অথচ কাছেই চরাচর ঝাঁপসা করে বৃষ্টি হচ্ছে। আর সেই বৃষ্টি-মাথায় আমাদের ছোট্ট নৌকা এগিয়ে চলেছে ভারত সীমান্তবর্তী মেঘালয় পাদদেশের ঝুলন্ত ব্রীজের দিকে।
সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার একেবারে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এলাকায় খাসিয়া-জৈইন্তা পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে বালুভরা বেশ কিছু স্বচ্ছ পানির নদী। এরমধ্যে লোভা নদী অন্যতম।
পরদিন সিলেট শহর থেকে সকাল সকাল লোভার উদ্দেশ্যে যাত্রা। জকিগঞ্জের সে পথে আগে কখনও যাইনি। পথে কত গ্রাম, জনপদ আর মাঠ পেরিয়ে ভুল রাস্তা হয়ে অপরিচিত এক গ্রামে পৌঁছাই দুপুর ১২টায়। সেখানে আমরা ছোট্ট একটা বাজার পেয়ে পেট ভরিয়ে নেই।
এরপর স্থানীয় এক বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে রাস্তা চেনা হয়ে যায়।
আমরা সেই চেনা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলি। তবে পিচঢালা পথ ছেড়ে মেঠো পথে চলতেই চালক যাত্রা বিরতি টানেন। অতিরিক্ত কাঁদামাখা পথ। চালক আর সামনে এগোতে সাহস পেলেন না। কী আর করা, সিএনজি চালিত অটোরিকশা ছেঁড়ে পায়ে চলা সরু মেঠো পথে পা বাড়াই।
আমাদের সামনে এখন সুরমা নদী। দুরে মেঘালয় পর্বতমালা আর লোভা নদী। এবার আমাদের বাহন হবে নৌকা।
চলেছি পরিচ্ছন্ন সুরমা নদী দিয়ে। লোভার মুখ হচ্ছে সুরমা ও লোভা নদীর সঙ্গমস্থল। সুরমা নদী দিয়ে ইঞ্জিন চালিত নৌকা ছুটে চলে লোভাছড়া নদীর দিকে। একটা দুটা ইঞ্জিন চালিত নৌকা হঠাৎ হঠাৎ ঢেউ খেলিয়ে চলে যাচ্ছে। দূরে পাহাড়ের বুকে সুর্যের আলো। এসব মিলিয়ে যেন আমাদের এক অচিন দেশ ভ্রমণ।
সুরমা পেরিয়ে আমাদের যাত্রা লোভায় শুরু হতেই নিজেদের মধ্যে অনুভব করি এক চঞ্চলতা। সামনে এমন মনোরম রংয়ে আঁকা সৌন্দর্য দেখলে চঞ্চলতা তো আসবেই। সঙ্গে বেশ জোর হাওয়া চারিদিক ছড়িয়ে আমাদের নৌকায় আছড়ে পড়ল, আছড়ে পড়ল আমাদের চোখে মুখে।
বিকাল ঘনিয়ে আসায় ভারত সীমান্তের ঝুলন্ত সেতুর পথ ছেড়ে আমরা লোভাছড়া চা বাগানের দিকে নৌকা ঘুরাই। মধ্যে বাগানবাজারে চা পানের বিরতি দিয়ে আবার এগিয়ে চলে আমাদের জলভ্রমণ।
এবার নৌকা চলছে লোভাছড়া চা-বাগানের পাশ দিয়ে বয়ে চলা খাল দিয়ে। দুপাশে গজিয়ে ওঠা জঙ্গল দেখে আঁকাবাঁকা জলপথ ধরে যখন আমরা ১৯২৫ সালে নির্মিত লোভাছড়া চা-বাগানের ঝুলন্ত সেতুর কাছে পৌঁছাই তখন গোধূলি বেলা। আমাদের চোখ দুটো যেন ধাঁধিয়ে গেল।
এমন চোখ ধাঁধানো গোধূলিতে আমাদের উচ্ছ্বাস আনন্দ চোখে দেখার মতো। সত্যি বলতে কী, এমন গোধূলি বেলা আজীবন মনে থাকবে!
লোভা নদী আর লোভাছড়া চা বাগান যেতে হলে সিলেট শহর থেকে যাত্রা শুরু করতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনার গন্তব্য হবে কানাইঘাট।
আমরা কানাইঘাট ঘুর পথে গিয়েছিলাম। সিলেট থেকে যাত্রা শুরু করে গোলাপগঞ্জ, চারখাই আর শাহবাগ পেছেনে ফেলে জকিগঞ্জের পথ ধরে কানাইঘাট উপজেলার লোভার মুখ পৌঁছাই। তারপর নৌকা ভাড়া করে সুরমা নদীর ওপর দিয়ে লোভা নদী ঘুরে লোভাছড়া চা বাগান।
তবে সহজ পথ হচ্ছে দরবস্ত-চতুল হয়ে কানাইঘাট সদর। তাছাড়া গাজী বোরহানউদ্দিন সড়ক ধরে গাছবাড়ি হয়েও কানাইঘাট সদর পৌঁছানো যায়।
যেভাবেই যান লোভা নদীতে তো বেড়াবেনই। দেখবেন লোভাছড়া চা বাগান। লোভা নদী ও আশপাশের সৌন্দর্য স্বর্গীয়। সারা বছরই এখানে বেড়ানো যায়। তবু বর্ষায় লোভা নদীর মজাই আলাদা। আর বৃষ্টির দিন হলে তো কথাই নেই। সে জন্য অক্টোবর পর্যন্ত লোভানদী ভ্রমণ অসাধারন।
বাস, মাইক্রো বা সিএনজি চালিত অটোরিকশায় যেতে পারেন কানাইঘাট। তারপর নৌকায় ঘুড়ে বেড়াবেন মনোরম লোভায়। চা বাগান হয়ে ফিরতি পথ ধরা! কানাইঘাট বাজার ছাড়া খাবারের ভালো ব্যবস্থা নেই। নৌকায় উঠলেই পেটে টান ধরবে। সুতরাং সঙ্গে পর্যাপ্ত খাবার নিয়ে নেবেন!
ছবি: লেখক।