কলকাতার অলিগলি

কেনাকাটা আর পরিচিত জনপ্রিয় এলাকাগুলো ছাড়া কলকাতার আসল স্বাদ নিতে নামতে হবে রাস্তায়। এই প্রাচীন শহরের একেকটি গলি একেকটি গল্প।

লাইফস্টাইল ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Dec 2016, 11:50 AM
Updated : 6 Dec 2016, 11:57 AM

এভাবে বেড়িয়ে অন্যরকম অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদক সাজিদুল হক। সেই অভিজ্ঞতাই তিনি মেলে ধরেছেন এখানে।

“সেখান থেকে একটু দূরে ছাদের পাঁচিলটা ঘুরে/এক চিলতে রোদ্দুরেতে ছোট্ট মেয়ে নামতা পড়ে/ তাই তো কালো ইঁটের ফাঁকে বট পাতাটা জিভ ভ্যাংচায়/....এখানটাতেই আটকে পরা এখানটাতেই ঘুরোঘুরি/ এখানটাতেই আমার বাসা আমার বাড়ি...” অঞ্জন দত্ত এভাবেই তার পাড়া, তার কলকাতার বর্ণনা করেছেন।

বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর যারা ভারত ভ্রমণে যান তাদের মধ্যে দেশটির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতা যাননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বোধহয় কষ্টকর হবে। চিকিৎসা আর কেনাকাটা করতে বাংলাদেশিদের একটা বিরাট অংশ ভারত ভ্রমণ করেন।

কলকাতার নিউ মার্কেট এলাকা এবং আশপাশে সারাবছরই বাংলাদেশিদের ভীড় থাকে। ওই এলাকায় হোটেল খরচ কম এবং কেনাকাটার সুবিধার জন্যই বাংলাদেশিদের আনাগোনা বেশি।

কলকাতা যারা ভ্রমণ করেন তাদের অনেকের সঙ্গেই বিভিন্ন সময়ে কথা হয়েছে। তাদের কাছে কলকাতা মানেই চিকিৎসা আর শপিং। খুব বেশি হলে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, গড়ের মাঠ, জাদুঘর দেখা আর বিখ্যাত কফি হাউসে গিয়ে একটু চুমুক।

এর বাইরে তিনশ বছরেরও বেশি পুরানো শহরটার ব্যাপারে বাংলাদেশিদের বেশিরভাগেরই আগ্রহ কম (আমার কাছে তাই মনে হয়)।

চায়না টাউনের একটা দরজা।

পাঠক হয়ত বিরক্ত হতে পারেন, ভাবতে পারেন আমি কোন হরিদাশ পাল। অন্যের আগ্রহ নিয়ে নিজের মত চাপিয়ে দিচ্ছি। কলকাতা-ভারতের প্রাক্তন এই রাজধানীর ব্যাপারে নিজের কিছু ভালো লাগা তুলে ধরতেই এত কথা।

গত নভেম্বরে মাসে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সীমান্ত রক্ষী বাহিনী-বিএসএফ’র আমন্ত্রণে একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কলকাতা সফরের সুযোগ হয়েছিল। এর আগে পেশাগত কাজে একবার গেলেও শহরটা সেভাবে দেখা হয়নি। আসলে এই সেভাবে দেখাটা, কলকাতার ক্ষেত্রে খাটে না।

অঞ্জন দত্ত কলকাতার ষোলআনা তার বেড়ে ওঠা আর গান দিয়ে উসুল করে ছাড়লেও আমার মতো নিতান্ত সাধারণ পর্যটকের জন্য ষোলআনা উসুল করাটা অসাধ্যতো বটেই, কল্পনা করাটাও বাতুলতা।

পুরো শহরটাই এমন এক মায়া তৈরি করে রেখেছে যে, দেখিয়ে এবং ভাবিয়ে কলকাতা আপনাকে তার নিজের করে রাখবে।

ফেলুদা, ব্যোমকেশ বক্সী, অঞ্জনের ম্যারি অ্যান, জেরেরিমসহ কৈশোরের আরও কত প্রিয় চরিত্রে এই শহরটা আমাকে একদম বেঁধে ফেলেছিলো বা ফেলেছে। তবে আমার দেখা এই কলকাতা কিন্তু পুরানো কলকাতা-উত্তর কলকাতা।

