শামসুর রাহমানের ছড়াসাহিত্য

শামসুর রাহমান। বর্তমান বাংলা কবিতার প্রধানতম পুরুষ। যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। বিষয়, বৈচিত্র্য, আঙ্গিক ও উপস্থাপনায় তাঁর কবিতা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল। সমস্ত কাঁটা ছিন্ন করে তিনি উপস্থিত হয়েছিলেন সকল শ্রেণির পাঠকের কাছে। হয়ে ওঠেছেন গ্রহণীয় ও প্রিয়।

>> রাশেদ রউফবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 August 2013, 01:08 PM
Updated : 17 August 2013, 01:14 PM

বহু দুর্গম পথ পেরিয়ে শামসুর রাহমান পৌঁছেছেন তাঁর গন্তব্যে। পরম নিষ্ঠা ও সাধনার মাধ্যমে তিনি অর্জন করেছেন তাঁর অবস্থান; অলংকৃত করেছেন শ্রেষ্ঠ কবির মোহনীয় আসন। তাঁকে বলা হয় কাব্যদেশের রাজপুত্তুর। যদিও তাঁর রূপ ঝলসানো পোশাক ছিল না, কিন্তু তিনি ছিলেন আকর্ষণীয়।

তাঁর ডানাঅলা পক্ষিরাজ ঘোড়া ছিল না। তবে উড়ে এবং ঘুরে বেড়ানোই ছিল তাঁর শখ। ‘ধুলোওড়া পথ ছায়ামাখা পথ, লোক গিজগিজ পথ, সুনসান পথ’-- সবরকম পথে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগত তাঁর। ঘুরেছেন, ঘুরে ঘুরে দেখেছেন পৃথিবীর তাবৎ জিনিস। গাছগাছালি, পাখপাখালি নোড়ানুড়ি, পুকুর, নদী-- সবকিছু তিনি যেতে যেতে চেয়ে চেয়ে দেখেছেন এবং এঁকে নিয়েছেন বুকের ভেতর সকল দৃশ্যপট-- ভাবনার তুলি দিয়ে।

তাঁর আঁকা দৃশ্য এত সুন্দর, চমৎকার ও প্রাণবন্ত যে, বুঝতে দ্বিধা হওয়া অস্বাভাবিক নয়, এটা কি আঁকা দৃশ্য! শিল্পীর আঁকা ছবি এবং তাঁর আঁকা ছবির মধ্যে তফাৎ আছে। শিল্পী আঁকেন তুলিতে, চেষ্টা করেন আঁকা দৃশ্যের সঙ্গে মূল দৃশ্যের অবিকল মিলের। কিন্তু তিনি এঁেকছেন কবিতায়। ছন্দ দিয়ে, মাত্রা দিয়ে, পর্ব, অতিপর্ব, ভাঙাপর্ব, মধ্যমিল এবং অন্ত্যমিল দিয়ে তিনি এঁকেছেন তাঁর এক একটি দৃশ্য। শিল্পীর আঁকা দৃশ্য চোখে পড়লেই কিছুটা বুঝে নেওয়া গেলেও তাঁর দৃশ্য বুঝতে অন্ততপক্ষে কিছু সময়ের প্রয়োজন। প্রথমে পড়া, তারপর বোঝা।

শামসুর রাহমান মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। তিনি বসে থাকেননি তাঁর জায়গায়। তিনি হেঁটেছেন, তিনি চলেছেন, তিনি ছুটে গেছেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। ‘অজস্র করতালি আর পুষ্পবৃষ্টি’ তাঁর চলার পথকে করে তুলেছে আরও মসৃণ, আরও সরল ও পরিচ্ছন্ন।

আধুনিক কবিতা নির্মাণে শামসুর রাহমান অধিক সফল, জনপ্রিয় ও স্বতঃস্ফূর্ত হলেও তিনি শুধু সেই মাধ্যমেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি বিচরণ করেছেন সাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও। একীভূত হওয়ার চেষ্টা করেছেন প্রত্যেকটি শাখার সবেগে বহমান স্রোতের সঙ্গে  বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যেও শামসুর রাহমানের আন্তরিক উপস্থিতিতে হয়ে উঠেছে সমৃদ্ধও উজ্জ্বল। তাঁর রচিত ছড়া কবিতাগুলো আমাদের শিশুসাহিত্যের বড় সম্পদ।

