পেরেছে। তবে প্যারিস পুরোপুরি জঙ্গিমুক্ত কি না, তা তখনও নিশ্চিত নয়। আতঙ্ক গিলে ফেলেছে গোটা শহরটাকে।
মেয়ে সুস্থ রয়েছে জানতে পেরেই আমার অন্য বন্ধু আর পরিচিতদের খোঁজ নিতে শুরু করি। বাস্তিল চত্বরে বিভিন্ন ক্যাফে, রেস্তোরাঁতে অনেক বাঙালি কাজ করেন। বেশিরভাগই বাংলাদেশের। ফোন করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করি। জানতে পারি তারাও অক্ষত আছেন। বন্ধু-বান্ধবরা আমাদেরও বার বার ফোন করছিলেন। খোঁজখবর নিচ্ছিলেন।
প্রশাসন এবং রেডক্রস-সহ নানা সংগঠন ততোক্ষণে ঘটনাস্থলে পৌঁছে গিয়েছে। জখমদের উদ্ধারের সঙ্গে আটকেপড়া মানুষদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও করছিল তারা। চিত্রকে অবশ্য আমার এক বন্ধু নিজের গাড়িতে করে বাড়ি পৌঁছে দিল। তখন ভোর ৪টা। মেয়েকে গাড়ি থেকে অক্ষত নামতে দেখে বুক থেকে যেন পাথর নামল।
এতো ভয় আগে কখনও পাইনি। এতো অসহায় আগে কখনও মনে হয়নি নিজেকে। মুম্বাইতে যে রকম হামলা হয়েছিল, প্যারিসে হুবহু সে রকমই দেখলাম। মুম্বাইয়ের ঘটনা টিভিতে দেখেছিলাম। ভয়ঙ্কর! এবার প্যারিসে নিজেই সেই পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেলাম। এমন জঘন্য কাজ কারা ঘটাতে পারে! কোন ধরনের মানুষ তারা? অথবা আদৌ মানুষ কি? আমার সত্যিই আতঙ্কের ঘোর কাটছে না। গোটারাত ঘুমাতে পারিনি। এখন কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ব, তেমন মানসিক স্থিতিতে পৌঁছতে পারছি না।
রাজু: হ্যাঁ শাহাবুদ্দিন ভাই, আমি রাজু আলাউদ্দিন।
শাহাবুদ্দিন: হ্যাঁ, রাজু আলাউদ্দিন।
রাজু: সেটা হলো, ফজলুল বারীকে আপনি তো বোধ হয় চেনেন, সিডনিতে থাকে। ফেইসবুকে তার স্ট্যাটাসে আপনার অনুভূতি জানিয়ে একটা লেখা দিয়েছে। ওটা কি আপনার নিজের?
শাহাবুদ্দিন: যেমন, কী দিয়েছে?
রাজু: সেটা হলো, শিরোনাম ‘এত বছর প্যারিসে আছি, এমন ভয় কখনও পাইনি'। শাহাবুদ্দিন।
শাহাবুদ্দিন: আমি আরেকজনের ইয়েতে দিছি, ও সংক্ষেপ করেছে। হ্যাঁ ঠিকই আছে।
রাজু: আমি তাহলে আরও কয়েকটা জিনিস আপনার কাছ থেকে জেনে নিই। তাহলো এই লেখাটা আপনার প্রতিক্রিয়াসহ দিতে চাই।
চিত্র (শাহাবুদ্দিনের কন্যা) ভালো আছে শাহাবুদ্দিন ভাই?
শাহাবুদ্দিন: হ্যাঁ, চিত্র তুমি কিছু বলতে পার ... চিত্র.. আসলে ও এখন কিছু বলতে চায় না। দুই/তিন ঘণ্টা পরে করলে হয়তো বলতে পারবে। ও রেস্ট নিচ্ছে।
রাজু: আচ্ছা ঠিক আছে, আমি তাহলে একটু পরে করবো। ঘণ্টাখানেক পরে করলে কি পাব?
শাহাবুদ্দিন: আসলে আরেকটু পরে কর। এই অভিজ্ঞতা ওকে সন্ত্রস্ত করে দিয়েছে, বন্ধুবান্ধবসহ সবাই ওখানে ছিল। কেমন জানি হয়ে গেছে ব্যাপারটা...
রাজু: আসলেই এটা এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। যাক, বাঙালি কেউ আহত বা নিহত হয়েছে বলে শুনেছেন?
শাহাবুদ্দিন: আমি আবারও বলছি, ওখানে যে এলাকাটা--তোমার মাথায় রাখ--আমাদের যেমন শাহবাগ থেকে এলিফ্যান্ট রোডটা আছে না-- এই রোডটা চিন্তা কর, ব্যস্ত থাকে সবসময়। রিপাবলিক এবং বাস্তিল- ওই এলাকায় বেশিরভাগ তরুণরা আড্ডা দেয়, ওখানে একজিবিশন হয়। আগেরদিন আমি গেছিলাম ওখানে একজিবিশন দেখতে। পরিবেশটা কিছুটা শাহবাগের মতো। ইয়ংদের আড্ডা। আমাদের বিদেশি এবং ফরাসি যে মধ্যবিত্ত সমাজটা আছে তারা ওই জায়গাটায় মিলিত হয়। ঠিক ওই জায়গাটাতেই অ্যাটাক করেছে। হাই লেভেলের লোকজনের জায়গায় হলে এক কথা, আসলে ওরা অ্যাটাক করেছে খুবই মধ্যবিত্ত এবং প্রোগ্রেসিভ জনসমাগমে। পরিকল্পিতভাবে একসাথে করেছে। এটা আমার কাছে খুব দুঃখজনক মনে হয়। আমরা তো সাধারণত আমেরিকার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করি, কিন্তু ফ্রান্সে এ রকম ঘটবে এটা অকল্পনীয় ছিল।
রাজু: হ্যাঁ, তাইতো ফ্রান্সে এরকম ঘটতে পারে এটা অভাবনীয় এবং দুঃখজনক তো বটেই। আমরাও আসলে আতঙ্কের মধ্যে আছি। আপনি তো জানেন.....
