বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেছেন, “সেন্সরশিপ বা আমাদের স্বাধীনতার ওপর আঘাত যে সব সময় সরকার বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আসছে তা নয়। কর্পোরেট দুনিয়া এখানে বড় ক্রিমিনাল। যারা বিজ্ঞাপনে অনেক টাকা খরচ করেন, তাদের মাধ্যমে অনেক কিছুই হয়... কর্পোরেট পেশি যখনই গণমাধ্যমের শক্তির সঙ্গে লড়তে আসছে, প্রায়ই আমরা হেরে যাচ্ছি।”
তার মতে, স্বাধীনতা থাকা আর সেই স্বাধীনতার চর্চা করতে পারা ভিন্ন বিষয়। ব্যবসায়ী থেকে গণমাধ্যমের মালিক হয়ে যাওয়া অনেকেই নাগরিকদের প্রতি দায়িত্ব-সচেতন নন; যা থেকে সঙ্কটের সূচনা।
বিশ্ব মুক্ত সাংবাদিকতা দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার ঢাকায় ইউনেস্কো আয়োজিত এক সেমিনারে সভাপতির বক্তব্য দেওয়ার সময় এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন দেশের প্রথম ইন্টারনেট সংবাদপত্রের প্রধান সম্পাদক।
দিবসটি উপলক্ষে বিশ্বের শতাধিক দেশে ইউনেস্কো একসঙ্গে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে; মূল অনুষ্ঠানটি হয় ফিনল্যান্ডে।
ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে জাতিসংঘের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা-ইউনেস্কো, এমএমসি ও আইসিএস আয়োজিত এ সেমিনারে প্রধান তথ্য কমিশনার অধ্যাপক গোলাম রহমান ছাড়াও টিআইবির চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল আলোচনায় অংশ নেন।
তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, আজকের প্রযুক্তিনির্ভর পৃথিবীতে প্রায় সবাই এক একজন সংবাদ সংগ্রাহক ও পরিবেশক হয়ে উঠছেন। প্রায় সবাই এখন তথ্য ও সংবাদ প্রকাশ করতে পারেন, দিতে পারেন ভুল বার্তাও।
পেশাদার সাংবাদিকদের হাতে পরিচালিত মূল ধারার সংবাদমাধ্যম এবং সাধারণের শক্তিতে চলা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মধ্যে ভেদরেখা ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে আসার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন- এটি একই সঙ্গে ভালো ও খারাপ।
“এটা ভালো, কারণ অনেক বেশি মানুষ এখন সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে তাদের ভাবনার কথা জানাতে পারছেন, অর্থাৎ মত প্রকাশের স্বাধীনতার চর্চা করতে পারছেন।
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের মতো ‘মুক্ত গণমাধ্যমের’ দেশেও ফেইসবুকে বিক্ষোভের আহ্বান জানানোর কারণে দুই তরুণের সাজা হওয়ার ঘটনা তুলে ধরেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী।
তিনি বলেন, আজকের সময়ের প্রেক্ষাপটেও গণমাধ্যমের ওপর রাষ্ট্রের ‘নজর রাখার’ প্রয়োজন আছে। তা কেমন হওয়া উচিত- সে ব্যাখ্যাও তিনি অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন।
“যখন উগ্র ডানপন্থিরা একটি চরম পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়, তখন রাষ্ট্রকে নির্দিষ্ট কিছু সংবাদ মাধ্যমের নির্দিষ্ট কিছু কর্মকাণ্ডের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয়। দুঃখজনক বিষয় হলো, রাষ্ট্র কেবল তখনই হস্তক্ষেপ করে, যখন সরাসরি সরকারের স্বার্থে আঘাত আসে। সমাজে শান্তি রক্ষায় যুগ যুগ ধরে ভূমিকা রাখছে- এমন কোনো মূল্যবোধ যখন আক্রান্ত হয়, তখন রাষ্ট্র কোনো পদক্ষেপ নেয় না।”
তিনি বলেন, ফেইসবুকে প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করে কেউ লিখলে যতোটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, ধর্মের নামে বা সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ালে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
“রাষ্ট্র কীভাবে গণমাধ্যমের দেখভাল করতে পারে সে বিষয়ে আপনি যদি তথ্যমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেন, হয়তো তিনি হা করে তাকিয়ে থাকবেন। তিনি হয়তো মনে করেন, তার মূল কাজ হলো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা, যাতে সংবাদের শিরোনাম পাওয়া যায় এবং চাকরি আরও পোক্ত হয়।”
তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, বাংলাদেশে যখন থেকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, তখন থেকেই সরকার কেবল নিজেদের ‘স্বার্থ রক্ষার’ চেষ্টা করে গেছে। এ কাজটি করার ক্ষেত্রে কখনোই দূরদৃষ্টির পরিচয় দেওয়া হয়নি।
“২০০১-০৬ সালে খালেদা জিয়ার সময়ে যেসব টেলিভিশন স্টেশনের জন্ম হয়েছিল, তারা ২০০৭ সালে খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার হওয়া থেকে বাঁচাতে পারেনি।
“সেসব টেলিভিশনের মালিক, ব্যবস্থাপক সবাই সুর বদলে ফেলেছিলেন, কারণ আগে নিজের পিঠ বাঁচানো জরুরি।”
জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালায় সশস্ত্রবাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ‘ভাবমূর্তি’ রক্ষার জন্য নিষেধাজ্ঞার ধারা যুক্ত করারও সমালোচনা করেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী।
তিনি প্রশ্ন রাখেন, “তারা কি রাষ্ট্রের অংশ নয়? প্রধানমন্ত্রী কি রাষ্ট্রের চেয়ে বড়? সশস্ত্রবাহিনী কি রাষ্ট্রের চেয়ে বড়?”
