ঢাকায় মানবিক সঙ্কট ও জরুরি পরিস্থিতির সাংবাদিকতা নিয়ে শুক্রবার একটি প্যানেল আলোচনায় তার এই মত আসে।
তৌফিক ইমরোজ খালিদীর সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে আলোচক প্যানেলে ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সাংবাদিক ব্রায়ান জন টমসন, নেপালের দেওয়ান রাই, ফিলিপিন্সের রভেনা পরান, ভারতের হার্তশ সিং বল, চীনের শিয়াংমেই ঝং এবং বাংলাদেশের হুমায়ুন কবীর ভূইয়া।
নতুন মিডিয়ার আগমণে সম্ভাবনা ও হুমকির দিকগুলোর পাশাপাশি নতুন উদ্ভাবনের প্রসঙ্গ আসে তাদের আলোচনায়।
আন্তর্জাতিক রেডক্রস (আইসিআরসি) ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রতিবেদকদের সংগঠন ডিক্যাবের যৌথ আয়োজনে এশিয়া মিডিয়া কনফারেন্সের অংশ হিসেবে এই অনুষ্ঠানে জড়ো হয়েছিলেন এশিয়া-ওশেনিয়া অঞ্চলের এই জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা।
সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ‘নির্ভুল’ থাকাকে অন্য যে কোনো বিষয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী।
মানবিক সঙ্কটের সময়ে সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কেবল বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বেই এ ধরনের রিপোর্টিং একটি চ্যালেঞ্জের কাজ।
“তবে আমার মতে, যখন আসন্ন কোনো সঙ্কট নিয়ে আমাদের রিপোর্টিং করতে হয়, যা এখনও ঘটেনি, কিন্তু ঘটতে যাচ্ছে, সেই প্রতিবেদন করতে আরও অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়।”
তিনি বলেন, “যখন কোনো দুর্ঘটনা বা বিপদ ঘনিয়ে আসছে, সেই পরিস্থিতিতে রিপোর্টিং আরও অনেক বেশি কঠিন।”
এর উদাহরণ দিতে গিয়ে বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে সাম্প্রতিক খাদ্য সঙ্কটের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী।
তিনি বলেন, সংবাদমাধ্যমই সেই আসন্ন বিপদের কথা প্রথম জানিয়েছিল। ৭৬ কিলোমিটার দূরে বসে থাকা সরকারি কর্মকর্তারা সংবাদমাধ্যমে খবর পাওয়ার পরই উদ্যোগী হয়েছিলেন।
“আমরা সে সময় জানতে পারলাম, মানবিক বিপর্যয়ের খবর কী করে প্রকাশ করা উচিৎ, তা আমরা জানি না।”
সংবাদমাধ্যম সে সময় সংবেদনশীল আচরণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল বলে যে সমালোচনা কেউ কেউ করেন, তার সঙ্গে সহমত পোষণ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম সম্পাদক বলেন, “আমি বলব, ওই সমালোচনা সঠিক। সংবাদমাধ্যমের অনেক আচরণ ছিল কাণ্ডজ্ঞানহীন।”
গণমাধ্যমের ভূমিকার কথা বলতে গিয়ে তৌফিক ইমরোজ খালিদী কয়েক বছর আগে কারওয়ানবাজারে একটি ভবনে অগ্নিকাণ্ডের প্রসঙ্গ টানেন।
তিনি বলেন, ফায়ার ব্রিগেডের হাতে যে প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই, তা সাংবাদিকরাই বের করে এনেছিলেন। আবার সেই যন্ত্রপাতি যখন এল, তখন সাংবাদিকরাই দেখিয়ে দিলেন যে সেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহারের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ফায়ার ব্রিগেডের নেই।
“সংবাদমাধ্যম এটাও দেখাল, প্রথমে প্রশিক্ষণ দিয়ে তারপরই যন্ত্রপাতি কেনা উচিৎ ছিল,” বলেন তিনি।
কেবল বিপদ ঘটলে নয়, আসন্ন বিপদের কথা জানানোও যে সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব, সে বিষয়টি বলতে গিয়ে দুই দশক আগে ভূমিকম্প সতর্কতা নিয়ে নিজের করা একটি প্রতিবেদনের কথা তুলে ধরেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী।