হালের কলকাতা ঝা চকচকে; আকাশচুম্বী ভবন আর আধুনিক শপিং মলের। আমার কলকাতা হচ্ছে-শতবর্ষ পুরানো বিল্ডিং, অলিগলি, চায়ের দোকান।

ফিরিঙ্গী মন্দির।

কলকাতা শহরটাই আমার কাছে মনে হয়েছে চলন্ত এক ইতিহাস। আপনি যদি শহরের রাস্তাগুলো যাদের নামে করা তাদের সম্পর্কে জানতে গুগলের সাহায্য নেন তাহলে বৃটিশ ইন্ডিয়া আর তার পূর্ববর্তী ইতিহাসের একটা ব অংশ বই পড়ে জানার আর দরকার হবে না (বই পড়তে অনুসাৎহী করছি না মোটেই)।

ধরুন আপনি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন। দেখলেন রাস্তার নাম বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট। এটা দাবি নিয়ে বলতে পারি, এ প্রজন্মের অনেকেই আছেন যারা এই নামটা শোনেননি। তিনি যদি নামটা একটু কষ্ট করে সার্চ দেন তাহলে বাংলা সাহিত্যের এক দিকপালের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যাবে।

এর পরের কাজটা অবশ্য নির্ভর করবে ব্যক্তির ওপরে। মানে আপনি বঙ্কিম বাবু’র লেখা পড়বেন কীনা সেটা একান্তই আপনার ব্যাপার। তবে কলকাতা গিয়ে রাস্তার নাম যদি সত্যি সত্যি গুগল করে পড়তে পড়তে এগোতে থাকেন তাহলে কিন্তু আপনার কিছুই দেখা হবে না। নোট করে রাখতে পারেন, পরে পড়ে নিলেন।

কোনো নতুন শহরের গেলে অনেকেরই আগ্রহ থাকে শহরের দর্শনীয় স্থান ভ্রমণের। ব্যক্তিগতভাবে আমার পছন্দ শহরের রাস্তা আর মানুষ। দেশের ভিতরে এবং বাইরে এখন পর্যন্ত যতগুলো শহরের গিয়েছি প্রত্যেকটি জায়গায়ই আমার প্রথম লক্ষ্য থাকে শহরের মানুষের সঙ্গে আলাপ করার এবং অলিগলিতে ঘোরার। আর কলকাতার রাস্তার হেঁটে বেড়ানোর ইচ্ছাটা ছিল অনেক আগের।

ভারত সরকারের অসাধারণ আতিথেয়তার ফাঁকে পুরানো এই শহরটার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আপ্যায়নের উপাদানগুলোর কিঞ্চিৎ চেখে দেখার সুযোগটা তাই হাতছাড়া করিনি।

কলকাতায় রয়েছে এরকম সুউচ্চ প্রাচীন ভবন।

নিজে খাদ্যরসিক বলে খাবার কথাটা আগেই বলি। শহরের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে আপনি রাস্তার ওপর খাবারের দোকান পাবেন না। হাল আমলে যাকে ‘স্ট্রিট ফুড’ বলি তার ছড়াছড়ি পুরো শহরটাতে।

বাঙালি খাবার থেকে চাইনিজ; ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের খাবার- কী নেই। প্রত্যেকটি খাবারই আপনার সাধ্যের মধ্যে। ভালো ও দামী রেস্তোঁরার অভাবও নেই। আর স্বাদ! আহা! সে নিজে গিয়েই চেখে দেখুন না।

ক্রিম চিজ দেওয়া এগ রোল, লিভার রোল, ক্লিয়ার সুপসহকারে চিকেন মোমো, হরেক পদের চাওমিন, ফ্রাইড রাইস, দোসা, ছোলা বাটোরা, পার্ক সার্কাসের কাবাব— উফফ! না খেয়ে আর কত লেখা যায়।

রাস্তার পাশে ৩০ থেকে ৪০ রূপি খরচ করে দিব্যি আপনার লাঞ্চ বা ডিনার হয়ে যাবে। তবে কোনো রেস্তোঁরায় যদি ভেটকি মাছের পাতুড়ি পেয়ে যান, সেটা অর্ডার করতে ভুলবেন না।

