এই ব্যাংকটা শিশুদের

কিরন বাস করে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে। যখন থেকে বুঝতে শিখেছে তখন থেকেই সে নিজেকে আবিষ্কার করেছে ফুটপাথে। বাবা মা আত্মীয়-স্বজন বলতে আশপাশে কেউ নেই। এর-ওর কাছ থেকে খাবার চেয়ে পেটের ক্ষুধা মিটিয়েছে সে।

>> তাসলিমা নীলুবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 July 2014, 10:27 AM
Updated : 12 July 2014, 11:05 AM

এখন তার বয়স বারো। ভিক্ষে করে পেট চালাতে হয় না। দিল্লির এক সস্তা হোটেলে ওয়েটারের কাজ করে। কর্মচারী হিসেবে হেটেলের খাবারই খায় সে। পাশাপাশি মাস শেষে বেতন বাবদ কিছু রুপিও আসে পকেটে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, মাসের বেতনের পুরোটাই তাকে খরচ করে ফেলতে হয়। কারণ এই রুপি রাখার কোনো জায়গা নেই তার। কয়েকবার নিজের কাছে রুপিগুলো জমানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু চুরি হয়ে গেছে প্রত্যেকবারই। বাণিজ্যিক ব্যাংকে একাউন্ট খুলবে, সে উপায়ও নেই। একে তো বয়স কম, তার উপড় একাউন্ট খোলার জন্য স্থায়ী ঠিকানা দরকার। দরকার একজন পরিচয়দানকারীও। সেসব কিছুই নেই তার।

ব্যাপারটা নিয়ে অচিরেই কারান চিন্তিত হয়ে পড়ল। তার মনে ভয় ঢুকে গেল। সে ভাবল, এভাবে কষ্টের রুপিগুলো খরচ করে ফেললে সঞ্চয় বলতে তার কাছে কিছুই থাকবে না। অর্থ জমিয়ে ভবিষ্যতে ভালো কিছু করার সুযোগও হারাবে সে।

ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনার জন্য কিরন তার বন্ধুদের কাছে উপস্থিত হল। বন্ধুরাও সবাই তার মতো পথশিশু। আলোচনা শেষে দেখা গেল, সবারই এক সমস্যা। অর্থ জমানোর কারও কোনো সুযোগ নেই।

কেউ বলল, সঞ্চয় করার জায়গা নেই বলে সে তার অর্জিত অর্থ ধূমপান করে নষ্ট করে। কেউ জুয়া খেলে অর্থ উড়িয়ে দেয়। অনেকের অবস্থা তো আরও করুন। তারা ভয়ংকর সব নেশার পেছনে ব্যয় করে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ। সবাই জানাল, যদি অর্থ সঞ্চয় করার মতো কোনো জায়গা থাকত, তাহলে কেউ খারাপ পথে যেত না। সবাই বুঝতে পারল, সঞ্চয়ের একটি জায়গা না হলে আর চলছেই না। অগত্যা, এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য নিজেরাই বানিয়ে ফেলল একটি ব্যাংক-- দ্য চিলড্রেনস ডেভলপমেন্ট ব্যাংক।

২০০১ সালে ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার পর আজ পেরিয়ে গেছে প্রায় চৌদ্দ বছর। ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে আজ দ্য চিলড্রেনস ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের ১২টি শাখা কাজ করছে। গ্রাহকের সংখ্যা ৯ হাজার। তারা সবাই পথশিশু। দুই রুপি চার রুপি করে জমাতে জমাতে আজ সেই ব্যাংকের মোট সম্পদ এসে দাঁড়িয়েছে ১২ লক্ষ রুপিরও বেশি।

সাধারণ ব্যাংকের সঙ্গে দ্য চিলড্রেনস ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের কোনো মিল নেই। এই ব্যাংক খোলে সন্ধ্যার পর। সবাই যখন কাজ থেকে ফেরে, তারপরই বসে ব্যাংকের মূল কার্যক্রম। ব্যাংকের কর্মচারীরা সবাই ভলেন্টিয়ার। তারা কোনো বেতন নেয় না। প্রতি ছয়মাস পরপর গ্রাহকদের পরামর্শ অনুসারে ভলেন্টিয়ার নির্বাচন করা হয়। একাউন্টের মালিকরা তাদের আমানতের উপড়ে ৫ শতাংশ হারে সুদ পেয়ে থাকেন। তাদের প্রত্যেকের আছে পাশ বই। তবে ব্যাংকে অর্থ জমা রাখার ক্ষেত্রে অলিখিত নিয়মও আছে। কাজ করে অর্জিত রুপিই শুধু জমা রাখতে পারবে গ্রাহকরা। ভিক্ষা, পকেটমার কিংবা নেশার দ্রব্য বিক্রি বাবদ অর্জিত রুপি কোনোভাবেই এখানে জমা রাখা যাবে না। ইচ্ছে করলে গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে লোন নিতে পারে। সামাজিক কাজ যেমন জরুরি চিকিৎসা খরচ, লেখাপড়ার খরচ, চাকরির ইন্টারভিউ খরচ ইত্যাদি প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে লোন দেওয়া হয়। ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রেও ব্যাংকের রেকর্ড যে কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের চেয়ে বেশি। দু-একটি বছর ছাড়া প্রত্যেক বছরেই তারা শত ভাগ ঋণ আদায় করতে সক্ষম হয়েছে।

