অগ্রাধিকার নাকী সম অধিকার

‘নারী-পুরুষের সম অধিকার’ বিষয়টি নিয়ে অনেকের মাঝেই দ্বন্দ রয়েছে। সুযোগ নেওয়া আর সুযোগ করে দেওয়ার মধ্যে রয়েছে মোটা দাগের পার্থক্য।

তৃপ্তি গমেজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 March 2017, 08:15 AM
Updated : 8 March 2017, 10:43 AM

এ বছর নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘নারী-পুরুষ সমতায় উন্নয়নের যাত্রা, বদলে যাবে বিশ্ব কর্মে নতুন মাত্রা’।

তবে এই ‘সমতা’র সীমারেখা কোথায় শুরু আর কোথায় শেষ! সেটা জানতেই আমরা কথা বলেছিলাম বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ও কর্মজীবী নারীদের সঙ্গে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী মাহফুজা রিতু মনে করেন, সমাজে নারী-পুরুষ সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা হওয়া প্রয়োজন। যে কোনো সমাজকে এগিয়ে যেতে হলে অবশ্যই নারীদের ঘর থেকে বের হয়ে এসে পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে।

সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে নারী কোটা বা নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন কোনো অন্তরায় কিনা তা জানতে চাইলে রিতু বলেন, “কখনই এটি অন্তরায় না। বহুকাল ধরে নারী ঘরের গণ্ডি থেকে বের না হওয়ার কারণে তাদের মনের মধ্যে নিজেরদের সম্পর্কে অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে এবং এর প্রভাব পড়েছে সমাজ জীবনেও।”

ব্যাখ্যা দিতে তিনি বলেন, “সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নারী পুরুষ দুজনকেই একযোগে কাজ করতে হবে। যেহেতু নারীরা অনেকটাই পিছিয়ে আছে তাই তাদের সামান্য সুযোগ যেমন- গাড়িতে সিট সংরক্ষণ করে, চাকুরিতে অগ্রাধিকার দেওয়া, ছুটি মঞ্জুর ইত্যাদির মাধ্যমে ঘরের গণ্ডি থেকে বেড়িয়ে আসতে সাহায্য করতে হবে। বর্তমানে সামান্য সুযোগ পেলে নারী নিজেকে যোগ্যভাবে গড়ে তুলতে পারবে। তখন আর আলাদাভাবে নারীকোটার প্রয়োজন হবে না।”

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের এমবিএ’র শিক্ষার্থী ভিক্টর গমেজ মনে করেন, নারী পুরুষ সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে অবশ্যই নারীদের সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। এই সুযোগ তাদের অনেক দূর আগাতে সাহায্য করবে। তবে সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি এমনভাবে উপস্থাপন করা হবে যেন তা সকলের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয় কখনও যেন বৈষম্য মনে না হয়। উদাহরণ স্বরূপ- গাড়িতে মহিলা আসন সংরক্ষিত থাকায় তা নিয়ে প্রায়ই ঝামেলা হয়।

ঝুঁকি নিয়ে বাসে উঠছেন অফিসগামী নারী। গণপরিবহন নিয়ে নারীদের ভোগান্তির অভিযোগ বহুদিনের। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ভিক্টরের মতে, মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৯টি কথাটি লেখা না থেকে যদি ‘মা বোনদের আগে বসতে দিন’ এমন ধরনের কিছু লিখা থাকে তাহলে তা সকলের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হবে। ফলে ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে।

আয়েশা সিদ্দিকা, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের একজন ছাত্রী। তার মতে, নারীরা যে নারী অধিকারের লক্ষ্যে সচেষ্ট তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্যেরটা শুনে, খুব কম নারীই বিষয়টা সম্পর্কে জ্ঞাত।

তিনি বলেন, “নারীদের কোথায় আসলে সম-অধিকার দাবি করা উচিত আর কোথায় অগ্রাধিকার সে বিষয়ে তারা অবগত নয়। একজন নারী চাইলেই পুরুষের মতো বোঝা টানতে পারবে না, বাসে দাঁড়িয়ে থেকে যাতায়াত করা তার জন্য অনেক বেশি কঠিন। আবার নারীরা কর্ম ক্ষেত্রে কোটা পেয়ে থাকেন, মাতৃত্বকালীন ছুটি পেয়ে থাকেন ইত্যাদি। বিষয়গুলোতে দেখা যায় নারী সম-অধিকার নয় বরং অগ্রাধিকার পাচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, “আমার মতে নারীদের নিজেদের অবস্থান ও দাবি সুপষ্টভাবে উল্লেখ করে কোন কোন ক্ষেত্রে সম-অধিকার চাওয়া হচ্ছে তা বলা উচিত। যতই সম-অধিকারের কথা বলা হোক না কেনো, আসলে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে নারীর স্বাধীন মতামত দান, সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীনতার মতো বিষয়ে সমতা অর্জন করতে হবে তা না হলে অন্যান্য সুবিধা কেবল ‘সুযোগ’ হিসেবেই দেখা হবে।”

