আঠার অক্টোবর

পাখিদের ডাকে ঘুম ভাঙে তার। ভোরের স্নিগ্ধতা চারদিকে। এত ভোরে ঘুম ভাঙার কথা নয়। অনেক রাতে বিছানায় গিয়েছেন তিনি। তারপরও পাখিরা তাকে জাগিয়ে দিল আজ। আজ অন্যরকম দিন বলে কথা!

>> রুদ্রাক্ষ রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Oct 2013, 06:45 AM
Updated : 18 Oct 2013, 06:52 AM

অন্যরকম ভালো লাগায় মন ভরে উঠল তার। সবকিছু কেমন ভালো লাগতে শুরু করল। আজ তার জন্মদিন। রাতে জন্মদিনের প্রথম প্রহরেই প্রিয়তম স্ত্রীর কাছ থেকে পেয়েছেন প্রথম শুভেচ্ছা। অনেকটা যেন বাতাসে ভরকরা ফুরফুরে মেজাজ নিয়েই তিনি ঘুমাতে গিয়েছিলেন।

ঘুমিয়ে পড়ার আগে ভেবেছিলেন, জন্মদিনের কথাটা কাউকে বলা যাবে না। রাত পোহালে একদম নিজের মতো করে শুরু করতে হবে দিনটি। কাটাতে হবে অন্যরকমভাবে। সকালে বেরিয়ে পড়তে হবে নতুন কোনো পথে। একদম একা একা। কাউকে কিছু না বলে। সেলফোনটা বন্ধ করে রেখে যেতে হবে ঘরে। সারাদিন কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ থাকবে না। রাতে এসে মা-বাবা, হাসুপু, কামাল ভাই, জামাল ভাই, রেহানাপুর কাছে ক্ষমা চাইলেই হবে। বাকি থাকবেন দুই ভাবি, স্ত্রী আর নিজের ছেলেমেয়ে। তাদের বোঝানো তেমন কঠিন কোনো কাজ হবে না।

এটা ছিল রাতের ভাবনা। আর ভোরে ঘুম ভাঙার পর আলগোছে দরজা খুলে যখন তিনি দক্ষিণমুখী বারান্দায় দাঁড়ালেন, তখন আরেক দৃশ্য। শরতের ভোরটা কেমন মিষ্টি মিষ্টি। একটু মায়াজড়ানো ঠান্ডা বাতাস মন নাচিয়ে দিল। একটু দূরের আমগাছের ডালে হলদে কুটুমপাখি নেচে নেচে বলে উঠল, “শুভ জন্মদিন!”

ছোট্ট একটা টুনটুনি গলা চড়িয়ে বলল, “শুভ জন্মদিন!”

অবাক কা-! তিনি বিস্মিত হয়ে ভাবেন, পাখিরা জানল কী করে, আজ তার জন্মদিন! পাখিরা কি সত্যি সত্যি বলল, না কি তার শোনার ভুল?

দোতলার বারান্দাটা বেশ লম্বা। সেখানে কয়েকটা চেয়ারপাতা থাকে সবসময়। একটা ইজিচেয়ারও আছে। চেয়ারটাতে বাড়ির বড়কর্তা, মানে তার বাবা ছাড়া অন্য কেউ বসেন না। তবে বাড়ির ছোটছেলে বলে তার বসায় কোনো বারণ নেই। আজ ভোরে ইজিচেয়ারটায় একটু বসতে ইচ্ছে হল তার। আবার ভাবলেন, এখুনি বাবার ঘুম ভাঙবে। তিনি এখানে এসে বসবেন। যেমনি ভেবেছেন, অমনি পেছন থেকে

গম্ভীর অথচ আদুরে গলার আওয়াজ ভেসে এল, “শুভ জন্মদিন।”

যারপরনাই অবাক হয়ে তিনি ঘুরে দেখেন, বাবা দাঁড়িয়ে।

“কী রে, কত হল? তুইও আমার মতো বুড়ো হয়ে গেলি?”

