গ্রেপ্তারের ভয় পাই না: খালেদা

গ্রেপ্তারের ভয় পান না জানিয়ে ক্ষমতাসীনদের ‘পালানোর পথ’ তৈরি রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Sept 2014, 12:08 PM
Updated : 23 Sept 2014, 03:55 PM

মঙ্গলবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিয়াজ মুহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায় তিনি বলেন, “আমি কখনোই গ্রেপ্তারে ভয় পাই না। আমি সরকারকে বলব, আমাকে বন্দি করার আগে নিজের রাস্তা পরিষ্কার করে রাখুন। নিজেদের পাসপোর্টে ভিসা লাগিয়ে রাখুন।

“নইলে আলম-উলামাসহ জনগণ এমনভাবে রাস্তায় সমবেত হবে, আপনারা পালানোর পথ পাবেন না।”

দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করলে খালেদাকেও গ্রেপ্তার করা হতে পারে- গত শনিবার আওয়ামী লীগের যৌথসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন ইংগিত নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর খালেদা জিয়ার এই জবাব এলো।

নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্রুত নির্বাচন ও ষোড়শ সংশোধনী, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা বাতিল এবং ‘গুম-খুন-হত্যা’ বন্ধের দাবিতে স্থানীয় ২০ দলীয় জোটের উদ্যোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এই জনসভা হয়।

উচ্চ আদালতের বিচারকদের সরানোর ক্ষমতা সংসদকে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনের সমালোচনায় খালেদা সমাবেশে বলেন, বিচারপতিদের ‘হাত-পা বেঁধে রাখতে’ এই সংশোধনী।

“এটা বাতিল করতে হবে। এটা বাতিলের দাবিতে আমরা এক দিন হরতাল দিয়েছি।এটাই শেষ নয়। প্রয়োজনে যে কোনো কর্মসূচি দিতে আমরা প্রস্তুত থাকব।”

বর্তমান ‘অবৈধ-খুনী-জালেম’ সরকারকে হটাতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান বিএনপি প্রধান।

ঈদের পর নতুন কর্মসূচি দেয়ার ইংগতি করে তিনি বলেন, “ঈদের পর যে আহ্বান জানানো হবে, আপনারা তাতে সাড়া দেবেন। আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই, আমি সেখানেই থাকি, আমার দল আছে, সবাই একসঙ্গে আন্দোলনের জন্য কাজ করে যাবে।”

৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর ঢাকার বাইরে খালেদা জিয়ার এটি তৃতীয় রাজনৈতিক জনসভা। সর্বশেষ গত ২৮ মে মুন্সিগঞ্জে এক জনসভায় তিনি বক্তৃতা দেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর, সরাইল, আশুগঞ্জ, আখাউড়া, নবীনগর, নাসিরনগর, বিজয়নগর, কসবা, বাঞ্ছারামপুর- এই নয় উপজেলা থেকে বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মী নিয়াজ মুহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের এই জনসভায় অংশ নেন।

হাতে দলীয় প্রতীক ধানের শীষ; জিয়াউর রহমান, তারেক রহমান ও খালেদা জিয়ার বড় বড় ছবি সম্বলিত ফেস্টুন নিয়ে মিছিল করে ব্যান্ড বাজিয়ে সমাবেশে যোগ দেন তারা। 

সমাবেশের জন্য নিয়াজ মুহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে শতাধিক মাইক বসানো হয়। মাঠের বাইরে কাউতলী, মেড্ডা, কাজীপাড়া, মধ্যপাড়া, বাদুবর, দোকনীঘাট, টিইরু, হালদারপাড়া সড়কে অবস্থান নিয়েও নেতাকর্মীরা বক্তৃতা শোনেন। 

 

‘ভয় দেখাবেন না’