‘এলাটিং বেলাটিং’, ‘ধান ভানলে কুঁড়ো দেব’, ‘গোলাপ ফোটে খুকির হাতে’, ‘লাল ফুলকির ছড়া’, ‘রংধনুর সাঁকো’, ‘নয়নার জন্য’, ‘শামসুর রাহমানের ছড়াসমগ্র’ প্রভৃতি শামসুর রাহমানের প্রকাশিত ছড়া ও কবিতার বই। প্রতিটি বইয়ের প্রতিটি লেখার মধ্যেই ফুটে উঠেছে শিশুর প্রতি কবির অকৃত্রিম ভালোবাসা ও দরদ। তাঁর ছড়ায় আছে ছোটদের মনভোলানোর রূপকথার কাহিনি, আছে স্বপ্নরাজ্যের হাতছানি। তিনি শিশুদের জোছনা রাতে পরির নাচ দেখাতে চেয়েছেন। জানালা দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন সোনার গাছ। তাই প্রথম ছড়াগ্রন্থ ‘এলাটিং বেলাটিং’-এর উৎসর্গ পৃষ্ঠায় লিখেছেন--

যারা জোছনা রাতে দেখে পরির নাচ

যারা জানলা দিয়ে দেখে সোনার গাছ

যারা হয়রে মাঝি নায়ের মতো চাঁদের

চাঁদের, চাঁদের চাঁদের

আমার ছড়া এ বই হাতে দেব তাদের

তাদের তাদের তাদের।

আসলে তিনি শিশুকে একান্ত শিশু করেই রাখতে চেয়েছেন। পৃথিবীর সকল ঘাত-প্রতিঘাত, দুঃখ-কষ্ট যেন শিশুর শরীর স্পর্শ করতে না পারে, তা-ই তিনি চেয়েছেন। ছোটদের শুধু স্বপ্ন দেখাতে গিয়েই তিনি ছড়ায় ঘুরে ফিরে এনেছেন শিশুরঞ্জনি ছবি। আদি ছড়ার অকৃত্রিম রসকে সম্বল করে তিনি এগিয়ে নিয়েছেন তাঁর লেখাগুলোকে।

আঁটুল বাঁটুল শামলা সাঁটুল শামলা গেছে হাটে

কুঁচবরণ কন্যে যিনি, তিনি ঘুমান খাটে।

খাট নিয়েছে বোয়াল মাছে, কন্যে বসে কাঁদে,

ঘটি-বাটি সব নিয়েছে কিসে তবে রাঁধে?

আর কেঁদো না আর কেঁদো না ছোলাভাজা খেয়ো,

মাটির উপর মাদুর পেতে ঘুমের বাড়ি যেয়ো।

(আঁটুল বাঁটুল ছড়া)

এ ধরনের বহু ছড়া আছে শামসুর রাহমানের। আদি ছড়ার রূপ, বৈশিষ্ট্য, চিত্রকল্প-- সবই অক্ষুণ্ন রয়েছে তাঁর এ লেখাগুলোতে। শিশুকে স্বপ্নরাজ্যে পৌঁছানোর জন্য তাঁর সে নিরন্তর চেষ্টা, তা প্রতিফলিত হয়েছে এসব ছড়ায়। তবে লোকছড়ায় আটপৌরে ধারাকে আঁকড়ে ধরে তিনি ছড়া রচনা করতে চাননি। মূলত কবি বলেই তিনি ছড়ার ভেতরে আনতে পেরেছেন কাব্যিক লাবণ্য। ছড়ার প্রাচীন ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয় ঘটাতে চেষ্টা করেছেন বহু লেখায়। যেমন--

আকাশটাকে পাল্টে দিতে পারবে কি ভাই তুমি?

পারবে কি আজ করতে তাকে নীলচে কোনো ভূমি?

নয়কো মোটে ঠাট্টা কোনো শোনো আমার মিতে,

করতে পারো নদীটাকে বোনোর চুলের ফিতে?

