নিজস্ব অর্থে বহু প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর কাজ চলছে পুরোদমে। ইতোমধ্যে সেতুর জন্য প্রয়োজনীয় বিদেশি সরঞ্জাম কেনাকাটায় প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
Published : 25 Jan 2015, 10:46 PM
এই বিল পরিশোধের পরও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদেশ মুদ্রার মজুদ ২২ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি অবস্থান করছে। ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে আরও কিছু বিল পরিশোধ করতে হবে। তখনও রিজার্ভে টান পড়বে না বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে জটিলতায় কয়েক বছর আটকে থাকার পর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা নদীর ওপর ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুর নির্মাণ কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
রিজার্ভ ২২ বিলিয়ন ডলার ছাড়ানোর পর এই সেতুর কাজ শুরুকে ‘মোক্ষম সময়’ বলছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এমন সময়ে আমাদের স্বপ্নের এই সেতুর কাজ শুরু করেছি, যখন আমাদের পর্যাপ্ত রিজার্ভ রয়েছে। সেতুর জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকানার বিল পরিশোধের পরও রিজার্ভ সন্তোষজনক অবস্থায় থাকবে।”
“নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু করে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়ে ইতিহাস করতে চাই আমরা,” বলেন মুহিত।
সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “পদ্মা সেতু এখন আর অবাস্তব স্বপ্ন নয়। এখন দিবালোকের মতো পরিষ্কার। বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। ২০১৮ সালে এই সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কাজী ছাইদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত কয়েক মাসের পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা বাবদ প্রায় ৩০ কোটি ডলারের (প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা) বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
“এই বিলের প্রায় পুরোই পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহকারী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক অগ্রণী ব্যাংক তাদের নিজেদের উদ্যোগেই সরবরাহ করেছে। সামান্য কিছু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জোগান দেওয়া হয়েছে।”
বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অর্ধেকে নেমে আসায় এখন এই খাতে বিদেশি মুদ্রা কম খরচ হচ্ছে বাংলাদেশের। এ অবস্থায় পদ্মা সেতুর জন্য বিদেশি মুদ্রা সংস্থানে কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে করেন ছাইদুর।
“তবে এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করা দরকার বলে আমি মনে করি। পদ্মা সেতুর কাজের জন্য বিদেশি মুদ্রায় যে বিল শোধ করা হচ্ছে বা হবে, তা কিন্তু সরাসরি রিজার্ভ থেকে দেওয়া হবে না। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে স্থানীয় মুদ্রায় ডলার কিনে নেবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই বিল পরিশোধ বা সমন্বয় করবে মাত্র।”
অন্যান্য বিদেশি কেনাকাটার বিল যেভাবে পরিশোধ করা হয় পদ্মার ক্ষেত্রে তেমনি করা হচ্ছে বা হবে বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই কর্মকর্তা।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম জানান, মূল সেতুর পাইলিংয়ের জন্য মাটি পরীক্ষার কাজ চলছে এখন। একইসঙ্গে টেস্ট পাইল ও স্টিল ফেব্রিকেশনের কাজ চলছে চীনের ন্যানটংয়ের ওয়ার্কশপে।
টেস্ট পাইল বসানোর কাজ শুরু হবে ফেব্রুয়ারি থেকে। নির্মাণ এলাকায় ওয়ার্কশপ বসানো হয়ে গেলে সেখানেই পাইল ও স্টিল ফ্রেবিকেশনের কাজ শুরু হবে।
“এখন পর্যন্ত সেতুর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কাজ হয়েছে,” বলেন প্রকল্প পরিচালক শফিকুল।
সব ঠিক থাকলে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুর ওপর দিয়ে ২০১৮ সালে পদ্মা পার হবে গাড়ি। ঢাকাসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি সড়কপথে যুক্ত হবে দক্ষিণ জনপদের ১৯ জেলা। সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেনও চলবে।
চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে পদ্মা সেতুর জন্য ৮ হাজার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
রিজার্ভ ২১.৮৪ বিলিয়ন ডলার
জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন প্রায় সাড়ে ২২ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ৯০ কোটি ডলার এবং পদ্মার বিল শোধের পর রিজার্ভ ২১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়ায় গত কয়েক দিনে তা বেড়ে ২১ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।
প্রতি মাসে ৩ বিলিয়ন ডলার হিসেবে এই রিজার্ভ দিয়ে প্রায় সাত মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) গত বছরের একই সময়ের চেয়ে রেমিটেন্স বেড়েছে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ।
চলতি মাসের ১৬ দিনেই (১ জানুয়ারি থেকে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত) ৭১ কোটি ২০ লাখ ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
অন্যদিকে জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১ দশমিক ৫৬ শথাংশ।
শক্তিশালী হচ্ছে টাকা
রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ের সঙ্গে বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়ায় টাকা খানিকটা শক্তিশালী হয়েছে। ১০ দিনের ব্যবধানে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মান দশমিক ২০ শতাংশ বেড়েছে।
রোববার আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলার-টাকার বিনিময় হার ছিল ৭৭ টাকা ৮০ পয়সা। ১৫ জানুয়ারি ছিল ৭৭ টাকা ৯৫ পয়সা।
অর্থাৎ এখন এক ডলার কিনতে হলে ৭৭ টাকা ৮০ পয়সা দিতে হচ্ছে। ১৫ দিন আগে লাগত ৭৭ টাকা ৯৫ পয়সা।
৬ মাসে ১৪৮ কোটি ডলার ক্রয়
বাজার স্থিতিশীল রাখতে চলতি অর্থবছরে এই পর্যন্ত সবমিলিয়ে ১৪৮ কোটি (১ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন) ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১০ দিনে কিনেছে ১৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
অন্যদিকে আমদানি বাড়ায় গত বছরের শেষের দিকে ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার পর ৩৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। নভেম্বর মাসে বিক্রি করা হয় ৭ কোটি ডলার, আর ডিসেম্বরে ২৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, আগের বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরেও বাজার থেকে ডলার কেনা অব্যাহত রাখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তা কেনা হয়।
কিন্তু কেউ বিক্রি করতে না আসায় অক্টোবরের পর থেকে আর কোনো ডলার কেনেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।
চাহিদা বাড়ায় বাজার স্থিতিশীল রাখতে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত কয়েক দিনে সরবরাহ বাড়ায় আবার কিনতে শুরু করেছে।
এর আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫১৫ কোটি ডলার কেনা হয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরের কেনা হয়েছিল ৪৭৯ কোটি ডলার।
২০১২ সালের প্রথম দিকে টাকার বিপরীতে ডলারের দর বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে ৮৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। এরপর থেকে তা কমতে কমতে ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে ৮০ টাকার নিচে নেমে আসে।
গত বছরের অক্টোবরের (২০১৪ সাল) শেষের দিকে তা আরও কমে ৭৭ টাকা ৪০ পয়সায় নেমে আসে। এরপর তা কিছুটা বেড়ে ৭৭ টাকা ৯৫ পয়সায় উঠেছিল।
ছাইদুর রহমান বলেন, বৈদেশিক মুদ্রাবাজার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছে। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী যখন যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তা নেয়া হচ্ছে।
“যখন প্রয়োজন হচ্ছে বিক্রি করা হচ্ছে। আবার কেনা হচ্ছে। সবই করা হচ্ছে বাজার স্থিতিশীল রাখতে।”
২০০৩ সালে দেশে ভাসমান মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা (ফ্লোটিং) চালু হয়। অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়।