বলেই হাসতে থাকেন বাবা। তার হাসির ভঙ্গি, শব্দ-- ভীষণ সুন্দর। তিনি হাসলে তার চোখ হাসে, গোঁফ হাসে। গালও হেসে উঠে।

“বাবা আমি মাত্র ৪৮। আর তুমি ৯২।”

“ইয়েস। সেঞ্চুরিতেও নটআউট থাকব। মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে। হা হা হা।”

সকালের বাতাস কাঁপিয়ে প্রাণখুলে হাসেন বাবা।

“শুরু হল তোমার রবীন্দ্রনাথ! আচ্ছা বাবা, এ বাড়িতে তুমি ছাড়া আর কে রবীন্দ্রভক্ত বলতে পার?”

“তুই।” বলেই তার দিকে তাকিয়ে গোঁফের ফাঁক দিয়ে মিষ্টি করে হাসেন বাবা।

“জানলে কী করে?”

“আমি তোর বাবা, না তুই আমার বাবা?”

বলেই গলা ছেড়ে আবারও হেসে ওঠেন বাবা। তখন চারদিকে ঝলমলে আলো। পাখিদের কোলাহল একটু থেমেছে। ধানমন্ডির এই বাড়িটা পাখিদের একটা খামারই বলা যায়। বাড়ির বড়কর্তা এখনও কবুতর পোষেন। আর নানান পাখি সকালসন্ধ্যা আড্ডা বসায় বাড়িটার গাছে গাছে।

ভোরের পরে, সকালের প্রথম প্রহরে, বাবা আর বাড়ির ছোটছেলের আড্ডায় এসে যোগ দেন আরও কয়েকজন-- মা, হাসুপু, রেহানাপু আর দুই ভাবি। তাদের হাতে বাগানের তাজা ফুল। সব ফুলই আজ তার জন্য। দুই ভাই-- কামালভাই ও জামালভাই এখনও জাগেননি। ভাইয়ের সন্তান, বোনের সন্তানরা থাকে দেশের বাইরে। পড়াশোনা শেষে আপাতত পশ্চিমেই বসবাস করছে তারা।

হাসুপু স্নিগ্ধ করে হেসে বললেন, “হ্যাপি বার্থডে।”

বড় বোনের শুভেচ্ছা শরীর-মনে মেখে নিয়ে একটু এগিয়ে গেলেন তিনি। পা ছুঁয়ে সালাম করতে গেলেন। হাসুপু তাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। বড় বোনের আদরের বন্ধন ছাড়িয়ে তিনি গেলেন মায়ের কাছে। মা কোনো কথা না বলে অনেকক্ষণ বুকে ধরে রাখলেন তার ছোটছেলেকে। রেহানাপু আর দুই ভাবি একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকলেন দৃশ্যটি। বড়ভাবি বলেই ফেললেন, “মা ওকে ছেড়ে দাও। তুমি কি এখনও ওকে পাঁচ বছরের খোকা পেয়েছ?”

“পাঁচ বছর কী রে! ও তো আমার কাছে এখনও পাঁচ মাসের শিশু। কী যে জ্বালাত সে বয়সে! সারারাত জাগিয়ে রাখত।”

মায়ের কথায় একটু লজ্জা পান তিনি। নিজেকে ছাড়িয়ে নেন মায়ের বুক থেকে। মায়ের আদরে এক মুহূর্তেই অবুঝ শিশুতে পরিণত হয়েছিলেন দুনিয়াখ্যাত এই ‘আকাশবিজ্ঞানী’।

“আয়, আমার কাছে আয়। আর ন্যাকামো করতে হবে না।” স্নেহঝরা গলায় বলেন রেহানাপু।

এভাবেই জন্মদিনের সকালটা শুরু হয় তার। তিনি গাছগাছালির উপর দিয়ে দক্ষিণ আকাশে তাকান। কেবলই সাদা, হালকা মেঘেরা উড়ে বেড়াচ্ছে। আকাশময় ঝলমলে আলো। পাতায় পাতায় আলোর নাচন।

এর মধ্যেই পুরো বাড়িটা জেগে উঠেছে। তার স্ত্রী বারান্দায় এসে পা ছুঁয়ে সালাম করেছেন শ্বশুর-শাশুড়িকে। আদরের দুই সন্তান ‘হ্যাপি বার্থডে বাবা’ বলে তার বুকে লুটিয়ে পড়েছে। সকালে, একের পর এক দৃশ্যগুলো দেখে ৯২ বছরের মানুষটির চোখে জল এসে যায়।