(পারবে কি)

এই ছড়ার ভেতর যেমন কাব্যের স্পর্শ পাই, তেমনি পাই আধুনিকতার ঢং। ‘নদীটাকে’ বোনোর ‘চুলের ফিতে’ বানিয়ে দেওয়ার মধ্যে যে সৌন্দর্যের খেলা দেখানো হয়েছে, তা কেবল একজন কবির পক্ষেই সম্ভব। এ রকম আরেকটি ছড়া--

আমার ছড়ার বাক্স থেকে / ঢালব এমন নীল,

আকাশ-পাতাল খুঁজলে তবু / পাবে না তার মিল।

আমার তুলির ছোঁয়ায় সাদা / পাতায় পড়বে দাগ,

হরিণ যাকে ভয় পাবে না / গড়ব তেমন বাঘ।

রংয়ের ছোপে উঠবে হেসে / পাথর কাটা পথ,

চিলেকোঠায় থামবে এসে / সুয্যিমামার রথ।

শামসুর রাহমান তাঁর প্রতিটি ছড়া-কবিতায় নিজের ভাবনার কথা শোনাতে চেয়েছেন শিশুদের। তাঁর স্বপ্নের কথা, তাঁর ছেলেবেলার কথা জানাতে চেয়েছেন ছন্দে ছন্দে। কবি নিজের ছেলেবেলাকে কখনও ছোট্ট ভেলা, কখনও হীরের ফল, কখনও কিরণমালার পায়ের মল, কখনও মজার খেলা হিসেবে দেখেছেন। বলেছেন--

স্বপ্নঢাকা রাতের বেলা

তুমি কি ভাই মজার খেলা?

ছোট্ট আমার ছেলেবেলা

লক্ষ্মী আমার ছেলেবেলা!

শামসুর রাহমান স্বপ্ন দেখতে যেমন ভালোবাসতেন, তেমনি ভালোবাসতেন স্বপ্ন দেখাতেও। ‘পয়সা ছাড়াই বিলায় কী যে হয় না কিছুই দেরি / নয়কো মোতি নয়কো পুঁতি, ¯^প্ন করে ফেরি।’

তিনি বরাবরই স্বপ্ন ফেরি করে বেড়ান। কিন্তু তাঁর ¯^প্ন কী?

স্বপ্ন আমার গলির মোড়ে/ একলা লাজুক গাছ,

স্বপ্ন আমার ছাদের উপর / পক্ষিরাজের নাচ।

উপমা অলংকারে, চিত্রকল্পে তাঁর ছড়াগুলো পেয়েছে বাড়তি ব্যঞ্জনা। শিশুদের নির্মল আনন্দ দান এবং তাদের মন মানসিকতাকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শিশুতোষ ছড়ার যে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রয়েছে, তা স্মরণে রেখেই তিনি নির্বাচন করেছেন ছড়ার বিষয়বস্তু। তাই তাঁর বিভিন্ন ছড়ায় পাওয়া যায় পদ্মদিঘি, ঝুমকো লতা, পক্ষিরাজ, দুধ  সাগরের ঢেউ, জোনাক পোকা, কাজল বিল, পাখি, ফুল, আকাশ, নদী ইত্যাদি অনুষঙ্গ।

তবে ছড়ায় সমসাময়িক চিত্র ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি পিছিয়ে ছিলেন, এমন কথাও বলা যাবে না। তাঁর বহু ছড়াতেই আছে সমাজমনস্ক বক্তব্য, আছে প্রতিবাদী চেতনার রূপ। কখনও প্রতীকী ঢংয়ে, কখনও ব্যঙ্গভাবে তিনি উপস্থাপন করেছেন সমাজের সমসাময়িক চিত্র। যেমন--

যাস নে খোকন যাস নে/ মামার বাড়ি যাস নে

চাস নে রে তুই চাস নে/ কৈ-চিঁড়ে দৈ চাস নে।

দৈ পাবে কই? দুধ নেই।

কৈ পাবে কই? ধান নেই।

কাক করে কা কা

মামার বাড়ি খাঁ খাঁ।

অথবা

চিল শকুনের আওয়াজ আসে

ফুঁসছে শুধু সাগর পাড়ের ঢেউ।

দিনদুপুরে, রাতদুপুরে

উড়িরচরে রইল না আর কেউ।

সবাই করে আহা উহু

কার কাহিনি কে শোনে?

চায়ের চিনি উধাও হল

চাল মেলে না রেশনে।

সর্ষে তেলের ঘ্রাণ পাওয়া ভার

নেইকো করে জ্বালানি

পণ্যগুলো হচ্ছে লোপাট

ধন্য চোরাচালানি।

(ছড়া)

অথবা

ফাও পেতে চাও? ফাও?

