নামি ফুলগুলোর মধ্যে অন্যতম ব্রাউনিয়া ককসিনিয়া বা পাখিফুল, বসন্ত ঋতুর ফুল। দেখতে খুব সুন্দর, গাছের সবুজ পাতার ওপর গোলাকার লাল। প্রথম দেখায় মনে হবে ফুল নয় যেন আমাদের জাতীয় পতকা। গুচ্ছে গুচ্ছে সারা গাছে ফোটা পাখিফুল দেখতে বলধা গার্ডেনের উদ্দেশ্যে এক সকালে পথে নামলাম।
পথ চলতে খ্রিষ্টান কবরস্থান সামনে পড়ে যাওয়ায় একবার ঢুঁ মারলাম সেখানে, তারপর বলধায় গিয়ে হতাশ। সিবিলি ভাগে পাখিফুল গাছটি আছে, ফুল নেই। কি আর করা, সাইকি ভাগে এসে এক ঘণ্টা একা একা কাটালাম। খুব যে ভালো সময় কাটল তা বলা যাবে না।
কিছুটা হতাশ মনে আবার পথে নামলাম। কী এক আনমনে চলে এলাম কেএম দাস রোড, টিকাটুলি।
সাইনবোর্ডে কেএম দাস রোড লেখা দেখে বুঝলাম, আনমনে হলেও অবচেতন মন আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! টিকাটুলির কেএম দাস রোড ঢাকার দুটি বিখ্যাত ঘটনার সাক্ষী।
দ্বিতীয়টি সেই রোজ গার্ডেনেই. ১৯৪৯ সালে গঠিত হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। অজান্তে আমি আজ চলেছি সেই রোজ গার্ডেনে। আপনারাও চলুন আমার সঙ্গে!
রোজ গার্ডেন'য়ের ইতিবৃত্ত
হৃষিকেশ দাস ঢাকার একজন জমিদার ছিলেন। পুরান ঢাকার শ্যামবাজারের রূপলাল দাসের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিল কিনা তা আমার জানা নেই। তবে টাকা পয়সা ছিল অনেক, তবু তাকে সে সময়কার গণ্যমাণ্য এলাকাবাসিরা পাত্তা দিত না।
ঐতিহাসিকদের মতে, হৃষিকেশ দাস একদিন বলধা গার্ডেনে গিয়েছিলেন বলধার জলসা ঘরের জলসা দেখতে। তবে প্রচণ্ড অপমানিত হয়ে তাকে ফিরে আসতে হয়। শোনা কথা, রূপলাল বাবু যেমন আহসান মঞ্জিল দেখে রূপলাল হাউস বানিয়েছিলেন, তেমনি হৃষিকেশ বাবু বলধা গার্ডেনের জলসায় অপমানিত হয়ে বানালেন প্রাসাদসম রোজ গার্ডেন।
১৯৩১ সালে সেই গোলাপ রেখে পেছনে কারিনিয়ান পিলার ঘেরা প্রাসাদসম যে ভবন নির্মাণ হয়, সেটিই কালে কালে রোজ গার্ডেন হিসেবে খ্যাতি লাভ করে।
হৃষিকেশ দাস ভবন নির্মাণের অল্প কিছু দিন পর অর্থাভাবে পড়লে সেটি বিক্রি করে দেন ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদের কাছে। এখনও ভবনটির গায়ে আব্দুর রশিদের নাম খোদাই করা দেখতে পাওয়া যায়।
বিখ্যাত প্রভিন্সিয়াল লাইব্রেরি এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়, যার মালিক ছিলেন ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদ।
১৯৬৬ সালে আব্দুর রশিদের ভাই কাজী হুমায়ূন ভবণের মালিকানা লাভ করেন। তারপর থেকে ভবনটির নাম হুমায়ূন সাহেবের বাড়ি নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠে।
ততদিন আর কাজী হুমায়ূন বেঁচে ছিলেন না, ভবনটির মালিকানা পান তার বংশধর কাজী রকিব।
বর্তমান রোজ গার্ডেন
হুমায়ূন সাহেবের বাড়ি আর বেঙ্গল ষ্টুডিও যাই বলা হোক না কেনো, ভবনটি কিন্তু রোজ গার্ডেন নামেই বিখ্যাত।
প্রবেশ পথে শ্বেতপাথরে রোজ গার্ডেন স্পষ্ট লেখা। ১৯৮৯ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর রোজ গার্ডেনকে সংরক্ষিত ভবন হিসেবে ঘোষণা দিলেও পরে ভবনটির মালিকানা মূল মালিকরাই ফিরে পান। তারপর থেকেই ভবনটির দেখভাল চলছে কাজী রাকিব পরিবারের তত্ত্বাবধানে।
গোলাপের জন্য ভবনটির নাম রোজ গার্ডেন হলেও এখন রোজ গার্ডেনে গোলাপ খুব কমই দেখা যায়। তবে মৌসুমি ফুলের অভাব নেই। আমি যখন রোজ গার্ডেনে পৌঁছি তখন দুপুর প্রায়। আনমনে পুরান ঢাকার অলিগলির ডানবাম করে ভবনটিতে প্রবেশ করে প্রথম দিনের মতোই বিস্মিত হই। সেই সাদা রঙা বিশাল অট্টালিকা বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে।
যাহোক, বাগানের মধ্যেখানে একটি কৃত্রিম ফোয়ারা ছিল, যা এখনও আছে তবে মৃত প্রায়। ফোয়ারা দিয়ে আগের মতো পানি বের হয় না, বলা যায় নষ্ট হয়ে গেছে। আনিস ভাইকে সঙ্গে নিয়ে বা আনিস ভাই নিজে আমার সঙ্গে থেকে রোজ গার্ডেন পুরোটা ঘুরিয়ে দেখান।
ওপরের বা দোতলার নাচ ঘর, নিচের বৈঠকখানাসহ ওপর নিচের মোট ১৩টি ঘর, আর শ্বেত পাথরের মূর্তি। পেছনের ভবন, আর কর্মচারীদের থাকার কক্ষ। রোজ গার্ডেন লাগোয়া যে বাড়িটি সেখানে থাকেন কাজী রাকিব পরিবার। পুরানো দিনের অনেক সিনেমা লক্ষ্য করলে রোজ গার্ডেনের সঙ্গে এই বাড়িটিও নজরকারে।
দেশের যে প্রান্তেই থাকুন, ঢাকার গুলিস্তান বা যাত্রাবাড়ি চলে আসুন। তারপর রিকশায় টিকাটুলির কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেন। রোজ গার্ডেন বেশি কেতাবি হয়ে যাবে। রিকশাওয়ালাকে বলতে হবে হুমায়ূন সাহেবের বাড়ি।
রোজ গার্ডেন থেকে অল্প দূরত্বে বলধা গার্ডেন, পাশেই খ্রিষ্টান কবরস্থান। তাছাড়া পুরান ঢাকার অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলো তো আছেই।
রোজ গার্ডেন দেখতে হলে ছুটির দিন বাদে অন্য যে কোনো দিন বের হতে হবে। বন্ধের দিন রোজ গার্ডেন প্রবেশাধিকার নেই। পুরান ঢাকায় এলে শুধু তো রোজ গার্ডেন নয়। রোজ গার্ডেনসহ পুরান ঢাকার অনেক প্রাচীন স্থাপনা দেখে তবেই ফেরা ভালো। সঙ্গে খেয়ে নেবেন পুরান ঢাকার বিখ্যাত সব খাবার!