ভালোবাসার মূল্য দিতে পারেনি যে জুটি

সেলুলয়েড অনেক সময়ই বাস্তব রোমান্সের দলিল হয়েছে। পর্দায় প্রেমিক-প্রেমিকার অভিনয় করতে গিয়ে অনেক জুটিই প্রেমে পড়েছেন এবং সেই প্রেমের প্রতিফলন আবার ঘটিয়েছেন পর্দায়। তেমনই এক ছবি সোহেল রানা ও সোমা মুখার্জি অভিনীত 'এপার ওপার'।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Feb 2016, 06:49 AM
Updated : 11 Feb 2016, 06:49 AM

পাহাড়ি গ্রামের এক দামাল ছেলে। বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে আলি নিঃস্বার্থভাবে সকলের উপকার করে। তাই গ্রামের সকলের চোখের মণি সাহসী আলি। সেই গ্রামেরই মেয়ে আসমা ভালোবাসে আলিকে। কিন্তু আলি খুব গরীব ঘরের ছেলে আর আসমার বাবা ধনী। তাই গ্রামের সকলে আলিকে ভালোবাসলেও আসমার বাবা খাঁ সাহেব চায় মেয়ের জীবন থেকে তাকে সরিয়ে দিতে। গ্রামের জমিদারের নানা রকম অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদ জানায় আলি। তাই গ্রামের জমিদারও তার বিরুদ্ধে ।জমিদারকে আরও ক্ষেপিয়ে তোলে  জমিদারের পারিষদ আসমার বাবা।

গ্রাম থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার পরিকল্পনা করে আসমা ও আলি। একটি নির্দিষ্ট স্থানে দেখা করার কথা হয়। এদিকে আলির নামে মিথ্যা চুরির অপবাদ দিয়ে তাকে কয়েদখানায় বন্দি করে রাখে জমিদার।| আসমা নির্দিষ্ট স্থানে এসে তাকে না পেয়ে ফিরে যায়। আলি কৌশলে বন্দিশালা থেকে পালায়। সে আগুন লাগিয়ে দেয় জমিদারের খামারে। প্রতিহিংসাপরায়ণ জমিদার তার মাকে হত্যা করে। মায়ের হত্যাকারীকে খুন করে সে। জমিদারের লোকজনের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে আলি। সে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকে আর জমিদারের লোকজনের উপর গেরিলা কায়দায় হামলা চালায়। গ্রাম থেকে পালিয়েও যেতে হয় আলিকে। জঙ্গলে লুকিয়ে আলি ও আসমা দেখা-সাক্ষাৎ চালিয়ে যায়। আসমা ধরা পড়ে জমিদারের লোকদের হাতে। আসমাকে পাথর ছুঁড়ে হত্যার হুমকি দেয় জমিদার। এক শর্তে আসমাকে রেহাই দেওয়া হবে যদি আলি চলে যায় এলাকা ছেড়ে এবং নিজের ঘর আগুনে জ্বালিয়ে দিয়ে যায়। আসমাকে বাঁচাতে জমিদারের শর্ত মেনে এলাকা ছেড়ে চলে যায় আলি। আসমার জীবন হয়ে ওঠে বিষাদময়।

আসমার অমতে অন্যত্র তার বিয়ের আয়োজন করে খাঁ সাহেব। এদিকে আসমা প্রতীক্ষা করে তার প্রেমিক আসবে। কিন্তু আলি আসে না। অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারবে না বলে বিয়ের আসরে বিষ পান করে আসমা। বিয়ের আসরে উপস্থিত হয় আলি।  আসমা ছুটে আসে তার কাছে। আলির বুকে মাথা রেখে মৃত্যু হয় তার। আসমার মৃতদেহ নিয়ে যেতে থাকে আলি। তখন খাঁ সাহেব হত্যা করে তাকে। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে চিরদিনের জন্য মিলিত হয় প্রেমিক-প্রেমিকা।

