হারিয়ে যাওয়া পানডুবি

একসময় এই পাখিটিকে দেখা যেত দেশের নিরিবিলি জলাশয়গুলোতে। একটুখানি শব্দ হলেই ডুব দেয়।

>> রহীম শাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 July 2014, 10:19 AM
Updated : 15 July 2014, 10:19 AM

সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়। আমরা কয়েক বন্ধু পাখি দেখার আশায় শ্রীমাই পাহাড়ের দিকে ছুটলাম। তখন ছিল অক্টোবর মাস। শ্রীমাই খাল ধরে নৌকা নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে একটা খাড়িতে ঢুকে পড়লাম।

খালে পানি কম থাকলেও খাড়িতে পানির কমতি ছিল না। ট্রিলি ট্রিলি করে ডাক দিয়ে জলের কিছু পাখি। ফিরলাম তাদের দিকে। নৌকাটাকে সামনে আর এগুতে দিলাম না। আমাদের পূর্বপরিচিত পাখি ওরা। ডুবসাঁতার দিতে সে বেশ পটু। তাই জুটেছে নানা নাম— পানডুবি, ডুবুরি, ডুবডুবি।

একসময় এই পাখিটিকে দেখা যেত দেশের নিরিবিলি জলাশয়গুলোতে। একটুখানি শব্দ হলেই ডুব দেয়। ডুব দেওয়ার ব্যাপারে অদ্ভুত রকমের দক্ষ। পানির উপর একটুও ঢেউ না তুলে সাঁই করে মিলিয়ে যাবে। এরা পুকুরের উপর দিয়ে ছোট ডানা ঝাপটে ভেসে বেড়ায়। গ্রামের পুকুরে এই ছোট পাখিগুলোকে সাঁতরাতে দেখা যায়। টুবটুব দেয় ডুব। বিল-হাওড়ে ঝাঁকবেঁধে থাকে পানডুবি। পানডুবি বাচ্চাদের পিঠে বসিয়ে তরতর করে জলজ ঘাসের বনে ভেসে বেড়ায়। ছানাদের গায়ে ডোরাকাটা দাগ। এদের পায়ের আঙুলগুলোর দুপাশের পাতলা চামড়া।

শামুক, গুগলি, ব্যাঙাচি, কীটপতঙ্গের ডিম, মাছের পোনা খায়।

মেটে রংয়ের এই পাখির শরীর রেশমের মতো। তুলতুলে আর মসৃণ। এটি হাঁস আকৃতির লেজহীন ছোট পাখি। দেহের উপরের বর্ণ গাঢ় পাটকিলে, গলা ও ঘাড়ের দুই পাশ বাদামি। বুকের নরম পালক ধোঁয়াটে সাদা। ডানায় সাদা ছোপ। ওড়ার সময় সেই ছোপটি দেখা যায়। স্ত্রী ও পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম।

প্রজননের সময় বড় ডোবার কাছে নলবনে ভাসমান বাসা বানায় জলজ ঘাস দিয়ে। বাসা যাতে না ভেসে যায়, সে জন্য জলজ আগাছা দিয়ে বাসাটিকে নলের সঙ্গে বেঁধে নেয়। পাতার ডাঁটি শুকনো পচা পাতা জমিয়ে ভেলার মতো বাসা পানিতে ভাসে। বলা যেতে পারে, নরম ভেজা ঘাসের নীড়।

স্ত্রী পাখি ডিম দেয় চারটি। পানডুবির ডিমের রং সাদা। ধপধপে সাদা ডিম গাছপাতার রং লেগে ছোপ ছোপ হয়ে যায়। বাসা থেকে বাইরে যাবার সময় ডিমগুলো ভেজা ঘাসের নিচে চাপা দিয়ে যায়। সাপের লোভ ওই ডিমের প্রতি। ডিম ফুটে ছানা বের হয় ২০ দিনে। খাবার খেতে বাইরে গেলে ডিম ঘাস দিয়ে ঢেকে রেখে যায়। ছানাগুলো ডিম ফুটে বের হওয়ার কিছু সময় পরই চটপটে হয়ে ওঠে। মা-পাখি ছানাদের পিঠে নিয়ে হাওড়ের পানিতে সাঁতরে বেড়ায়। বিপদের আঁচ পেলে এবং মা সংকেত দিলে ছানারা পিঠ থেকে নেমে লুকিয়ে পড়ে জলজ ঝোপে।

এখন এই পাখি নেই বললেই চলে। ক্রমাগত জলাশয় দখল আর জলাভূমির বন ধ্বংসের কারণে অনেক পাখিই এখন দুর্লভ হয়ে গেছে। সুন্দর এই পানডুবিও নাম লিখিয়েছে দুর্লভদের তালিকায়। এখন কেবল সিলেট বিভাগের কিছু হাওড়ের বিলে দেখা যায় এদের। পাখিটির ইংরেজি নাম Little Grebe। বৈজ্ঞানিক নাম Tacybaptus ruficollis