প্রধান ও গৌণ রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো কর্মসূচি এবং উচ্চবাচ্য ছাড়াই কেটেছে বহু আলোচিত ও সমালোচিত এক এগারো।
Published : 11 Jan 2016, 11:17 PM
২০০৭ সালের জানুয়ারির ১১ তারিখ ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচনকালীন বিতর্কিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা গ্রহণ করে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত ফখরুদ্দীন আহমেদের সরকার।
জরুরি অবস্থা জারি করে দুর্নীতি দমন অভিযানের কথা বলে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল শীর্ষ রাজনীতিকদের। সংকুচিত করা হয়েছিল বাক ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা।
নবম সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর প্রথম দুই বছর প্রধান দুই দল দিনটি সক্রিয়ভাবে পালন করলেও নবম বর্ষপূর্তিতে টু শব্দটি ছিল না কারোরই।এক এগারোর কথিত কুশীলবদের বিচারের দাবিতে বিএনপি প্রথম দুই বছর সোচ্চার থাকলেও তাদের কণ্ঠও ছিল ম্রিয়মান।
নয় বছর আগের এ দিনকে ঘিরে এখনও প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরকে দোষারোপ করে। রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের অনেক প্রতিনিধি রাজনীতির ‘হুমকি’ হিসেবে ওয়ান ইলেভেন শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন।
এক/এগারো পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির শীর্ষ দুই নেত্রীকে বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়াকে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ বলে অনেকে আখ্যায়িত করেন।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময় বক্তব্যে এ ধরনের ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন।
“একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, সেদিন যারা মাইনাস টু ফর্মুলা প্রবর্তন করতে চেয়েছিল তারা এখনও সক্রিয়। মাঝে মাঝেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাচ্ছে,” বলেন তিনি।
অপরদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অভিযোগ করেন, যারা মুখে ‘মাইনাস টু’ এর কথা বলতো, তারা আসলে ‘মাইনাস ওয়ান’ ফর্মুলা বাস্তবায়ন করে বিএনপিকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল।
১১ জানুয়ারির ঘটনার জন্য তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদকে দায়ী করে তিনি বলেন, “মইন বিএনপির ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে জিয়াউর রহমান হতে চেয়েছিলেন। এজন্য বিএনপির কিছু বেঈমানও তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল।”
বিএনপি আবার ক্ষমতায় এলে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ফখরুদ্দীন আহমদ ও সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের বিচার করার ঘোষণা দেন খালেদা জিয়া।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কথিত ‘মাইনাস টু থিওরি’র মূল ‘হোতা’ ফখরুদ্দীন আহমদ ও মইন উ আহমেদের বিচার কেন করা হচ্ছে না- প্রধানমন্ত্রীর কাছে তা জানতে চান বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ।
এমন সময়ে বিভিন্ন মহলে তত্ত্বাধায়ক ব্যবস্থা বিলোপের প্রস্তাবও উঠে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কারণেই দেশে এক-এগারোর মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৭ সালের ওই সময়ে রাজনৈতিক সরকার থাকলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১১ সালের ২৬ জুন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থারই বিলোপ করে দেয়।
তবে ওই সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট।
যা ঘটেছিল সেদিন
২০০৬ সালের শেষভাগে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী জোট সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতা-হানাহানির আপাত অবসান ঘটে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের জরুরি অবস্থা জারির মধ্যে দিয়ে। একইসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দেন তিনি। বাতিল করা হয় ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন।
দেশজুড়ে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও অর্থনীতির স্বার্থে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন।
সেদিন সন্ধ্যা থেকেই জরুরি অবস্থা কার্যকর হয়। রাত ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত ঢাকাসহ সব মহানগরী ও জেলা শহরে ঘোষণা করা হয় কারফিউ।
গভীর রাতে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ সুগম করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
পরদিন সেনা বাহিনীর সমর্থন নিয়ে নতুন প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমদ।
'ওয়ান ইলেভেন'এর পটপরিবর্তন নানান অস্বস্তির জন্ম দেয় শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। দল ভাঙা-দল গড়ার 'খেলা'ও ওই সময়ে দেখে জনগণ।
১১ জানুয়ারি ক্ষমতার পালাবদলের পর জরুরি ক্ষমতার আওতায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হয়েছিল। দুর্নীতির মামলায় বহু রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এক পর্যায়ে গ্রেপ্তার হন শীর্ষ দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া। তবে শেষ পর্যন্ত তাদের মুক্তি দিয়েই নির্বাচনের দিকে এগোতে হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে।
শুরুতে দেশের মানুষ সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সমর্থন করলেও এক সময় তা কমে আসে এবং নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি বাড়তে থাকে।
সেনা সমর্থিত ওই সরকারকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় ছাত্ররা। ২০০৭ সালের অগাস্টে সেনা সদস্যের ছাত্র লাঞ্ছিত হওয়ার অভিযোগ এনে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা। পরে তা সারাদেশে ছাত্রবিক্ষোভে রূপ নেয়।
ছাত্র বিক্ষোভের ওই ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রকে। পরে সাজা হলেও রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় তাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সরকার।
এই সরকার নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে দুই বছর পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর, আবার গণতন্ত্রে ফেরে দেশ।