অ্যালিসন জোলির লেমুর

পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম দ্বীপ মাদাগাস্কার। ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপটির আয়তন ২ লক্ষ ২৬ হাজার ৬৫৮ বর্গমাইল। এই দ্বীপে রয়েছে নানান রকম বিচিত্র প্রাণী আর গাছ। সতের শতকেও এখানে ছিল বিশালাকার হস্তীপাখি, বৈজ্ঞানিক নাম (Aepyornis titan)।

রহীম শাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Oct 2013, 01:10 PM
Updated : 15 Oct 2013, 01:48 PM

কিন্তু মাদাগাস্কারের সবচাইতে রহস্যময় প্রাণীটি হল লেমুর। মাদাগাস্কার জঙ্গলের কাঠুরেরা এদের ‘বেজি’ বলে ডাকে। দ্বীপটির আদি বাসিন্দা এরা। পৃথিবী থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল প্রাণীটি। শরীরের তুলনায় মাথাটা কিছু মোটা। লম্বা কালো লোমশ লেজ। সবচাইতে অদ্ভুত হল ওদের চোখ দুটি। খুবই সুন্দর। জ্বলজ্বল করে। মাথা ঘাড় রুপোলি-কালো লোমে ভর্তি।

এই লেমুররা খুবই সাবধানী প্রাণী। পাতার মধ্যে পোকামাকড়ের চলাফেরাও টের পেয়ে যায়। আর থাকেও খুব দলবদ্ধভাবে। দলের কোনো সদস্য যদি কোনো কারণে দলছুট হয়ে যায়, তাহলে ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়ে। পাগলের মতো এদিক সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকে সঙ্গীদের খোঁজে। আবার সঙ্গীদের দেখা পেলে ভাবখানা এমন করে, যেন এরমধ্যে কিছুই ঘটেনি। শুধু তাই না, ওদের যথেষ্ট সামাজিক জ্ঞানও রয়েছে।

বর্তমানে পৃথিবীতে মোট সতের প্রজাতির লেমুর দেখতে পাওয়া যায়। পোকামাকড়, গাছের পাতা এদের প্রধান খাবার। বর্ষাকালে এক অদ্ভুত উপায়ে এদের লেজে চর্বি জমে যায়। তখন সেই লেজে-জমানো-চর্বির উপর ভিত্তি করেই এরা টিকে থাকে।

অন্তত ছয় কোটি বছর আগে থেকেই এই জাতীয় প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল। অনেকে বলে, তারও অনেক আগে থেকেই বসবাস করে আসছে ওরা। তিন কোটি বছর আগে আফ্রিকার জঙ্গল থেকে এরা হারিয়ে যায়। জীবজ্ঞিানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, প্রায় চল্লিশ লক্ষ বছর আগে ডালপাতা-কাঠকুটো চড়ে লেমুররা ভাসতে ভাসতে মাদাগাস্কার দ্বীপে এসে পৌঁছায়।

মাদাগাস্কার দ্বীপের জনসংখ্যা প্রায় এগার লক্ষ। এদের বেশির ভাগের জীবিকা চাষবাস আর কাঠ চেরাই। পশুপালনও করে থাকে অনেকে। দ্বীপের মানুষেরা হতদরিদ্র। তাই নির্বিচারে গাছপালা কাটা চলে জ্বালানি সংগ্রহের জন্য। তাই মাদাগাস্কারের বনভূমি এখন হুমকির সম্মুখীন। ১৯৫০ সাল থেকে সেখানকার অরণ্য কমতে শুরু করেছে। এখন প্রায় অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে। মাদাগাস্কারের অরণ্যের অন্যান্য প্রাণীদের সঙ্গে তাই এই রহস্যময় প্রাণীও বিপন্ন। প্রাণিবিজ্ঞানীরা লেমুরদের বাঁচাবার জন্য রীতিমতো আন্দোলন করছেন।

এবার মূল গল্পে প্রবেশ করা যাক। ১৯৮৭ সালের কথা। একজন প্রাণিতত্ত্ববিদ মাদাগাস্কারের গভীর অরণ্যে চষে বেড়াচ্ছিলেন। লেমুরের খোঁজে। দীর্ঘদিন ধরেই ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। ঘুরতে ঘুরতে শেষমেশ তিনি তিনি পেয়েও গেলেন বাঁশ পাতাভোজী ছোট ধূসর রংয়ের এক জাতের লেমুর।