ঘুরতে ফিরতে কলকাতায় রাস্তায় মিলিবে এরকম প্রাচীন ভবন।

আরেকটা জিনিস হচ্ছে কলকাতার মিষ্টি। এটার স্বাদ বর্ণনা করার সাধ্য আমার নেই। শুধু এটুকুই বলবো, পাড়ার দোকানের মিষ্টান্ন চেখে দেখার পর আপনার এর স্বাদ বর্ণনা করার ইচ্ছা হবে, কিন্তু পারবেন না। শহরের প্রায় প্রতি জায়গাতেই আপনি তাজা ফলের রস পাবেন। বিশেষ করে কমলা আর মাল্টার জুস। আপনার সামনেই ফল থেকে নিংড়ে গ্লাসে করে পরিবেশন করবে একফোঁটা পানি কিংবা চিনি ছাড়াই (ঢাকায় যে জুস আমরা পান করি তাতে পানি আর চিনি দিতে দোকানিরা কার্পণ্য করেন না)। দাম গ্লাসের সাইজ অনুযায়ী ১৫ থেকে ২৫ রূপির মধ্যে।

এর বাইরে অন্যান্য পাণীয় আপনি খুব সহজেই পেয়ে যাবেন। আর যদি টেংরায় চায়না টাউনে একবার চলে যেতে পারেন, তবে কেল্লা ফতে। শুধু রেস্তোঁরা আর রেস্তোঁরা।

একটু লেট লাঞ্চ করতে গেলেই ভালো। ভাবলেন আমি দেরি করে খাওয়াতে চাচ্ছি। যেয়ে দেখুন না শুধু একবার। পুরো খিদে উসুল করে খেয়ে আসতে পারবেন। দামও সাধ্যের মধ্যে। এই এলকার সবচেয়ে ভালো রেস্তোঁরা ‘বিগ বসে’ তিন-চার পদ দিয়ে দুজনের দুপুরের খাবারের দাম পড়বে ৬০০ থেকে ৭০০ রূপির মধ্যে।

চায়না টাউনে ঢোকার পরপরই মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে ‘চাইনিজ কালী মন্দির’টার দিকে একটু চোখ রাখবেন। বিশেষ কিছু নয়, তবে ওই নামটার মধ্যেই একটা ব্যাপার আছে। আর চায়না টাউনে চীনেম্যানদের মুখে বাংলা শুনতে আমার বেশ লেগেছে।

বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট।

এবার আমি রাস্তার কথায় আসে। আগেই বলেছি, অলিগলিতে ঘোরা আমার পছন্দের কাজ। বাংলাদেশে আমার মতো যারা মফস্বল শহরের বেড়ে উঠেছেন তারা বুঝবেন পাড়া আর পাড়ার রাস্তার টান।

মফস্বলের একেকটা রাস্তা যেন একেকটা গল্প। ছেলেবেলার সেই ছবির একটা ঝলক আমি পেয়েছি কলকাতাতেও। চায়ের দোকানে সাম্প্রতিক নোটকাণ্ড থেকে রাজনীতির আলোচনা, আরেকদিকে ছেলে ছোকরাদের খেলাধুলা।

বউ বাজারের বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রিটের ‘ফিরিঙ্গি কালী মন্দির’ দেখতে গিয়েছিলাম। এটা দেখতে যাওয়ার উদ্দেশ্য হল- সেই ৯০৫ বঙ্গাব্দে পুরোদস্তুর বাঙালি বনে যাওয়া এক পর্তুগিজ এই মন্দিরটির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর এখন হল ১৪২৩ বঙ্গাব্দ। সেই পর্তুগিজটির নাম হচ্ছে- হেন্সম্যান অ্যান্টনি, যিনি অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি নামে পরিচিত ছিলেন। ওই সময়ে বিখ্যাত সব কবিয়ালদের হারিয়ে নিজ মহিমায় উজ্জ্বল ছিলেন তিনি।

তার সম্পর্কে জানতে উত্তম কুমার অভিনীত ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ কিংবা সাস্প্রতিক সময়ে ‘জাতিস্মর’ সিনেমাটা দেখতে পারেন। মন্দিরটার পুরানো সেই কাঠামোটার ছিঁটোফাঁটাও এখন নেই। তবে ভেতরের কালীমূর্তিটি সেই সময়েরই।

