রাজস্ব আদায়ই চ্যালেঞ্জ: জায়েদ বখত

অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারের লক্ষ্যে প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘সম্প্রসারণমূলক’ করা হলেও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আহরণ করে এর বাস্তবায়নকে চ্যালেঞ্জ মনে করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষক জায়েদ বখত।

রিয়াজুল বাশারও শেখ আবদুল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 June 2015, 03:45 PM
Updated : 4 June 2015, 06:37 PM

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদের চোখে, প্রস্তাবিত বাজেটের আয়-ব্যয়ের কোনো লক্ষ্যই বাস্তবমুখী নয়।

এই বাজেট বাস্তবায়ন করতে হলে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই, মনে করেন আর্থিক খাতের গবেষক আহসান এইচ মনসুর।  

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি বলব, এটা সম্প্রসারণমূলক বাজেট।”

২০১৫-২০১৬ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী; চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের আকার ২ লাখ ৩৯ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা।

সংশোধিত বাজেটে জিডিপি ধরা হয়েছে ১৫ লাখ ১৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা; আগামী অর্থবছরের বাজেটে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে মোট জিডিপি প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৭ লাখ ১৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।

কেন সম্প্রসারণমূলক বাজেট তার ব্যাখ্যায় জায়েদ বখত বলেন, “বাজেটের শুধু যে আকার বেড়েছে, তাই না। রিলেটিভলিও বেড়েছে এবং জিডিপির শতাংশ হিসেবেও বেড়েছে।

“গত বছর যেমন এটা ছিল জিডিপির ১৬ ভাগের মতো। এখন এটা হবে ১৭ দশমিক ২ শতাংশ। সুতরাং এটা একটা সম্প্রসারণমূলক বাজেট।”

অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করার জন্য ‘সম্প্রসারণমূলক’ এই বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে বলে মনে করেন অগ্রণী ব্যাংকের এই চেয়ারম্যান। 

“এটার পেছনে যে মূল উদ্দেশ্য কাজ করেছে সেটা হল- অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করা। একদিকে সরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে, আর অন্যদিকে বেসরকারি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করে। এইটাই হচ্ছে মূল উদ্দেশ্য।”

বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়ে প্রস্তাবিত বাজেটেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, গত দশ বছরে দেশের মোট বিনিয়োগ বেড়ে জিডিপির ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ ২৮ দশমিক ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। 

২০১৬০-২০১৮ সময়ের মধ্যে বিনিয়োগ জিডিপির ৩১ দশমিক ৮ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মুহিত।

তবে প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নে রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা পূরণ হওয়া নিয়ে সংশয় দেখছেন জায়েদ বখত।

“চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অর্থায়ন। এজন্য যে এনবিআরের যে টার্গেট আছে, সেটা গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের থেকে প্রায় ৩০ ভাগ বেড়েছে। এটাকে অর্থমন্ত্রী নিজেই তার বক্তৃতায় উচ্চাকাঙ্ক্ষা বলেছেন।

“কিন্তু আসলে এটা এর চাইতেও বেশি হবে। কারণ এবছর সংশোধিত বাজেটে যেটা দেখানো হয়েছে, তা বাস্তবায়ন (রিয়ালাইজ) হওয়ার সম্ভাবনা কম।”

প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৮২ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা ধরা হলেও পরে তা সংশোধন করে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা করা হয়েছে। 

‘বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে’

সরকার আগামী অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব করেছে তা বাস্তবায়নের জন্য বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ আকর্ষণে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে বলে মনে করেন আর্থিক খাতের গবেষক আহসান এইচ মনসুর।

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাজেটে যে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, সেটা নিঃসন্দেহে উচ্চাভিলাষী। এই রাজস্ব ও ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করার বিকল্প নেই।”

“আর এটা করা সম্ভব হলেই সামাজিক ও অন্যান্য খাতে যে ব্যয়ের লক্ষ্য যে নেওয়া হয়েছে, তা অর্জন হবে,” বলেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর।

তিনি বলেন, এবছর সরকার সড়ক উন্নয়নে খুব জোর দিয়েছে। এর আগে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত ছিল বাজেটের এক নম্বর গুরুত্ব।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন করতেও সরকারকে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোরও ওপর গুরুত্ব দিতে হবে, বলেন আহসান মনসুর।

তিনি বলেন, সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রথম বাজেট হওয়ায় এর বাস্তবায়ন খুব গুরুত্বপূর্ণ।

‘বাস্তবমুখী নয়’

প্রস্তাবিত বাজেটের আয়-ব্যয়ের দুটো লক্ষ্যের কোনোটি বাস্তবমুখী নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা বর্তমান বাজেটের প্রস্তাবনার তুলনায় প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু রাজস্ব বোর্ডের সক্ষমতা কতটা বেড়েছে?

“কর দেওয়ার প্রবণতা কতটা বাড়ানো গেছে? রাজস্ব আয় অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং হবে এবং এটা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত না।”

বেসরকারি বিনিয়োগ না হওয়ার মধ্যে সরকার ব্যাংক খাত থেকে বেশি ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, যাতেও সমস্যা দেখছেন সালেহ উদ্দিন।

“সরকার ব্যাংক থেকে এই পরিমাণ ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে অর্থ প্রবাহ সংকুচিত হতে পারে। সুদ হারেও চাপ বাড়বে। আর দেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত না হলে বিদেশি বিনিয়োগও আসবে না।”

আগামী অর্থবছরের জন্য যে বাজেট দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী, তাতে ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৩৮ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছেন তিনি। এই অঙ্ক গত বারের চেয়ে ৭ হাজার কোটি টাকা বেশি।  

সালেহ উদ্দিন বলেন, “সরকার পরিবহন ও বিদ্যুৎ খাতে অগ্রাধিকার দিয়েছে, এটা ঠিক আছে। কিন্তু বিনিয়োগ সক্ষমতা কোথায়, তার কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। এই বিশাল উন্নয়ন ব্যয় করার সক্ষমতা অর্জনে সরকার কী করবে, তা স্পষ্ট না।”

তার মতে, সম্ভাবনাগুলো বাজেটে ভালোভাবে উপস্থাপিত হলেও কীভাবে তা বাস্তব রূপ পাবে, তার কোনো স্পষ্ট রূপরেখা নেই বাজেটে।