নবজন্মে মুর্তজা বশীর

পরিচয় শুধু তার ক্যানভাস নয়। তবে ক্যানভাসের প্রতিটি ছোঁয়ায় তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। তাই বলে ছবির ফ্রেমে বেঁধে রাখা যায়নি তাঁকে। কালির পরশ ছড়িয়েছেন পাতায়, শিল্প কিংবা ইতিহাসের আকড় খুঁজে ফিরেছেন বিশ্ব সংসারে।

শরীফ আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Sept 2014, 08:02 AM
Updated : 14 Sept 2014, 08:02 AM

আর তাই মানুষ তাকে চিনতে পেরেছে একাধারে চিত্রশিল্পী, শিল্পকলার শিক্ষক, কবি, ঔপন্যাসিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিল্পনির্দেশক, গবেষক ও মুদ্রাতত্ত্ব বিশারদ হিসেবে। যাকে নিয়ে এই আলোচনা তিনি আর কেউ নন শিল্পী মুর্তজা বশীর।

গেলো মাসেই ৮৩তে পা রেখেছেন। যদিও কয়েক মাস আগে থেকেই শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি হওয়ায় আগের মতো আর কাজ করতে পারছেন না। তবে এরপরও বরাবরের মতোই চমক রয়েছে এই ভাষা সৈনিকের কাছে।

১২ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার রাজধানীর উত্তরার গ্যালারি কায়ায় শুরু হয়েছে তাঁর একক চিত্র প্রদর্শনী ‘আ কালেকশন অফ ড্রয়িংস, কোলাজেস অ্যান্ড অয়েল প্যাস্টেলস (১৯৫৪–২০১৪)’। প্রদর্শনীতে মোট ৪৬টি শিল্পকর্ম রয়েছে।

শিল্পীর সাম্প্রতিক অসুস্থতার সময়ে জানা গিয়েছিলো, চিকিৎসকের বারণ রয়েছে তেল রং নিয়ে কাজ করবার ব্যাপারে। তাই বলে হতাশ হতে হবে না। বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের অন্যতম এই পথিকৃত, শত প্রতিকুলতা জয় করে প্রদর্শনীতে হাজির করেছেন সাম্প্রতিক সময়ে করা দুটি তেল রংয়ের কাজ।

বরাবরই জানতাম শিল্পী মুর্তজা বশীরকে কখনও একই বৃত্তের মাঝে আবদ্ধ করা যায়নি। বিশাল ক্যানভাসে করা এই কাজ দুটি দিয়ে শিল্পী আবারও জানান দিলেন, এখনও সমাজকে বহু কিছু দেওয়ার আছে তার।

নব্বইয়ের দশকের উত্তাল সময়ে করা কয়েকটি কাজ দেখতে পাওয়া যাবে এবারের প্রদর্শনীতে। কোলাজ করতে গিয়ে ডিকন্সট্রাকশনের মধ্য দিয়ে শিল্পী তুলে ধরেছেন তার যুদ্ধবিরোধী চেতনা। এছাড়া তার কোলাজের মধ্য খুঁজে পাওয়া যাবে বতিচেল্লির প্রতি শ্রদ্ধা, কিংবা নারীর প্রতি সমসাময়িক সমাজের রুক্ষ আচরণকে প্রশ্ন করা তীব্র ঘৃণা। সেসময়ে আকার সরঞ্জামাদির সংকটের মধ্য দিয়েই করা অপ্রদর্শিত এমন ৯টি কোলাজ রয়েছে এবারের আয়োজনে।   

কালীঘাট কিংবা আমাদের স্থাপত্যে প্রভাব বিস্তার করা বাইজেনটাইনদের দিয়ে একসময় প্রভাবিত ছিলেন শিল্পী বশীর। পঞ্চাশের দশকে নিজের প্রথম দিককার আঁকাআঁকির এমন ১৩টি ড্রইং প্রদর্শনিতে তুলেছেন শিল্পী।

দেশ ও দেশের বাইরে করা এইসব কাজের মধ্য দেখা মিলবে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী থেকে শুরু করে মার্কিন মুলুকের শিল্পী জেরাল্ড, জন আর আইসল্যান্ডের কারি এর্কসনের। সহজ  সরল রেখা ও ফর্মের ব্যবহারে এই কাজগুলোতে যেন আমাদের এই এলাকাকে খুঁজে পাওয়া যায়। তবে আঞ্চলিকতার জন্য নয় বরং শিল্পপ্রেমী হিসেবেই আরেকবার প্রশ্ন জাগতে পারে, ঠিক চলচিত্রের মতোই কেন আমাদের চিত্রকলার নিজস্ব কোনো ভাষা আজও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি!     

শেষ ৮ মাসে করা ১৭টি অয়েল প্যাস্টেল ও ৫টি ড্রইং আছে প্রদর্শনীতে। অসাধারণ কিন্তু শিল্পীর বৈশিষ্ঠানুযায়ী সহজ ও সরল রংয়ের ব্যবহার আছে, বিভিন্ন সময়ে বেঁচে যাওয়া ক্যানভাসের অংশে করা এইসব অয়েল প্যাস্টেলে। শিল্পী-ঘনিষ্ঠ যে কেউ অবশ্য এইসব নারীচিত্রের সঙ্গে তাঁর প্রথম জীবনের রচনার একটা দূরবর্তী যোগাযোগ খুঁজে পেতেও পারেন। 
  
নবম শ্রেণিতে পড়বার সময় সাম্যের রাজনীতিতে আগ্রহ খুঁজে পেয়ে মুর্তজা বশীর বেছে নিয়েছিলেন এক আমৃত্যু সংগ্রামের জীবন। বিপ্লবের এই কঠোর ও বন্ধুর রাস্তাটা মাড়িয়ে বেরাচ্ছেন আজও। আর তা না হলে, ৮৩ বছর বয়সে গুরুতর শারীরিক সমস্যা নিয়েও, একক প্রদর্শনীর কাজ হাতে নেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।

কিছুদিন আগেই এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন— কালোত্তীর্ণ কোনও সৃষ্টি না থাকায়, এখনও হতাশা পেয়ে বসে তাকে।

অথচ সদাই আনন্দ খুঁজে ফিরে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে থাকতেই চেয়েছেন তিনি। তবে শিল্পীর এত দিনকার ভাবনা, সেইসঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ের এই সংকট কিংবা পুনর্জন্মকে আরও গুঢ়ভাবে জানতে একবার ঘুরে আসতেই হবে গ্যালারি কায়ার এই প্রদর্শনীতে।

চলবে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে মুর্তজা বশীরের এই অসামান্য শিল্প প্রদর্শনী।

গ্যালারির ঠিকানাঃ বাসা ২০, রোড ১৬, সেক্টর ৪, উত্তরা, ঢাকা।

ফেসবুক ইভেন্ট: https://www.facebook.com/events/335051293344338/

ছবিঃ ফায়হাম ইবনে শরীফ