ওয়াসার কাছে চাও।

পানির সঙ্গে পাবে

গুবরে পোকার ছা-ও।

(ফাও)

তাঁর ছড়ায় বন্যা, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, খরা যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে রাজনীতি। ‘বক্তা’ শীর্ষক ছড়াতে ফুটে উঠেছে এক রাজনৈতিক নেতার চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য।

একজন লোক আছে চৌকশ বলিয়ে

তিলকে সে তাল করে বিদ্যেটা ফলিয়ে

কী যে বলে রাত দিন দেখে না তো তলিয়ে।

আবার ‘নেতা’ শীর্ষক ছড়ায় দেখি--

কালো টাকার পাহাড় ধরা

মহাপ্রভুর ধামা গড়া

টাকার জোরে ভোট বাগানো

মিথ্যে কথায় লোক খ্যাপানো

মঞ্চে উঠে বক বকানো

যখন তখন লোক-ঠকানো-

এই আমার কেতা,

মস্ত আমি নেতা।

বাংলা ভাষার আদিতম ছন্দ স্বরবৃত্তকেই শামসুর রাহমান বেছে নিয়েছেন তাঁর ছড়া রচনায়। বেশিরভাগ ছড়াই স্বরবৃত্তে রচিত হয় বলে বুদ্ধদেব এ ছন্দের নাম দিয়েছেন ‘ছড়ার ছন্দ’। আসলে এ ছন্দের প্রতি পক্ষপাত রবীন্দ্রনাথেরও ছিল। যদিও তাঁর বেশিরভাগ কবিতা অক্ষরবৃত্তে রচিত। তিনি লিখেছেন-- “ভাষার উচ্চারণ অনুসারে ছন্দ নিয়মিত হইলে তাহাকেই স্বাভাবিক ছন্দ বলা যায়।...যদি কখনও স্বাভাবিক দিকে বাংলা ছন্দের গতি হয়, তবে ভবিষ্যতের ছন্দ রামপ্রসাদের ছন্দের অনুযায়ী হইবে।”

শামসুর রাহমানও আধুনিক কবিতা রচনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অক্ষরবৃত্তকে অবলম্বন করলেও ছড়া রচনায় ‘ছড়ার ছন্দকেই’ প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ‘বক্তা’ ‘একটি ঘোড়া’ ‘নজরুল’ ‘বর্গি তাড়ানো গান’ ‘বিজয় দিবস’ ‘রাঙা উৎসব’ ‘অন্তরভাবে’ শীর্ষক এই সাতটি ছড়া (মাত্রাবৃত্ত) বাদে তাঁর সমগ্র ছড়াসাহিত্যই স্বরবৃত্তে রচিত। ফলে তাঁর প্রতিটি ছড়াকে মনে হতে পারে একই মেজাজের।

ঝক ঝকাঝক ট্রেন চলেছে

রাত দুপুরে অই

ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে

ট্রেনের বাড়ি কই?

(ট্রেন)

জল টুপটুপ দিঘির পাড়ে ডালিম গাছের ডাল

ডালিম গাছে জল ঢেলেছে খুকুমণি কাল।

(জল টুপটুপ)

আধুনিক কবিতায় শামসুর রাহমান যেভাবে ছন্দের নিরীক্ষা করেছেন, ভাঙচুর করেছেন, তার বিন্দুমাত্র নিরীক্ষা ছড়ায় দেখাননি। ফলে তাঁর আধুনিক কবিতায় ছন্দের যে বৈচিত্র্য খুঁজে পাওয়া যায়, তা পাওয়া যায় না ছড়ায়। আমার মনে হয়েছে যে তিনি স্বেচ্ছায় এ দিকটি এড়িয়ে গেছেন। ছোটদের ঝামেলামুক্ত রাখতে চেয়েছেন বলেই সম্ভবত তিনি ছড়ায় একাধিক ছন্দ প্রয়োগে পক্ষপাতি ছিলেন না। 

এককথায় বলা যায়, বিষয়ে বক্তব্যে বৈচিত্র্যে উপস্থাপনায় শামসুর রাহমানের ছড়াগুলো আমাদের শিশুসাহিত্যের উজ্জ্বল সম্পদ। তাঁর ছড়া যেমন শিশুদের ঘুম পাড়ায়, স্বপ্ন দেখায়; তেমনি ঘুম ভাঙায় এবং সামনে অগ্রসর হতে শেখায়। তিনি যেমন আমাদের সামগ্রিক সাহিত্যের এক গর্বিত পুরুষ, তেমনি আমাদের শিশুসাহিত্যেরও অহঙ্কার।

২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট আমরা হারাই তাঁকে। প্রয়াণ দিবসে তাঁকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।