সম্প্রতি চট্টগ্রাম নৌঘাঁটির ভেতরের একটি ঘটনা নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর তা সরিয়ে নিতে চাপ দেওয়া হয় জানিয়ে এই সম্পাদক বলেন, অন্যরা সরিয়ে নিয়েছে এই যুক্তি দিয়ে তাকেও ওই খবর তুলে নিতে বলা হয়েছিল।
এ ধরনের কাজের মধ্য দিয়ে সশস্ত্র বাহিনী নিজেরাই নিজেদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে বলে তৌফিক ইমরোজ খালিদী মনে করেন।
তিনি বলেন, “একজন নোবেল বিজয়ীর ভাবমূর্তি কি রাষ্ট্র বা সমাজের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ? একজন সম্পাদক একবার বলার চেষ্টা করেছিলেন, মুহাম্মদ ইউনূস এতটাই বড় যে তার বিরুদ্ধে কিছু লেখার ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক থাকা উচিত। আমরা অনেকে এতটাই সতর্ক হয়েছি যে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনও পড়ে দেখিনি।
“ওই প্রতিবেদন পড়লে বোঝা যায়, গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় কী ধরনের বিশৃঙ্খলা চলছিল, আর সে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল সরকারের কেউ অভিযোগ তোলার বহু আগে।”
এমন পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রশ্নে কেবল সরকারকে দোষ দেওয়া যায় কিনা- সেই প্রশ্ন তোলেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী।
“সরকার আমাদের বলছে সরকারের বিরুদ্ধে না লিখতে। আর একজন সম্পাদক আমাদের এমন একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে লিখতে নিষেধ করছেন, যাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি একটি রাজনৈতিক দল খোলার ছক এঁকেছিলেন। সমস্যা এই মিডিয়ার ভেতরেও আছে।”
তিনি মনে করেন, সরকার বা রাষ্ট্র ‘যেভাবে’ গণমাধ্যমকে চালাতে চায়, রাজনীতিবিদরা ‘যে প্রক্রিয়ায়’ তাদের বিশ্বস্ত মালিকদের মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান- সমস্যার মূল সেখানে।
“রাজনীতিবিদরা যদি চান যে সব গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যম এমন ব্যবসায়ীদের মালিকানায় যাক বা এমন ব্যক্তিদের মাধ্যমে পরিচালিত হোক- যাদের কাজ কারবার নিয়ে প্রশ্ন আছে, তাহলে গণমাধ্যমের খুব বেশি কিছু করার নেই। অনেক মালিকেরই রাজনৈতিক উচ্চাশা রয়েছে, তারা সাংসদ হওয়ার জন্য দলীয় মনোনয়নও আশা করেন। তাদের অনেকের ট্যাক্স ফাইলেও সমস্যা আছে...।”
আর এসব ক্ষেত্রেই মালিকদের ‘সেলফ সেন্সরশিপের’ বিষয়টি চলে আসে বলে মনে করেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী।
তিনি বলেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়টি সরাসরি গণমানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত। সুতরাং সব ধরনের আক্রমণ থেকেই এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হবে- তা ‘সরকারি-বেসরকারি যে দিক থেকেই’ আসুক।