নারীরা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়ে অতিরিক্ত সুবিধা ভোগ করে থাকে যাতে পুরুষদের স্বাভাবিক চলাফেরা অধিকার অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমনটাই মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমআইএস বিষয়ের এমবিএ’র শিক্ষার্থী শাহারিয়ার শাওন।

তার মতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে তা গ্রামগঞ্জে করা উচিত। যেখানকার নারীরা সত্যিকার অর্থেই অধিকার বঞ্চিত। শহরাঞ্চলে নারীরা সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা বলতে কেবল অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়াকেই মনে করে। যে কোনো লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অথচ কোনো মহিলা সিরিয়াল না মেনেই লাইনে দাঁড়িয়ে যায় এবং মহিলাদের এই অগ্রাধিকারের সুযোগ নেয় তার পরিবারের লোকেরা (পুরুষেরা)।

যেমন- একজন মহিলাকে লাইনে দাঁড় করিয়ে সিরিয়াল নেয় এবং ঠিকই সুযোগ মতো তারাও লাইনে দাঁড়িয়ে যায়। এটা কেবল একটি বিষয়, এমন আরও অনেক আছে। শহরে অনেক নারী অবাধ চলাফেরাকে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা বলে মনে করে। আবার বাসে ওঠার বা বসার ক্ষেত্রে সুবিধা প্রাপ্তিকেও সম-অধিকার বলে মনে করে।

শাওন আরও বলেন “সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন করে, এটাতো আসলে সম-অধিকার হল না। সমতা আনতে হলে আগে গ্রামের নির্যাতিত নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে, শহরে এসিরুমে বসে ‘সম অধিকার, সম অধিকার’ বলে মাতামাতি করা কখনই নারীপুরুষ সমতা আনার ক্ষেত্রে কার্যকর নয়।”

কর্মজীবী নারীরা ঘরে বাইরে পরিশ্রম করেন। পরিবারের উৎসাহ ও সহযোগিতা না থাকলে একসঙ্গে দুই কাজের ভারসাম্য রক্ষা করা খুবই কষ্টকর।

‘উইম্যান রাইটস অ্যান্ড জেন্ডার ইকুয়েটি বাংলাদেশ’য়ের ম্যানেজার কাশফিয়া ফিরোজ এই বিষয়ে বলেন, “বাসা থেকে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য বের হওয়ার সময় পুরুষদের চিন্তা থাকে একরকম আর নারীদের চিন্তা থাকে ভিন্ন রকম। পুরুষরা সাধারণত ঠিক সময়ে কর্মক্ষেত্রে পৌঁছাতে পারবে কিনা, রাস্তার দুর্ঘটনার ঝুঁকি, ছিনতাই ইত্যাদি বিষয় মাথায় থাকে। আর নারীদের ক্ষেত্রে এই সকল চিন্তার পাশাপাশি বাসার চিন্তা, সন্তান ও সংসারের চিন্তা মাথায় রাখতে হয়। আবার বাসায় ফিরে ঘরের কাজের পাশাপাশি পরের দিন অফিসের নানা ধরনের কাজের পরিকল্পনাও করতে হয়। যেহেতু সবসময় এমন চাপে থাকতে হয় সেক্ষেত্রে পরিবারের সহযোগিতা খুবই প্রয়োজন।”

বাংলাদেশের নারীদের অগ্রযাত্রার অন্যতম উদাহরণ ট্রেনচালক সালমা খাতুন। ২০০৪ সালে প্রথম নারী লোকো মাস্টার হিসেবে রেল বিভাগে যোগ দেন তিনি। ৭ বছর একাই ছিলেন, এখন নারী চালক ১৫ জন। মঙ্গলবার কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে তোলা হয় সালমার এই ছবি। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক

তিনি আরও বলেন, ‘কর্মজীবী মায়েদের সন্তানরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেশ সচেতন হয়ে থাকে। ছোট থেকেই নিজেদের কাজ নিজেরা গুছিয়ে করার প্রবনতা তাদের মধ্যে দেখা যায় যেমন- নিজের টিফিন গুছিয়ে নেওয়া, নিজে নিজে নাস্তা করা ইত্যাদি।”