শাহাবুদ্দিন: আমরা সারা পৃথিবীতে আমেরিকার ভূমিকা জানি, রাশিয়ার ভূমিকা জানি, ফ্রান্সের ভূমিকাতো তেমন না।
রাজু: হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন।
শাহাবুদ্দিন: ইতিহাসে প্যারিসের কী অবস্থান, তা কে না জানে! এখানেও যদি আক্রমণ হয়, তাহলে আর তো কোনো নিরাপদ জায়গা নাই।
রাজু: এই আক্রমণ একটা বড় আতঙ্ক তৈরি করলো।
শাহাবুদ্দিন: কিন্তু আমি আবার আশাবাদীও। আশাবাদী এই কারণে যে এক্সট্রিমিস্ট ছাড়া অন্য সব দল একত্রিত হয়ে গেছে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে। অল রেডি কয়েকজন ধরা পড়েছে। এর সমাধানতো একটা দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার।
রাজু: তাতো বটেই, কারণ সমস্যাটাতো আর রাতারাতি হয়নি, ফলে সমাধানও রাতারাতি হওয়ার কথা না।
শাহাবুদ্দিন: আমি যেখানে থাকি তা থেকে দুই তিন/কিলোমিটার দূরে ঘটেছে এবং হেঁটে গেলে হয়তো পনের মিনিট লাগে। শাহবাগ থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরির যে দূরত্ব। আজকে সকালে গিয়েছিলাম ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে, গিয়ে দেখি ব্যাংক বন্ধ। আজকে শনিবার ছুটির দিন, কিন্তু দেখলে মনে হয় খাঁ খাঁ করছে এলাকাটা, ভয় লাগে এই অবস্থা দেখলে। উনিশশ একাত্তরের মতো হয়তো নয়, কিন্তু ঘটনাটা অনেকটা সে রকমই ছিল। একজন আরেকজনের সাথে দেখা হলে কুশল বিনিময় করছে, যদিও আমি আমার মেয়ের ওই ঘটনায় উপস্থিতির কথা আর বললাম না। কেবল আমার ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে মেয়ের কথা বলেছি। ওই এলাকাতে এখন আর যাওয়া যায় না, এখন বন্ধ করে দিয়েছে। টেররিস্ট আছে কি না কিংবা কে যে টেররিস্ট কিছুই তো বোঝা যায় না। এই কারণে বন্ধ করে দিয়েছে। আমার মেয়ের লাক ফেবার করছে কারণ অ্যাটাকটা হয়েছে রাতে.....
রাজু: হ্যাঁ, সৌভাগ্যক্রমে ওই ঘটনার সময় ওখানে থেকেও বেঁচে গেছে।
শাহাবুদ্দিন: কাছেই একটা গার্ডেন আছে, অন্ধকার ছিল বলে .... ওরা ওই অন্ধকার থেকেই দেখছিল সন্ত্রাসীরা দৌড়াদৌড়ি করছে, কিন্তু সন্ত্রাসীরা আমার মেয়ে ও বন্ধুবান্ধবদের দেখতে পায়নি অন্ধকার বলে।
রাজু: অন্ধকার ওদেরকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
শাহাবুদ্দিন: ওরা বুদ্ধিমানের কাজ করেছে। আশপাশে শুধু রাস্তার বাতিগুলো জ্বলছিল। আশপাশের বাড়ি-ঘরের বাতিগুলো ভয়ে নিভিয়ে দিয়েছিল।
রাজু: কী ভয়ংকর! দূর থেকে আপনার বর্ণনা শুনেই আতঙ্কিত বোধ করছি। শাহাবুদ্দিন ভাই, আরেকটা জিনিস, হামলাগুলো তো বড় আকারে হচ্ছে, আমাদের এখানে সম্প্রতি একজন প্রকাশককে হত্যা করা হলো, আরও কয়েকজনকে আহত করা হয়েছে। এগুলো সম্পর্কে আপনার প্রতিক্রিয়া বলবেন?
শাহাবুদ্দিন: আমি এখনও এখানকার আতঙ্কটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তুমি বিশ্বাস করতে পারবা না রাতে এই ঘটনা যখন শুনি, মেয়ের জন্য তখন কী অবস্থা আমার। আমার আতঙ্কটা এখনও যায় নাই। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত মানুষরাই এর শিকার হচ্ছি সর্বত্র। তুমি আমাকে অন্য সময় ফোন করো, আমি ঠাণ্ডা মাথায় বলব। ওই ভয়ঙ্কর রাতে আমার মেয়েটা অন্ধকারের মধ্য দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে হেঁটে হেঁটে অনেক দূর এসে আমাকে রাত ১২টার দিকে ফোন করেছিল, বললো ওরা একটা নিরাপদ জায়গায় আছে।
প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা এখন থেকে সরাসরি আমাদেরকে জানাতে পারেন। নাম, ঠিকানা ও সংশ্লিষ্ট ছবিসহ লেখা পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায় [email protected]