জব্বারের বলিখেলা

জব্বারের বলিখেলা। শতবর্ষী পুরানো চট্টগ্রামের সার্বজনীন এক উৎসবের নাম। বাংলা পঞ্জিকার বৈশাখ মাসের ১২ তারিখে প্রতি বছরই ঐতিহাসিক লালদিঘী মাঠে এই আয়োজন করা হয়। খেলাকে ঘিরে লালদিঘী মাঠের আশপাশের সব এলাকাজুড়ে বসে বৈশাখি মেলা।

মুস্তাফিজ মামুনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 April 2014, 05:01 AM
Updated : 24 April 2014, 05:07 AM

জব্বারের বলিখেলার ইতিহাস বেশ প্রাচীন। ১৩১৬ বঙ্গাব্দের ১২ বৈশাখ। গ্রেগরিয়ান হিসাব মতে সনটি ছিল ১৯০৯। চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর এক কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন বেগবান করতেই তিনি এ খেলার সূচনা করেছিলেন বলে জানা যায়।

বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ আর বাঙালি যুবকদের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে আবদুল জব্বার এ বলিখেলার প্রবর্তন করেন। তার মৃত্যুর পরে এ খেলা পরিচিতি পায় জব্বারের বলিখেলা নামে। সেই থেকে প্রতি বছর একই তারিখে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ঐতিহ্যবাহী এ বলিখেলা।

এ বছর বসছে জব্বারের বলিখেলার ১০৫তম আসর। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের মানুষ একত্রিত হন অন্যতম এ সামজিক উৎসবে।

এ খেলা ঘিরেই চট্টগ্রাম অঞ্চলে সবচেয়ে বড় বৈশাখি মেলার আয়োজনও হয়। ১২ বৈশাখ, ২৫ এপ্রিল বলিখেলার মূল আসর বসলেও আগে পরে প্রায় সপ্তাহব্যাপী মেলা বসে চট্টগ্রামের লালদিঘী এলাকায়।

এখানকার বৈশাখি মেলার বিস্তৃতি আন্দরকিল্লা-মোড় থেকে লালদিঘীর চারপাশ, হজরত আমানত শাহ (রহ.)-এর মাজার ছাড়িয়ে জেলরোড, দক্ষিণে বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়িয়ে কোতোয়ালির মোড় এবং পশ্চিমে সিনেমা প্যালেস পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। বলতে গেলে চট্টগ্রাম অঞ্চলের অন্যতম পুরানো এবং বড় বৈশাখি মেলা।

নানান গ্রামীণ পণ্যের পসরা বসে এই মেলায়। চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গা থেকে কুটিরশিল্পীরা নিয়ে আসেন নানান পণ্য। যেমন: মাছ ধরার চাঁই, বেতের তৈরি চালুনি, তৈজসপত্র, মাটির তৈরি পুতুল, মাটির তৈরি খেলনা, ফুলদানি, তালপাখা, টব, হাঁড়ি-পাতিল, কাঠ-বাঁশ-বেতের তৈরি আসবাবপত্র, হাতপাখা, ঝাড়ু, কুলা, শীতলপাটি, মুড়ি-মুড়কি, নাড়ু, গাছের চারা, দা-বটি, বৈশাখি ফল, সবকিছুই পাওয়া যায় এ মেলায়।

তবে এককালে মেলায় যেমন লোকজ গ্রামীণ পণ্যের আধিপত্য ছিল, বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় সেই ঐতিহ্যে কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছে। মৃৎশিল্প কিংবা কারু-দারুশিল্পকে হঠিয়ে প্লাস্টিক-পণ্যও দখল করছে মেলা।

বেশ জাঁকজমকভাবেই বলিখেলার আয়োজন করা হয়। যারা খেলায় অংশ নেন তাদের বলা হয় ‘বলি’। প্রতি বছর প্রায় পঞ্চাশেরও বেশি ‘বলি’ এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। খেলা উপভোগ করতে আসেন হাজার হাজার দর্শনার্থী।

দুপুরের পরে শুরু হয় মূল খেলা। বলিরা একে একে লড়তে থাকেন। কয়েক পর্বের শ্বাসরুদ্ধকর লড়াই শেষে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় একজনকে।

ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়া সুদূর আরাকান অঞ্চল থেকেও ‘বলি’রা এ খেলায় অংশ নিতে আসতেন। অতীতকালে রাজা-বাদশা কিংবা জমিদারদের কাছে কুস্তিগীরদের কদর ছিল। বীরের মর্যাদা পেতেন তারা।

আধুনিক যুগে শত্রু দমনে নতুন নতুন অস্ত্র ব্যবহারের ফলে কমতে থাকে কুস্তিগীরদের কদর। অতীতের সেসব ঐহিত্য হারাতে বসলেও বৃহত্তর চট্টগ্রামের কিছু শৌখিন কুস্তিগীর বলিখেলার ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।

যেভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে সড়ক, রেল ও আকাশপথে চট্টগ্রাম যেতে পারেন। ঢাকার ফকিরাপুল, কমলাপুর, সায়দাবাদ থেকে গ্রিনলাইন, সোহাগ, সৌদিয়া, টি আর, হানিফ ইত্যাদি পরিবহনের এসি বাস চট্টগ্রাম যায়। ভাড়া ১ হাজার থেকে ১২শ’ টাকা।

এছাড়া এস আলম, সৌদিয়া, ইউনিক, শ্যামলী, হানিফ, ঈগল প্রভৃতি পরিবহনের নন এসি বাসের ভাড়া ৪৫০-৫৫০ টাকা।

রেলের সময়সূচী অনুযায়ী ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের পথে মহানগর প্রভাতী ঢাকা ছাড়ে সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে। চট্টলা এক্সপ্রেস সকাল ৯টা ২০ মিনিটে, মহানগর গোধুলী ঢাকা ছাড়ে বিকেল ৩টায়। সুবর্ণ এক্সপ্রেস ঢাকা ছাড়ে বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে। তূর্ণা ঢাকা ছাড়ে রাত এগারোটায়।

ভাড়া ১৬০ থেকে ১ হাজার ৯৩ টাকা। এছাড়া ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ইউনাইটেড এয়ার, রিজেন্ট এয়ার ও নভো এয়ারের বিমানে যেতে পারেন চট্টগ্রাম।

যেখানে থাকবেন

চট্টগ্রাম শহরে থাকার জন্য বিভিন্ন মানের বেশ কিছু হোটেল আছে। তবে এ ভ্রমণে থাকার জন্য লালদিঘী এলাকার কাছাকাছি জুবিলী রোড ও স্টেশন রোডের হোটেলগুলো ভালো হবে। জুবিলী রোডে মধ্যম মানের কিছু হোটেল হল: হোটেল টাওয়ার ইন, হোটেল সফিনা। স্টেশন রোডে হোটেল এশিয়ান, হোটেল সুপার ইত্যাদি।

এসব হোটেলে ৮শ’ থেকে ৪ হাজার টাকায় রাত যাপন করা যাবে।

আলোকচিত্র: সুমন বাবু