দেখে এলাম নাফাখুম

গ্যালন গ্যালন পানি ছুটে এসে ঝরে পড়ছে, তারপর গড়িয়ে চলে যাচ্ছে। দূরন্ত গতিতে ছুটে চলা এই ঝরনা দেখতে চাইলে থাকতে হবে কঠিন মনোবল।

লাইফস্টাইল ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Oct 2016, 05:37 AM
Updated : 28 Oct 2016, 05:37 AM

আর থাকতে হবে পাহাড়ি পথ অতিক্রম করার সাহস। সেই দুর্গম পথ জয় করে নাফাখুম ঝরনা উপভোগ করার কথা জানাচ্ছে হাদিরাতুল জান্নাত তালুকদার।

যে ঝিরি পথ পায়ে হেটে পার হওয়া যায় শুনেছি, সেই ঝিরি পথ নদী হয়ে ওঠায় আশ্চর্য হলাম খুব। পায়ে হেঁটে নয় আমরা ট্রলারে সেই ঝিরিপথ ধরে এগিয়ে চললাম।

মজাই লাগছিল, জীবনে প্রথম আমার এমন অভিজ্ঞতা। পাহাড়েই এসেছি এই প্রথম। আমাকে গাইড করবে বলে যার আগমন আহারে বেচারা! আমারই তাকে গাইড করতে হচ্ছিল।

ফেরার পথে তার সেকি এক চিৎপটাং অবস্থা। তবে ভয় যে পাইনি বলা যাবে না।

ট্রলারে যাত্রা শেষ হতেই শুরু হলো ট্রেকিং। ঝিরির পানিতে পা দেওয়া মাত্রই পা দুটো শিরশির করে উঠলো। একটু ফসকালেই পানিতে ধপাস জেনেই হাতে বাঁশের কঞ্চি তুলে নিলাম।

খরস্রোতা রেমাক্রি।

পিছল পথে পিছলে না যেতে বাঁশ হাতে হাঁটতে হয়।

ওহহো, আমি কিন্তু সাঁতার জানি না। মনে মনে বলি বাপু সাবধান! পা ফসকালে নির্ঘাত ডুবে মরবে। এভাবেই নানান ভাবনা চিন্তায় হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম যেখানে তাকে আমার পুলসিরাত বলেই মনে হল।

ঝিরির এপাড় ওপাড় দড়ি বাঁধা। দড়ির সামনে পেছনে তাকালেই দেখা মেলে তুখোড় স্রোতের। পনির ঘূর্ণি ভেদ করে সেই দড়ি ধরে সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে এগিয়ে চললাম। রশিতে হাত লাগানো আর এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করি অত আর ভয় করছে না!

প্রশ্ন করতেই পারেন কই যাচ্ছি! যাচ্ছি নাফাখুম। বাংলাদেশের নায়াগ্রা, এসেছি এক রাত আগে। সারাপথ খুব ভালোয় ভালোয় এগিয়ে বৃষ্টিতে পড়লাম থানচি এসে। তবু পাহাড় আর জলপ্রপাতের টান বলে কথা।

‘আমার সারাটাদিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম বলে’ ট্রলারে চাপলাম। মনে মনে বললাম ভয়ের কিছু নাই, মরতে তো হবেই, সে রাতে আমরা রেমাক্রি ছিলাম।

পরদিনও বৃষ্টি কমার নাম নিল না। তাই বৃষ্টিকে সখা করেই নাফাখুমের পথ ধরলাম।

নাফাখুম ঝরনা।

পার হতে হয় দড়ি ধরে। হাত ফসকালেই ভেসে যেতে হবে স্রোতে।

জোঁক আমি ভয় পাই খুব, সে জন্যই মনে হয় জোঁক আমার ধারে কাছেই ছিল না।

তবে আমাদের দলের দুজনকে জোঁক কামড়ে ধরেছিল। আমি কখনও অতিসর্তক ছিলাম না। ট্রলার থেকে নেমেই নির্ভাবনায় এগিয়ে চলছিলাম। কর্দমাক্ত গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছিলাম বাঁশের কঞ্চি গেঁথে গেঁথে।