নেপালে স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের খবর কীভাবে সামলেছেন তা তুলে ধরেন দেশটির সাংবাদিক রাই। নেপালের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা কাঠমান্ডু পোস্টের নিউজ কোঅর্র্ডিনেটরের দায়িত্বে আছেন তিনি। গত বছর নয় হাজার মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়া ওই ভূমিকম্পের পরদিন নেপালে শুধু এ পত্রিকাটিই প্রকাশ হয়েছিল।
তিনি বলেন, “এই মাত্রার ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতা আমাদের ছিল না। তবে সৌভাগ্যবশত আমাদের ইন্টারনেট সংযোগ ছিল।
“আমরা ছিলাম অনভিজ্ঞ। ওই ধরনের পরিস্থিতি কীভাবে সামলাতে হয় সে প্রশিক্ষণও আমাদের ছিল না। আমরা দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম; চেষ্টা করছিলাম সোশাল মিডিয়া থেকে খবর পেতে। তবে গোল বাধে সেসব তথ্যের সত্যতা নিয়ে। কিন্তু আমাদের অন্য কোনো উপায় ছিল না।”
সে সময় সফরে থাকা নেপালের প্রধানমন্ত্রী ওই দুর্যোগের খবর জানতে পারেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর টুইট থেকে।
“টুইটার, ফেইসবুক হয়ে উঠেছিল সংবাদের প্রধান উৎস, শুধু দরকার ছিল যাচাই করে নেওয়া। “
ঘটনার প্রথম ছবিটি একজন সিটিজেন জার্নালিস্টের কাছ থেকে এসেছিল জানিয়ে তিনি বলেন, আসলে কী ঘটেছে সে সম্পর্কে প্রথম ধারণা ওই ছবি থেকেই পাওয়া গিয়েছিল।
নিউ মিডিয়ার যুগে তথ্যের সত্যতা যাচাই এবং নৈতিক মানদণ্ড বজায় রাখাই ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’ বলে মত দেন রভেনা পরান।
অস্ট্রেলিয়ার এসবিএস ওয়ার্ল্ড নিউজের ইন্টারন্যাশনাল এডিটর ব্রায়ান জন টমসন তাদের দেশে অবৈধ অভিবাসীদের সংবাদ কীভাবে করা হয় তার একটি চিত্র তুলে ধরেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় চড়ে যারা অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছানোর চেষ্টা করে, ধরা পড়লে তাদের পাপুয়া নিউ গিনি ও নাউরুর বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠায় কর্তৃপক্ষ।
টমসন বলেন, সাংবাদিকরা যাতে নাউরুতে গিয়ে ক্যাম্পবাসীদের দুর্গতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করতে না পারে, সেজন্য কর্তৃপক্ষ ভিসা ফি ঠিক করে আট হাজার ডলার।
“যাদের কথা প্রকাশ হয় না, তাদের কণ্ঠ হয়ে ওঠাই আমাদের দায়িত্ব, আমাদের কাজ শিরোনামের চেয়েও বেশি কিছু। সংবাদমাধ্যমকে হতে হবে পরিবর্তনের বাহন।… আমাদের প্রতিবেদন হতে হবে মানবিক,” বলেন এই অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক।
সকালে এই কনফারেন্সের উদ্বোধন করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। যে কোনো সংকটের সময়ে পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হয় বলে সংবাদ পরিবেশনে সতর্ক থাকতে গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
এ ধরনের সঙ্কটের সময় নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশন থেকে বিরত থাকারও আহ্বান জানান প্রতিমন্ত্রী।
দিনব্যাপী এই কনফারেন্সে অন্যদের মধ্যে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান হাফিজ আহমেদ মজুমদার, আইসিআরসির প্রতিনিধি দলের প্রধান ইখতিয়ার আসলানভ, আইসিআরসির আঞ্চলিক জনসংযোগ উপদেষ্টা গ্রাজিয়েলা পিকোলি বক্তব্য দেন।