জামাল আলীর বয়স চৌদ্দ বছর। ছয় বছর হল, সে দ্য চিলড্রেনস ডেভলপমেন্ট ব্যাংকে অর্থ সঞ্চয় করছে। সব মিলিয়ে তার সঞ্চয়ের পরিমাণ ১৮ হাজার রুপি। সাইকেল রিপিয়ারিংয়ে কারখানায় কাজ করে।

সংবাদ সংস্থাকে জামাল জানায়, কাজ করে প্রতি মাসে গড়ে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার রুপি ইনকাম হয়। একমাত্র বোনটা এতিমখানায় থাকে। বেতন থেকে ওর কাছে কিছু রুপি পাঠিয়ে দেয়। বাকি অর্থে নিজের খরচ বহনের পরও কিছু থেকে যায়। এক সময় সেই অর্থ নষ্ট করে ফেলত সে। এখন ব্যাংকে জমাচ্ছে সেগুলো। আর দশ বছর পর যখন পর্যাপ্ত রুপি হবে, তখন নিজেই একটা রিপিয়ারিং শপ খুলবে। তখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে সে।

বিনয়ের বয়স ১৩ বছর। বাবাকে হারিয়েছে সেই ছোটবেলায়। তারপর মা আবার বিয়ে করেছেন। মায়ের নতুন সংসারে জায়গা হয়নি তার। ফুটপাথ এখন তার বাসা। তাই বলে নিজেকে গড়ে তোলার ব্যাপারে এতটুকু ছাড় দেয়নি সে। সরকারি স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ছে বিনয়। দুপুরে ক্লাস থেকে বেরিয়ে পড়ে কাগজ, ভাঙা লোহা, কাচ ইত্যাটি কুড়াতে। সন্ধ্যা পর্যন্ত কুড়িয়ে যা হয়, সেগুলো পাইকারি দোকানে বিক্রি করে। খাবার খরচের টাকাটা রেখে বাকিটা ব্যাংকে জমা দিয়ে আসে। প্রতিদিন তার এভাবে চলে। দশ-বিশ রুপি জমাতে জমাতে এখন সে তিন হাজার রুপির মালিক।

বিনয় বলে, “স্কুলে বেতন লাগে না। তবে পরীক্ষার আগে ফি দিতে হয়। ব্যাংকে জমানো টাকা থেকে সেটা দিতে পারি আমি। যদি ব্যাংকটা না থাকত তাহলে আমার কোন সঞ্চয় থাকত না। ফলে পরীক্ষার ফি দেওয়ার জন্য আমার কাছে কোনো অর্থও থাকত না। ফলে আমি লেখাপড়াটাও করতে পারতাম না। ব্যাংক আমাকে সে সুযোগটা করে দিয়েছে। আমার বন্ধু কাজলও ব্যাংক থেকে উপকার পেয়েছে। তার পরীক্ষার ফি ছিল না। আমার জিম্মায় ব্যাংক থেকে তাকে ৩০০ রুপি লোন তুলে দিয়েছি। এখন সে মন দিয়ে লেখাপড়া করছে। পাশাপাশি আমার সঙ্গে কাজেও বের হচ্ছে। আশাকরি অচিরেই সে ব্যাংকের ঋণ শোধ করে দেবে।”

দ্য স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার কর্মকর্তা অনিল বাজপাই পথশিশুদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, “সমগ্র ভারতে ১০ কোটি পথশিশু রয়েছে। এর মধ্যে এক কোটি শিশু মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের অবিভাবক নেই, থাকার জায়গা নেই, ঠিক মতো খেতে পায় না। সেই সঙ্গে শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকারগুলো থেকেও তারা বঞ্চিত। এরকম সংকটময় পরিস্থিতিতে তাদের মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা বাড়ছে দেখে আমি সত্যিই আশাবাদী। এর ফলে তাদের মধ্যে ব্যক্তিসত্ত্বা গড়ে উঠবে, নিজের প্রতি আস্থা অর্জন করবে এবং মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। আমি ওদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাই।”

যদিও ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দ্য চিলড্রেনস ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি। তবুও উদ্যোক্তাদের আশা, ধীরে ধীরে ভারতের সব শহর-উপশহরে এই ব্যাংকের শাখা থাকবে। ভবিষ্যতে প্রতিবেশী দেশ নেপাল, শ্রীলংকা, বাংলাদেশ এবং পাকিস্থানের পথশিশুদের জন্য স্ব স্ব দেশে এই ঘরানার ব্যাংক খুলতে কাজ করবে তারা।