তেলের দর কমলেও বাড়ছে আমদানি ব্যয়

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দর অর্ধেকে নেমে এলেও ইউরোর দর পতনের সুযোগে আমদানি বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে আমদানি ব্যয়।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 May 2015, 02:21 PM
Updated : 21 May 2015, 09:22 AM

তবে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি বাড়ায় সামগ্রিকভাবে বিষয়টি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ‘ইতিবাচক’ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও শিল্পদ্যোক্তারা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান সরাসরিই বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের দাম বেশ কম থাকার পরও আমদানি ব্যয় বাড়ার অর্থ হচ্ছে, দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেড় বছর আগে (২০১৪ সালের জানুয়ারি) প্রতি ইউরোর বিনিময়ে পাওয়া যেত ১০৭ টাকা। আর বুধবার ঢাকার বাজারে প্রতি ইউরোর বিনিময় হার ছিল ৮৭ টাকা ১৭ পয়সা। মাস দুয়েক আগে তা আরও কমে ৮৪ টাকায় নেমে এসেছিল।

শতকরা হিসাবে দেড় বছরে টাকার বিপরীতে ইউরোর মান কমেছে ২৩ শতাংশ।

এই তথ্য বিশ্লেষণ করে অর্থনীতির গবেষক জায়েদ বখত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইউরোর দর পতনে ইউরোপের বাজার থেকে সস্তায় পণ্য আমদানির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সে সুযোগটিই নিচ্ছেন আমাদের শিল্প মালিকরা। এতে আমদানি ব্যয় ও বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে।”

ইউরোর দর কমায় ইউরোপের দেশগুলো থেকে পণ্য আমদানির খরচ ‘চার ভাগের এক ভাগে’ নেমে এসেছে জানিয়ে বিআইডিএসের এই গবেষক বলেন, “এতে সস্তায় ভালো কোয়ালিটির পণ্য দেশে আসছে। এতোদিন আমরা চীন থেকে যে পণ্য আমদানি করতাম তার কোয়ালিটি নিয়ে নানা মহলে নানা প্রশ্ন ছিল। এখন আমরা তার চেয়েও কম দামে ভালো পণ্য পাচ্ছি।”

“এ সুযোগটিই কাজে লাগাচ্ছেন আমাদের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা। সে কারণে শিল্প স্থাপনের জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি, মধ্যবর্তী কাঁচামালসহ অন্যান্য সরঞ্জাম আমদানি বেড়েছে, যার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বিনিয়োগে। বেশ কিছু দিন ধরে আমাদের বিনিয়োগে যে মন্দা চলছে তাও কেটে যাবে,” বলেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত।

বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইভিন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ কথা ঠিক যে, ইউরোর দাম কমায় আমাদের ক্ষতি হচ্ছে। বেশি পোশাক রপ্তানি করে আমরা কম আয় করছি।

“আবার অন্যদিক দিয়ে লাভও হচ্ছে। আমরা যখন ইউরোপের দেশগুলো থেকে শিল্প স্থাপনের জন্য যন্ত্রপাতি আমদানি করছি তখন খরচ কম পড়ছে। এতে দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে।”

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এ এম  বদরুদ্দোজা

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জ্বালানি তেল আমদানি খাতে মোট ৩৮ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। বিশ্ববাজারে দাম কমায় এবার (২০১৪-১৫ অর্থবছরে) তা ১৭ থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকায় নেমে আসবে।

তিনি জানান, চলতি অর্থবছরে ৫৫ লাখ মোট্রক টন জ্বালানি তেল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ লাখ টন ক্রুড অপরিশোধিত; বাকি ৪২ লাখ টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে বাড়তে প্রতি ব্যারেল (পরিশোধিত) ১৫০ ডলারে উঠেছিল। বর্তমানে তা ৬০ ডলারে নেমে এসেছে। আর অপরিশোধিত তেলের (ক্রুড ওয়েল) দাম নেমে এসেছে ৫০ ডলারের নিচে।

