গ্রামের পহেলা বৈশাখ

পহেলা বৈশাখ। বাংলা বছরের প্রথম দিন। বছরের এই প্রথম দিন কীভাবে উদযাপন করা যায়?

>> সাদিয়া ইসলাম বৃষ্টিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 April 2014, 10:41 AM
Updated : 12 April 2014, 10:41 AM

তা নিয়ে আবার ভাবার কী আছে! ঘুম থেকে উঠে লাল-সাদা জামা পরে বাবা-মায়ের হাত শক্ত করে ধরে বেরিয়ে পড়তে হবে। তারপর রমনা বটমূলে গিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখবে, ক্ষিদে লাগলে খাবে পান্তা-ইলিশ, ইচ্ছে হলে গালে আঁকাবে ছবি, বেলুন কিনবে আর সব শেষে কনসার্ট দেখে সন্ধ্যের পরে বাড়ি ফিরবে। এই তো প্রতি বছরের পহেলা বৈশাখের রুটিন! রুটিনই তো। একটুও এদিক-ওদিক নেই। এটা রুটিন ছাড়া আর কী?

কিন্তু এবার শোনাব একেবারে অন্য রকম এক পহেলা বৈশাখের গল্প। তুমি প্রতি বছর যে শহুরে পহেলা বৈশাখ পালন কর, সেটা নয়। এটা একেবারে অন্য রকম পহেলা বৈশাখ-- গ্রামের পহেলা বৈশাখ।

গ্রামে এই সময়টাতে ঘরে ঘরে আনন্দের ধুম পড়ে যায়। ওদের কাছে পহেলা বৈশাখ কেবল বৈশাখের উৎবই নয়, নতুন ধান বোনারও উৎসব।

প্রতি বছর নিজেদের ক্ষেতের ফসল থেকে কিছুটা ধান গ্রামের কৃষকরা সবসময়ই আলাদা করে রাখে। আর এতে সাহায্য করে কৃষক বৌ আর তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। সারাবছর ধরে আগলে রাখে তারা ওই ধান। আর এই ধানকেই বলে বীজধান। বৈশাখের প্রথম দিনেই কৃষক তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে সোজা চলে যায় ধানক্ষেতে। বোনে ধানের প্রথম বীজ। ফসল বোনার জন্য বছরের প্রথম দিনটাকেই সবচেয়ে ভালো বলে মনে করা হয়।

কৃষক বউও কিন্তু চুপটি করে বসে থাকে না। জমানো বীজধানের কিছুটা দিয়ে রান্না করে সে আমক্ষীর। পায়েস বা ক্ষীরের সঙ্গে গাছের কাঁচা আম মিলিয়ে বানানো এই উপাদেয় খাবার বানাতে তাকে সাহায্য করে ঘরের ছোট্ট মেয়েটা।

বাড়ি ফেরার পথে কৃষক কিনে আনে কিছু জিলিপি বা মিষ্টি। হাত-মুখ ধুয়ে পুরো পরিবার মজা করে খায় ঘরে বানানো আমক্ষীর আর রসেভরা দোকানের গরম গরম জিলিপি। এরপর শুরু হয় অন্য তোড়জোড়।

ঘরের ছেলেরা সোজা নেমে পড়ে নদী নয়তো পুকুরে। আর পাশে খলুই হাতে দাঁড়িয়ে উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করে ছোট ছোট মেয়েরা। এই বুঝি কেউ মাছ ধরল আর ছুঁড়ে দিল তার দিকে। মাছের অভাব হয় না অবশ্য। দক্ষ হাতে ছেলেরা একেকটা মাছ ধরে ধরে ছুড়ে মারে পাড়ে। আর মেয়েরাও টপাটপ কুড়িয়ে নেয় সেগুলো। কে কয়টা মাছ ধরতে পারল, তাই নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে সবার মধ্যে। ছেলেদের দেখাদেখি মাঝেমধ্যে মাছ ধরতে নেমে পড়ে মেয়েরাও।

অবশেষে খলুইভর্তি মাছ নিয়ে বাড়ি ফেরে সবাই। কৃষক-বউ তৈরিই থাকে চুলোর পাশে। সবাই হাত-মুখ ধুয়ে খানিক বিশ্রাম নিতে না নিতেই সে হাজির হয় সবার জন্য এক থালা পান্তা আর গরম গরম মাছ ভাজা নিয়ে। সঙ্গে কাঁচামরিচ আর পেঁয়াজ। তৃপ্তিসহকারে খেয়েদেয়ে কৃষক খানিক ভাতঘুম দেয়। আর এর মধ্যেই ছেলেমেয়েরা সারাবছর ধরে নিজেদের জমানো পয়সাগুলো ঘরের লুকোনো জায়গা থেকে বের করে ফেলে। বাবার ঘুম ভাঙলেই তারা রওনা দেয় বৈশাখিমেলার দিকে।

যাওয়ার সময় কানে কানে বলে দেয় কৃষক-বউ, দরকারি কী কী আনতে হবে। আর হাতে ধরিয়ে দেয় চকচকে টাকা। নিজের জমানো টাকা আর মায়ের দেওয়া টাকা-- এ দুই-ই হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে মেলার উদ্দেশে পা বাড়ায় ছেলেমেয়েরা। সঙ্গে বাবা।

মেলায় গিয়ে কত কাজ! দম ফেলবার ফুরসতই মেলে না। পুতুল, চুলের ফিতে, ঘড়ি, ঘুড়ি, মাটির নকশি করা কলস, বাঁশি কেনা, তারপর বায়োস্কোপ দেখা, তবেই না সবার ফুরসত মেলে বাড়ির কথা ভাবার। আর তখনই মনে পড়ে মায়ের দরকারি জিনিসের কথা।

সেসব কিনে বাড়ির পথ ধরতে ধরতেই ঝুপ করেই যেন নেমে পড়ে সন্ধ্যা। ওদিকে ঘরে গরম ভাত-তরকারি নিয়ে অপেক্ষা করছে কৃষক-বউ। সবার পায়ের গতিই যেন বেড়ে যায় গরম ভাতের কথা ভেবে।

তারপরও কি আনন্দের শেষ আছে? রাতে যে আবার পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বিশেষ যাত্রাপালার আয়োজন করা হয়েছে গ্রামে গ্রামে। সেখানে চোখের সামনেই অভিনয় করবে, গান গাইবে আর নাচবে গ্রামের দক্ষ অভিনেতারা। রাতের খাবার শেষ করেই সেই যাত্রাপালা দেখতে ছুটতে হবে।