‘কন্সার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড’য়ের পুষ্টি পরামর্শক আসফিয়া আজিম শাওন তার পরিবার ও কর্মজীবনে ভারসাম্য রক্ষা প্রসঙ্গে বলেন, “একই সঙ্গে ঘর ও বাহির সামাল দেওয়া বেশ কঠিন কাজ, মাঝে মাঝে এই দুইয়ের মাঝে যে কোনো একটিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হয়। যেমন- অফিসের কাজের জন্য বাইরে থাকার কারণে অনেক সময় স্বামী-সন্তানের ঠিকঠাক যত্ন নেওয়া যায় না, সন্তানদের স্কুলে নেওয়া, হাতে ধরে সন্তানকে পড়ানো বা পরিবারের অন্যান্য কাজ থেকে দূরে থাকতে হয়। এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার করার জন্য পরিবারের সাহায্য খুবই প্রয়োজন।”

তিনি আরও বলেন, “আমার স্বামীও খুব ব্যস্ত মানুষ। তারপরও আমি অফিসের কাজে শহর বা দেশের বাইরে থাকলে সে (স্বামী) সন্তাদের দেখাশুনা করেন, তাকে কাজে উৎসাহিত করেন। একজন নারীর এগিয়ে যাওয়ার পেছনে এই উৎসাহটা অনেক বড় অবদান রাখে।”

আসফিয়া আজিমের মতে, কর্মজীবী মায়েদের সন্তানরা সাধারণত বেশি স্বাবলম্বী হয়ে থাকে। তারা নিজের কাজ সম্পর্কে বেশ সচেতন হয়। আর কর্মজীবী বাবা-মায়েরা যেহেতু তুলনামূলকভাবে সন্তানকে কম সময় দেয় তাই তারাও চায় সন্তানদের গুণগত সময় দিতে।

নন্দা রাণি বসাক, পাবনা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রভাষক কর্মজীবী নারীদের নানা প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে বলেন, “কর্মজীবী নারীদের দোষ ত্রুটি বরাবরই বেশি ধরা হয়। সবসময় তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলা হয় ‘তুমি বাইরে কাজ কর’ অর্থাৎ তাদের যে কোনো ভুল ত্রুটির জন্য দায়ী করা হয় তাদের পেশাগত জীবনকে। আবার অফিসে যেতে দেরি হলে বা অফিসের কোনো কাজে ভুল ধরা পড়লে সেখানেও শুনতে হয়, ‘মহিলা বলে সুযোগ নিচ্ছি’। এই ধরনের কথা বার্তা একজন নারীর জন্য খুবই পীড়াদায়ক।”

কর্মজীবী নারীরা বিয়ের পর স্বামীকে সময় দিতে চাইলে বা কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চাইলে সেখানেও আঙ্গুল তোলা হয় তার কর্মক্ষেত্রের দিকে, বলা হয়- ‘তুমি তো কাজ কর, তোমার তো সময় নাই।’ ঘরের কাজে কোনো ত্রুটি থাকলে বাইরে কাজ কর বলে ঘরের কাজকে গুরুত্ব দেয় না এমন কথাও শুনতে হয় বলে জানান তিনি।

সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে নারীর স্বাধীন মতামত দান, সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীনতার মতো বিষয়ে সমতা অর্জন করতে হবে তা না হলে অন্যান্য সুবিধা কেবল ‘সুযোগ’ হিসেবেই দেখা হবে। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক

নন্দা রাণির মতে, ঘর ও অফিসের কাজের ভারসাম্য রাখতে পরিবারের সকল সদস্য- মা, বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী সকলের সহযোগিতার প্রয়োজন আছে। যাদের সন্তান আছে তাদের জন্য পরিশ্রমটা অনেক বেশি। পরিবারের সাহায্য না পেলে বাধ্য হয়ে অনেককে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়।

তিনি বলেন, “আমাদের সমাজে কর্মজীবী মেয়েদের অবস্থা ‘তেজপাতার’ মতো। কোনো ক্ষেত্রেই তারা সম্পূর্ণ মিশে যেতে পারে না। শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ি অথবা অফিস সব জায়গাতেই তাদেরকে মানিয়ে চলতে হয়। এরপরও তাদের নানা দোষ ধরা হয়। পরিবারে সন্তান যদি ভালো কিছু করে তবে সব প্রশংসা হয় সন্তানের বাবার কিন্তু সন্তানের সামান্য দোষত্রুটির জন্য দায়ী করা হয় মাকে, আর মা যদি চাকুরিজীবী হয় তাহলে তো কথাই নেই।”

একটা কথা প্রচলিত আছে- এই দেশে নারীর অধিকার যে কতটুকু তা বাসে উঠলেই বোঝা যায়। আসলে নারী পুরুষের সমতা আনতে হলে- নারীদের যেমন বুঝতে হবে সম-অধিকার আর আগ্রাধিকারের পার্থক্য, তেমনি পুরুষদেরও মাথায় রাখতে হবে নারীও মানুষ।