কখনও কখনও গাছের ডালপালা জড়িয়ে ধরে চড়াই পার হচ্ছিলাম। এভাবেই ঘণ্টা দেড়েক ক্লান্তিকর পথ চলার পর সেই পুলসিরাত মনে করা দড়ি বা রশির সামনে এসে কিছু সময়ের জন্য ভীষণ চিন্তায় পড়ে যাই।

অবশেষে সাহস করে সেই দড়িও পার হই।

এভাবেই আরও ঘণ্টাখানেক চলার পর তীব্র গর্জন কানে আসে। বৃষ্টি হচ্ছিল তখনও। তাই দৌঁড়ে ছুটে যাওয়ার উপায় ছিল না। কেননা ক্রমাগত একটানা ক্লান্তিকর চড়াই ভেঙে, কখনও পাথরের উপর আবার কখনও কর্দমাক্ত পিচ্ছিল পথ ধরে দৌঁড়ে ছুটে চলা আমাদের জন্য দূরহ ছিল বটে।

তবু আমরা দ্রুত পা চালাই। এভাবেই এক সময় নজরে আসে নাফাখুম জলপ্রপাতের দূরন্ত জলধারা।

নাফখুমে বাংলাদেশের পতাকা হাতে।

দুরন্ত নাফাখুম।

আরও কিছু পথ যেতে চোখ আর সরতে চাচ্ছিল না। সবাই জলপ্রপাতের গর্জনে দিশেহারা হই, আবার সতর্কতাও ছিল। কেননা অঝোর না হলেও বৃষ্টি তখনও পড়ছিল। আর পিচ্ছিল পাথরের ওপর দিয়ে দৌঁড়ে ছোটাও সম্ভব ছিল না। তবু আমরা দ্রুত এগিয়ে যাই, তারপর তো ফেরার কথাই ভুলে যাই! ভুলে যাই বৃষ্টির পানিতে মোবাইল বা ক্যামেরা ভিজে ওঠার কথা।

এসব কিছু ভুলে ছবি তুলে চলি একটানা সঙ্গে নাফাখুমের জলধারা দেখি মুগ্ধ নয়নে।

এদিকে বৃষ্টির বেগ বাড়ছিল সঙ্গে রেমাক্রি ঝিরির পানিও ফুলে ফেঁপে উঠছিল। গাইডের তাড়া খেয়ে নাফাখুমকে বিদায় বলে ফিরতি পথ ধরি।

কীভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে বান্দরবান। বাস ভাড়া ননএসি ৬৬০ টাকা। বান্দরবান থেকে বাসে বা দল ভারি হলে চাঁন্দের গাড়িতে থানচি।

রেমাক্রি গ্রাম।

পথ চলতে ক্লান্তি, কেটে যাবে পাহাড়ি সৌন্দর্যে।

বাস ভাড়া জনপ্রতি ২শ’ টাকা। চান্দের গাড়ি বা জিপ ভাড়া রিজার্ভ ৪ হাজার টাকার মতো। থানচিতে রাত থেকে অথবা সেদিনই ট্রলারে চেপে তিন্দু হয়ে চলে যাওয়া যায় রেমাক্রি।

রেমাক্রিতে থাকতে হবে। পরদিন সকাল সকাল বের হয়ে চলে যেতে হবে নাফাখুম। পুরো বেলা সেখানে কাটিয়ে দুপুরের পর ফিরতি পথ ধরতে হবে।

নাফাখুমের পথে পর্যাপ্ত পানি আর শুকনা খাবার অবশ্যই সঙ্গে রাখবেন। লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে রাখবেন। পরিবেশ নষ্ট হওয়ার মতো তেমন কিছু করবেন না এবং অপচনশীল কিছু বনে কিংবা জলপ্রপাতের আশেপাশে এবং রেমাক্রির খালে ফেলবেন না।