বিকাল ৩টায় জনসভার কার্যক্রম শুরুর পর সাড়ে ৪টায় মঞ্চে আসেন প্রধান অতিথি খালেদা জিয়া। নেতা-কর্মীরা এ সময় তুমুল করতালি দিয়ে তাকে স্বাগত জানান।

৪৫ মিনিটের বক্তৃতায় দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ২০ দলীয় জোট, আইনশৃঙ্খলা অবস্থা, সরকারের ‘অপশাসন, দুর্নীতিসহ’ নানা বিষয় তুলে ধরেন বিএনপি চেয়ারপার্সন।

খালেদা জিয়া বলেন, “এখন যারা ক্ষমতায় আছে, তারা একটি অবৈধ সরকার। জনগণ এদের ভোট দেয়নি। তারা (আওয়ামী লীগ) বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়ে একের পর এক আইন করছে। তারা দেশকে একদলীয় শাসনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।”

সরকার ‘মিথ্যা মামলায়’ সাজা দেয়ার ‘ষড়যন্ত্র’ করছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “শেখ হাসিনা- আমি গ্রেপ্তারের ভয় পাই না। ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিনও আমাকে দেশ থেকে বের করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা পারেনি। ওই সময়ে শেখ হাসিনা দেশের বাইরে চলে গিয়েছিল। এখন তিনি (শেখ হাসিনা) বড় বড় কথা বলেন।”

জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট ও জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সোমবার খালেদা জিয়ার সময়ের আবেদন নাকচ করে তার অনুপস্থিতিতেই সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করে ঢাকার আদালত।

ওই দুই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সোয়া পাঁচ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে খালেদা বলেন, “সরকার প্রধানকে বলব, আমাকে জেলখানায় যাওয়ার কিংবা মিথ্যা মামলা দিয়ে সাজা দেয়ার ভয় দেখাবেন না।”

‘র‌্যাব পচে গেছে’

‘গুম-খুনে’ জাড়িয়ে পড়ায়’ র‌্যাবের বিলুপ্তি দাবি করেন বিএনপি প্রধান।

তিনি বলেন, “র‌্যাব পচে গেছে। তাদের গ্যাংগ্রিন হয়েছে। এদের ফেলে দিতে হবে।”

নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসানের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করে তিনি বলেন, “র‌্যাবের কর্নেল জিয়া এখনো কীভাবে চাকরিতে থাকে। তাকে গ্রেপ্তার করে জেলখানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সব কিছু বেরিয়ে যাবে। এই ভয়ে তাকে সরকার গ্রেপ্তার করছে না।”

খালেদা বলেন, পুলিশের সঙ্গে বিএনপির কোনো বিরোধ নেই।

“পুলিশ বাহিনীকে বলব, আপনারা সকলের সঙ্গে নিরপেক্ষ ব্যবহার করুন। ছাত্রলীগ-যুবলীগকে পাহারা দেয়ার দায়িত্ব আপনাদের নয়। আমি বলব, আপনারা আমাদের শান্তিপূর্ণ মিছিল-মিটিংয়ের ওপর গুলিবর্ষন করবেন না।”

গুম-খুনের বিরুদ্ধে জনগণকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, “আমি বলতে চাই, দেশে যেভাবে গুম-খুন হচ্ছে, এর বিরুদ্ধে আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমরা প্রস্তুত আছি। জনগণকেও প্রস্তুতি নিতে হবে।”

‘বিদ্যুৎ নিয়ে মিথ্যাচার’

বিএনপি চেয়ারপার্সন তার বক্তব্যে দ্রব্যমূল্যের ‘উর্ধ্বগতি’, কর্মসংস্থানের অভাব, বিনিয়োগে ‘মন্দা’ এবং বিদ্যুৎ সংকটের কথা তুলে ধরে সরকারকে ‘চরম ব্যর্থ’ আখ্যায়িত করেন।

তিনি বলেন, ‘কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের নামে ২০০৯ সাল থেকে সরকার ১৭ হাজার কোটি টাকা ভুর্তকি দিয়েছে। কিন্তু বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়েনি। তারা প্রচার করে বেড়ায় ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। এটা মিথ্যা তথ্য। এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট।”