ছেলের জন্মদিনের এই মিষ্টি আয়োজন দেখে বৃদ্ধ মায়ের মন ভিজে যায়। ভীষণ কান্না পায় তার। সৃষ্টিকর্তার কাছে তিনি কৃতজ্ঞতা জানান, তার পরিবারে এমন সুখ আর আনন্দ দেওয়ার জন্য। তার পরিবারের এমন আনন্দ আর শান্তি যেন দেশের প্রতিটি ঘরে থাকে, সেই প্রার্থনাও করেন তিনি।

তারপর ৪৭ বছরের মেধাবী মানুষটির জন্মদিনকে ঘিরে শুরু হয় সারাদিনের আয়োজন। মা রাঁধেন ছেলের পছন্দের সব পদ। বাবা ছেলেকে পাশে বসিয়ে ভরাট কণ্ঠে আবৃত্তি করে শোনান রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দ দাশের কবিতা। দুইবোন জীবনের উচ্ছ্বাসে গেয়ে শোনান জন্মদিনের গান। তার ছেলেবেলায় বড় দুইভাই তাকে নিয়ে যেমন খেলায় মেতে উঠতেন, আজও তেমনটি করতে শুরু করেন। এটা তিনভাইয়ের অন্যরকম এক খেলা।

বেলা বাড়তে থাকে। দেশ-বিদেশ থেকে সেলফোনে জন্মদিনের শুভেচ্ছা উড়ে আসে। অনেক অনেক। সব কিছু দেখেশুনে তার নতুন করে মনে হয় বেঁচে থাকাটা অনেক আনন্দের। অনেক, অনেকদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে তার।

এইটুকু গল্প। ২০১২ সালের ১৮ অক্টোবরের গল্প।

ভেবে নিচ্ছি আমাদের জীবনে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেই নির্মম ঘটনাটা ঘটেনি। এখনও পৃথিবীতে সজীব। বেঁচে আছেন বাঙালি জাতির মুক্তিদাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার পরিবারের কাউকে সেই রাতে হত্যা করেনি অন্ধকারের মানুষেরা। আর আজ বাড়ির ছোট ছেলে শেখ রাসেলের জন্মদিন।

কিন্তু সেই ইতিহাসটা বড় ভয়ঙ্কর। কলঙ্কময় সেই রাতে অনেক মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটতে থাকে। এক পর্যায়ে ঘুমভাঙা ছোট্ট রাসেলকে দাঁড় করানো হয় লাইনে। প্রবল ঝড়ে কচিপাতা যেমন কেঁপে কেঁপে ওঠে, তেমনি থরথর করে কাঁপছিল কচিমুখ ছেলেটি। মনে পড়ছিল মায়ের মুখ।

লাইনে দাঁড়িয়ে শেখ রাসেল প্রথমে রমাকে (গৃহকর্মী) ও পরে মহিতুল ইসলামকে (রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত সহকারি) জড়িয়ে ধরে বলে, “ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো?”

মহিতুল জবাব দেয়, “না ভাইয়া, তোমাকে মারবে না। এ সময় শেখ রাসেল তার মায়ের কাছে যেতে চাইলে আজিজ পাশা (খুনিদের একজন) মহিতুলের কাছ থেকে জোর করে তাকে দোতলায় নিয়ে যেতে বলে। আজিজ পাশার কথামতো এক হাবিলদার শেখ রাসেলকে দোতলায় নিয়ে যায়। ১০ বছরের শিশুটির শেষ আর্তিও শোনেনি ঘাতকরা। তাকে তার মায়ের কাছে যেতে দেয়নি। ছোট্ট কোমল শরীরটাকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে তারা। রাসেলের দেহটি পড়ে থাকে সুলতানা কামালের (বড়ভাই শেখ কামালের স্ত্রী) পাশে।”

সেই থেকে রাসেল একটা বেদনার গল্প হয়ে আছে সবার হƒদয়ে। ধানমন্ডির সেই বাড়িটি, পুরনো অনেক গাছ, শরতের আকাশ, বাড়ির সামনের সড়ক, রাসেলের ডানাওয়ারা সাইকেল, শান্ত লেক সবাই জানে সেই শোকের কথা। আর নতুন গাছের পাতারা, উড়াল মেঘ, পাখিরা দিনে দিনে জেনে গেছে সেই ইতিহাসও। তাই ১৮ অক্টোবর এলেই তাদের মন খারাপ হয়। খু-উ-ব খারাপ।