এই ছিল পুরনো দিনের বাংলা ছবি ‘এপার ওপার’-এর কাহিনি। আজারবাইজানের উপকথা অবলম্বনে গড়ে ওঠে কাহিনিটি। ছবিতে প্রযোজক-পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার ছিলেন মাসুদ পারভেজ। তিনি সোহেল রানা নামে ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ও করেন। আসমা চরিত্রে ছিলেন ওপার বাংলার শিল্পী সোমা মুখার্জি। সোমা মুখার্জিকে এ ছবিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল ঘটনাচক্রে। ছবিতে অভিনয় করার কথা ছিল সুচরিতার। কিন্তু শুটিংয়ের চার দিন আগে তার নানী অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি অপরাগতা প্রকাশ করেন। তখন ছবির আরেক শিল্পী সুমিতা দেবী সোহেল রানার কাছে কলকাতার অভিনেত্রী সোমা মুখার্জির নাম প্রস্তাব করেন। সিনেমার অধিকাংশ দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল সিলেটের জয়ন্তিয়াপুরে। সোমার বাবা মেয়েকে নিয়ে কলকাতা থেকে সোজা জয়ন্তিয়াপুরে চলে যান। এ ছবিতে একটি দৃশ্যে পাহাড় থেকে গড়িয়ে নামার সময় বেশ আঘাত পান সোহেল রানা। সে সময় দৌড়ে আসেন সোমা মুখার্জি। উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন তার জন্য। এভাবে তাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।

ছবিতে অভিনয়ের সময় তরুণ সোহেল রানা প্রেমে পড়েন সুন্দরী সপ্রতিভ সোমা মুখার্জির। সোমাও তাকে ভালোবেসে ফেলেন। তারা দুজনে বিয়ের কথাও ভাবেন। কিন্তু বাধ সাধেন সোমার বাবা। কারণ উঠতি নায়িকা বিয়ের পিঁড়িতে বসলে তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে। মেয়েকে নিয়ে তিনি কলকাতায় ফিরে যান। পরবর্তীতে কলকাতার ছবিতে অবশ্য সোমা মুখার্জি তেমন কোনো অবস্থান গড়তে পারেননি।

অন্যদিকে সোহেল রানার ক্যারিয়ার সাবলীলভাবে এগিয়ে যায়। নায়ক হিসেবে তিনি যেমন সাফল্য পান তেমনি প্রযোজক পরিচালক হিসেবেও । তিনি নিজের সংসার ও ক্যারিয়ার সফলভাবে গড়ে তোলেন। পরে অনেক সাক্ষাৎকারেই তিনি পছন্দের নায়িকা হিসেবে সোমা মুখার্জির নাম উল্লেখ করেছেন।

রোমান্টিক ছবি হিসেবে ‘এপার ওপার’ দারুণ বাণিজ্যিক সাফল্য পায়। এ ছবির গানগুলো তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষ করে ‘ভালোবাসার মূল্য কত’ গানটি দর্শক-শ্রোতার মুখে মুখে ফেরে। আজও বাংলা ছবির চিরসবুজ প্রেমের গানের তালিকায় এটি রয়েছে। ছবিরি সংগীত পরিচালক ছিলেন আজাদ রহমান। গানটিতে কণ্ঠও দিয়েছিলেন তিনি। ছবিতে গানটির দুটি সংস্করণ আছে। একটি ছবির প্রথম দিকে আনন্দে উচ্ছ্বল ভঙ্গিতে। অন্যটি ছবির শেষে বেদনাময় গায়কিতে। পুরো ছবিতে এ গানটির হামিং শোনা যায়। ছবিতে সোহেল রানা-সোমার রসায়ন এখনও দারুণ উভোগ্য। পর্দার বাইরে তাদের রোমান্স এবং বোঝাপড়াও প্রতিফলিত হয়েছে গানটিতে।

১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘এপার ওপার’ এখনও চির সবুজ ভালোবাসার ছবি হিসেবে যেমন অমর হয়ে আছে তেমনি ছবির দুই প্রধান শিল্পীর ব্যক্তিগত রোমান্সেরও দলিল হয়ে আছে।