বিদ্যুতের কথা বলে আশুগঞ্জ সার কারখানা বন্ধ রেখে বিদেশ থেকে সার আমদানির নামে ‘কমিশন নেয়া হচ্ছে’ বলেও অভিযোগ করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন।

“টেলিভিশনের সংবাদে দেখলাম, মসজিদ-মাদ্রাসা-মন্দির-গির্জার নামে যেসব অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে, তা সরকারের লোকজন খেয়ে ফেলেছে। আলেম-এতিমদের টাকা তারা খেয়ে ফেলছে। যেখানে টাকা সেখানেই তাদের হাত। টাকা দেখলে তারা লোভ সামলাতে পারে না।”

আর্থিক খাতে ১ লাখ ৯৫ হাজার ৭ শ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ তুলে খালেদা জিয়া বলেন, “রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকের পরিচালনা পর্যদের অব্যবস্থাপনা ও দলীয়করণের বিষয়ে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন সেজন্য আমি অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। কারণ আওয়ামী লীগ কখনোই সত্য কথা বলে না। রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে- এই একটি সত্য কথা বলার  জন্য অর্থ মন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই।”

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনগণের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “এদের (সরকার) হাতে সাধারণ জনগণ, বিডিআরের ৫৭ সেনা কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, আলেম-এতিমদের রক্ত। এরাই আবার আপনাদের কাছে হিজাব পড়ে তসবিহ হাতে ভোট চাইতে আসবে। তাদের ক্ষমা করবেন না।”

পৌর বিএনপির সভাপতি শফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে জনসভায় অন্যদের মধ্যে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, রফিকুল ইসলাম মিয়া, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আল নোমান, সেলিমা রহমান, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা উকিল আবদুস সাত্তার, শওকত মাহমুদ, অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব বরকত উল্লাহ বুলু, সালাহউদ্দিন আহমেদ, সাংগঠনিক গোলাম আকবর খন্দকার, কেন্দ্রীয় নেতা আবদুস সালাম, আসাদুজ্জামান রিপন, খায়রুল কবীর খোকন, নাজিম উদ্দিন আলম, সৈয়দ একে একরামুজ্জামান, এম এ খালেক, মহিলা দলের সভাপতি নুরী আরা সাফা, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মীর সরফত আলী সপু, মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাত, ছাত্রদলের সভাপতি আবদুল কাদের ভুঁইয়া জুয়েল, স্থানীয় নেতাদের মধ্যে খালেদ হোসেন মাহবুব শ্যামল, আবু আসিফ, কাজী আনোয়ার হোসেন, তকদির হোসেন জসিম, জহিরুল হক খোকন, আনিসুর রহমান মঞ্জু, এ বি এম মোমিনুল হক বক্তব্য দেন।

জোট নেতাদের মধ্যে ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর অধ্যাপক মজিবুর রহমান, ইসলামী ঐক্যজোটের আবদুল লতিফ নেজামী, বিজেপির আন্দালিব রহমান পার্থ, খেলাফত মজলিশের মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক, কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, জাগপার শফিউল আলম প্রধান, এনডিপির খোন্দকার গোলাম মুর্তজা, এনপিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, এলডিপির রেদোয়ান আহমেদ, লেবার পার্টির মুস্তাফিজুর রহমান ইরান, সাম্যবাদী দলের সাঈদ আহমেদ, ইসলামিক পার্টির কলম খান, জমিয়তের উলামা ইসলামে জুনায়েদ আল হাবিব, মাওলানা জহিরুল হক ও মরহুম মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ছেলে মাওলানা আবদুল হাসানাত আমিনী।

জনসভার পর কিছুক্ষণ জেলার সার্কিট হাউজে অবস্থান করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন খালেদা জিয়া।