তেলের দাম কমায় গত জানুয়ারি থেকে জ্বালানি তেল বিক্রি করে বিপিসি লাভ করছে বলেও বদরুদ্দোজা জানান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে জ্বালানি তেল (পিওএল)আমদানির জন্য ২৬৪ কোটি ৪৪ লাখ ডলারের এলসি (ঋণপত্র) খোলা হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ কম। এলসি নিষ্পত্তির পরিমাণ কমেছে ১৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

অন্যদিকে এ সময়ে শিল্পখাতের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ২৯২ কোটি ৮১ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, যা ২০১৩-১৪ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬ শতাংশ বেশি। এলসি নিষ্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে আরও বেশি; ২৩ শতাংশ।

শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামাল (ইন্টারমিডিয়েট গুডস) আমদানির এলসি খোলা এবং নিষ্পত্তির হার বেড়েছে যথাক্রমে ১১ শতাংশ ও ৯ শতাংশ।

নয় মাসেই ৭১৫ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি

জ্বালানি তেলে খরচ কমায় বাণিজ্য ঘাটতি কমার আশা জাগলেও পণ্য ও সেবা- দুই খাতেই বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) পণ্য বাণিজ্যে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭১৫ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের পুরো সময়ের, অর্থ্যাৎ জুলাই-জুন সময়ের চেয়েও ২ শতাংশ বেশি। আর জুলাই-মার্চ সময়ের চেয়ে ৫৭ শতাংশ বেশি।

২০১৩-১৪ অর্থবছরে পণ্য বাণিজ্যে মোট ঘাটতি ছিল ৭০১ কোটি ডলার।

চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে সেবা খাতে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২১১ কোটি ২০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ১৯০ কোটি ডলার।

বাংলাদেশ পণ্য রপ্তানি করে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে, পণ্য আমদানির জন্য তার চেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয় বলে বাণিজ্যে ঘাটতি দেখা দেয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশ থেকে দুই হাজার ৯৭৬ কোটি (২৯ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ১২ দশমিক ২১ শতাংশ বেশি।

অন্যদিকে এই নয় মাসে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ মোট দুই হাজার ২৬১ কোটি ২০ লাখ (২২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে, যা ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ের চেয়ে ৩ শতাংশ বেশি।

জুলাই-মার্চ সময়ে সেবাখাতে আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হওয়ায় ঘাটতি বেড়েছে। মূলত বিমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের পরিস্থিতি বিবেচনা করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।

নয় মাসে সেবাখাতের বাণিজ্যে ২২৪ কোটি ৯০ লাখ ডলঅরের আয়ের বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ৫৮৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এ হিসাবে সেবা বাণিজ্যে ঘাটতি বেড়েছে ১২ দশমিক ২১ শতাংশ।

লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি ১১৫ কোটি ডলার

সেবা ও পণ্য বাণিজ্যে এই ঘাটতির প্রভাবে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাব ভারসাম্যেও (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

অর্থবছরের নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) এই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১৪ কোটি ২০ লাখ ডলার, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে ১৬৯ কোটি ১০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।

চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেও (জুলাই-অগাস্ট) বাংলাদেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট (বিওপি) উদ্বৃত্ত ছিল। কিন্তু অর্থনীতির এই সূচক সেপ্টেম্বর থেকে উল্টোপথে (নেগেটিভ-ঋণাত্মক) হাঁটতে শুরু করে।

‘লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি বাড়লেও তাতে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই’ মন্তব্য করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বর্তমানে ২৪ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ মজুদ আছে। এই মজুদ দিয়ে সাত মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

“দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসায় শিল্প স্থাপনের জন্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজ, শিল্পের কাঁচামাল এবং শিল্প খাতের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্য আমদানি বাড়ায় বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। ব্যালেন্স অব পেমেন্টেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

“বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল এবং খাদ্যপণ্যের দাম বেশ কম। তারপরও আমদানি ব্যয় বাড়ছে। এর অর্থ হচ্ছে- দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে”, বলেন তিনি।

সাধারণভাবে চলতি হিসাবের মাধ্যমে দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝানো হয়। আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়-ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। এখানে উদ্বৃত্ত হলে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।