লেমুরের খোঁজে প্রাণপাত করা এই প্রাণিতত্ত্ববিদের নাম অ্যালিসন জোলি। পৃথিবী বিখ্যাত প্রাইমেট বিশেষজ্ঞদের একজন তিনি। লেমুরতত্ত্ববিদ হিসেবেও সমান পরিচিতি তার। তিনি যখন প্রথম লেমুর দেখতে পেলেন, তখন তার কী যে আনন্দ হয়েছিল! তার ভাষাতেই শোনা যাক--

“অরণ্যের গভীরে তখন গোধূলির আলোছায়া। আকাশের গা থেকে তারারা যেন টুপটাপ খসে পড়তে চায় গাছে, পাতায়। এক অপার নিস্তব্ধ রহস্যময়তায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে বনজঙ্গল। সেই নৈঃশব্দের মধ্যে হঠাৎই চোখে পড়ল একটা অন্ধকার ছায়া। সামনের দীর্ঘ ঋজু গাছটির পাতার ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। যেন আমাকে দেখে ভীত নয় সে, একটু একটু পুলকও জাগল তার। জ্বলজ্বলে চোখে পিটপিট করে খুব মনোযোগে নিরীক্ষণ করল আমাকে। তারপর সেই ছায়াপ্রাণীটি ডালে ডালে দোল খেল। হঠাৎই ঝাঁপ দিল সামনের এক পাম গাছে। সেখান থেকে মুহূর্তেই পৌঁছে গেল নারকেল গাছটির একেবারে মাথায়।

“অবলীলায় সেই ছায়াপ্রাণীটি চিবুতে লাগল একটা বেশ বড়সড় নারকেল। আমি এবার আলো জ্বাললাম। সরু তীব্র আলোর ঝলক বিঁধল তার গায়ে। বিস্ময় বিমূঢ় চোখে দেখলাম আলোর প্রান্তে বসে আছে লেমুর পরিবারের এক আশ্চর্য সদস্য। পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম দ্বীপ মাদাগাস্কারের আদি বাসিন্দা। একটা বাচ্চা ছেলের মতো সে আমার দিকে তাকাল। চোয়াল ও নাক খাড়া, লম্বা লম্বা দাঁত, উজ্জ্বল চোখ-- সব মিলিয়ে একটা দুষ্টু দুষ্টু চেহারা। দাঁত বের করে আমার দিকে তাকিয়ে যেন একটু মুচকি হাসল। তারপর আবার খুব ব্যস্তভাবে তীক্ষ্ণ দাঁত দিয়ে নারকেলটি চিবুতে থাকল। আঙুলের লম্বা সরু নখও কাজে লাগাল সে। খাওয়া শেষ করে দাঁত দিয়ে নখ পরিষ্কারও করল খুব নিখুঁতভাবে।”

আরও একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার আছে প্রাণিতত্ত্ববিদ অ্যালিসন জোলির। মাদাগাস্কার দ্বীপেই তিনি আবিষ্কার করেন আর এক এক জাতের লেমুর। ইঁদুরের মতো দেখতে পিচ্চি লেমুর।

তার এই আবিষ্কারটির কথা অবশ্য হুট করেই প্রকাশ করেননি তিনি। পিচ্চি লেমুরটির আদ্যোপান্ত জেনে, দীর্ঘ তিন দশক পর ২০০৬ সালে তিনি consumer magazines and scientific journal-এ তার আবিষ্কার সম্পর্কিত গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তার এই আবিষ্কারে তোলপাড় শুরু হয় সারা বিশ্বে। প্রাইমেট বর্গের এই পিচ্চি লেমুরকে এর আগে কেউ দেখেনি। বিশ্বের তাবৎ প্রাণিতত্ত্ববিদ অ্যালিসন জোলির আবিষ্কারকে সম্মান জানিয়ে এই পিচ্চি লেমুরের বৈজ্ঞানিক নামই দিয়ে দিয়েছে তার নামে-- মাইক্রোকেবাস জোলিয়া (Microcebus jollyae)।