কলকাতার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্দিরটা দেখে কিছুদূর গিয়েই ঢুকলাম এক গলিতে। একদম সেই পাড়ার গলি, চায়ের দোকান, শত বছরের পুরনো বাড়ি। দাঁড়িয়ে খানিক জিরিয়ে মাটির ভাড়ে চা পান, আবার হাঁটা। এভাবেই গলির পর গলি ঘুরেছি।

বৃটিশ আমলে তৈরি করা বাড়িগুলো প্রতিনিয়ত জানান দিচ্ছে ইতিহাসের। ভেঙে ভেঙে, পড়বে পড়বে করেও ঠিক দাঁড়িয়ে থাকা ভবনগুলোই যেন শহরটার জ্যেষ্ঠ নাগরিক। আপনাকে দেখাবে তার বহুদিনের স্মৃতি। রাস্তাগুলো বলবে ঐতিহাসিক চরিত্রে কথা।

কলকাতা শহরটার যদি আমার মতো করে দেখতে চান, আপনাকে কষ্ট করে ওই শহরটাতে একবার পড়তে হবে, ব্যাস। তারপর শহরই আপনাকে নিজের পথে নিয়ে যাবে।

গুগল ম্যাপ আপনার ভালো সহায় হবে। বাসে-ট্রাম-মেট্রো করে গন্তব্যে চলে যাবেন। ট্যাক্সিও নিতে পারেন। আগে থেকে ঠিক করে নেবেন, কোন এলাকায় যাবেন। গুগলে ওই এলাকার ম্যাপটা একটু দেখে নিলেই হবে। আর যে রাস্তায় যাচ্ছেন সেখানে দর্শনীয় কিছু আছে কীনা সেটাও খুঁজে দেখুন একটু। স্থানীয় মানুষ খুবই সহযোগিতাপরায়ন। আর যদি এমন কাউকে পেয়ে যান যার বাবা-মা, কিংবা দাদা-দাদী কারও বাড়ি ছিল বাংলাদেশে, তাহলেতো কথাই নেই। আপনি তখন তার ‘দ্যাশের মানুষ’।

বাংলাদেশ থেকে কলকাতা যাওয়ার উপায় বলে এই লেখাটা আর বড় করবো না। বাস-ট্রেন-উড়ালপথ নানাভাবেই যেতে পারবেন। তবে আপনার সাহায্যের জন্য বলে রাখি কলকাতা নিউমার্কেট বা আশপাশে সস্তার অনেক হোটেল আছে। এক হাজার বা তার চেয়ে কিছুটা কমে আপনি মোটামুটি একটা রুম পেয়ে যাবেন। আর ভালো মানের হোটেলে থাকতে চাইলে আগে থেকে বুকিং দিয়ে যাওয়াই ভালো। সেক্ষেত্রে টাকাটা একটু বেশি লাগবে।

চাইনিজ কালী মন্দির।

হোটেলে কিংবা আশপাশে প্রচুর মানি এক্সচেঞ্জ পাবেন। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের পুরানো নোট বাতিল আর নতুন নোটের প্রচলনে একটু অসুবিধা হয়তো হবে, তবে সেটা সাময়িক। যতদূর শুনেছি, পরিস্থিতি এখন অনেক ভালো। আর হোটেল নেওয়ার সময় দালালের খপ্পড়ে পড়বেন না। নিজেই সরাসরি হোটেলে উঠে যাবেন।

এবার সফরের মধ্যেই এক সন্ধ্যায় বিএসএফ’র এক অবাঙালি কর্মকর্তাকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন বাঙালি কর্মকর্তা বলছিলেন, “আপনি কলকাতায় কাজ করছেনতো, দেখবেন শহরটা আপনার ওপর চেপে বসবে।”

অবাঙালি ভদ্রলোক কিছুটা হাসলেন। বললেন, “সেরকম কিছু না, আসলে এই শহরটা খুব ভালো। এখানকার মানুষজন অনেক বেশি সহজ। রাস্তা-ঘাট অনেক বেশি প্রাণময়।”

আমি পাশে দাঁড়িয়ে হেসে বললাম, “আসলেই চেপেছে।”

ছবি: লেখক।