রাজনীতির ‘স্বস্তি’ গতি আনেনি উন্নয়নে

রাজনৈতিক সংঘাতময় বছর পেরিয়ে নির্বাচনের পর ‘স্বস্তি’ ফিরলেও তার প্রভাব দেখা যায়নি সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Dec 2014, 03:02 PM
Updated : 14 Dec 2014, 03:17 PM

বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থাকে অর্থনীতির জন্য স্বস্তির বলে মনে করলেও এর মধ্যে প্রথম ৫ মাসে এডিপি বাস্তবায়নে মন্থর গতিতে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের যুক্তি, অর্থ বছরের প্রথম ভাগে এই গতি সব সময়েরই।

“উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ আসলে সারা বছর ধরেই হয়। ঠিকাদাররা বছরের শেষ দিকে এসে বিল সাবমিট করে। সে কারণে অর্থবছরের শেষ তিন মাসেই অধিকাংশ বিল শোধ করা হয়।”

“আমরা যেহেতু বিল শোধ করার পর বাস্তবায়নের হার হিসাব করি, সেহেতু শেষের তিন মাসেই বাস্তবায়নের হার বেশি হয়ে থাকে। দীর্ঘদিন ধরেই এ অবস্থা চলে আসছে।”

চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ২১ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে বলে রোববার এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে জানান পরিকল্পনামন্ত্রী।

গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরের একই সময়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ২০ শতাংশ। যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং নির্বাচনের আগে ওই পাঁচ মাস ছিল ব্যাপক সংঘাতময়।

গত প্রায় এক বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ‘শান্ত’ বলে মনে করছেন মুস্তফা কামাল। যারা পরিবেশ শান্ত রাখতে সহায়তা করেছেন তাদের ধন্যবাদও জানিয়েছেন তিনি।

“দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল-অবরোধ থাকলে সবচেয়ে ক্ষতি হয় অর্থনীতির। অর্থনীতির জন্য শান্ত পরিবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”

তাহলে এডিপি বাস্তবায়নের হারে উন্নতি হয়নি কেন- সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে বিল সংক্রান্ত ওই জটিলতা দেখান তিনি।

গত ২০১৩-১৪ অর্থবছর শেষে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ৯৫ শতাংশ। নয় মাস পর্যন্ত (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এ হার ছিল ৬০ শতাংশেরও কম। শেষের তিন মাসের হিসাবেই তা ৯৫ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়।

তবে আগামী অর্থবছর থেকে এডিপি বাস্তবায়নে ভিন্ন মাত্রা নিয়ে আসা হবে বলে জানান পরিকল্পনামন্ত্রী।

“একটি প্রকল্পের বিভিন্ন অংশকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করে তা তদারকি করা হবে। তখন বোঝা যাবে, প্রকল্পের কোন অংশে সমস্যা হচ্ছে। যেসব প্রকল্প ভালোভাবে কাজ করছে না, সেসব প্রকল্প থেকে অর্থ, কাজ ভাল হচ্ছে এমন প্রকল্পে স্থানান্তর করা হবে।”

“এখন থেকে প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন করতে হলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে জারিকৃত প্রজ্ঞাপন লাইন মন্ত্রণালয়গুলোকে মেনে চলতে হবে। ঘনঘন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন করলে তা প্রকল্প অগ্রগতিকে ব্যাহত করে।”

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কয়েকটি বিভাগের প্রকল্প বাস্তবায়নের অবস্থার মন্থর গতি নিয়ে উত্তরে মুস্তফা কামাল বলেন, “আমাদের মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পগুলো মূলত কারিগরি প্রকল্প। এগুলো বিনিয়োগ প্রকল্প নয়। সে কারণেই অর্থবছরের প্রথম দিকে এগুলোর বাস্তবায়নের হার কম।”

ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেইন প্রকল্পের কাজ কবে শেষ হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ঢাকা-চট্টগ্রাম রোড দিয়ে আমি প্রায়ই আমার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় যাই। মাঝে-মধ্যে চট্টগ্রামও যাই। দেখেছি, কাজ এগিয়ে চলছে…।

“একদম দিনক্ষণ দিয়ে বলা যাবে না। তবে আগামী অর্থবছরের মধেই এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশা করছি।”

চলতি অর্থবছরে এডিপির আকার ধরা হয় ৭৫ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্থানীয় মুদ্রার পরিমাণ ছিল ৪৯ হাজার ৭১ কোটি টাকা। প্রকল্প সাহায্য ২৬ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, জুলাই-নভেম্বর সময়ে ১৫ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। যারমধ্যে স্থানীয় মুদ্রা ১০ হাজার ১৫২ কোটি টাকা।

২০১৪-১৫ অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়ন অগ্রগতি সম্পর্কিত প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, জুলাই-নভেম্বর সময়ে ১৫টি মন্ত্রণালায়/বিভাগ তাদের নামে বরাদ্দ অর্থের ১০ শতাংশেরও কম অর্থ খরচ করেছে।

এর মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি টাকাও খরচ করতে পারেনি। এই মন্ত্রণালয়ের জন্য মাত্র ৯৫ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। ৮৭ লাখ টাকার বিপরীতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এই পাঁচ মাসে মাত্র এক লাখ টাকা ব্যয় করেছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৫৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকার বিপরীতে ১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা খরচ করেছে।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের বাস্তবায়নের হার ৫ শতাংশের নিচে।

চলছে পদ্মা সেতুর পিলার স্থান নির্ধারণের কাজ (ফাইল ছবি)

দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প পদ্মা সেতু বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেতু বিভাগের বাস্তবায়নের হার ৯ দশমিক ৯ শতাংশ।

জুলাই-নভেম্বর সময়ে এই বিভাগ ৮৬২ কোটি ২৮ লাখ টাকা খরচ করেছে। মোট বরাদ্দ আছে আট হাজার ৭১৩ কোটি টাকা।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়নের হার ৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ।

অর্থবিভাগ, তথ্য মন্ত্রণালয় এবং নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের এডিপি বাস্তবায়নের হার ১০ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে।

জুলাই-নভেম্বর সময়ে সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। মোট ১৩ হাজার ২৭৩ কোটি টাকার বিপরীতে খরচ করেছে তিন হাজার ৬৯৫ কোটি ২২ লাখ টাকা। বাস্তবায়নের হার ২৮ শতাংশ।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়নের হার ২৯ শতাংশ। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ২৬ শতাংশ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগেরও ২৬ শতাংশ।

স্বরাষ্ট্র এবং গৃহায় ও গণপূর্ত- এই দুই মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়নের হার ২৪ শতাংশ।

শতাংশের দিক দিয়ে বাস্তবায়নে এগিয়ে আছে প্রবাসী কল্যাণ বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। ৩৩৬ কোটি ৪৬ লাখ টাকা বরাদ্দের মধ্যে এই পাঁচ মাসে ১২০ কোটি কোটি টাকার বেশি খরচ করেছে। বাস্তবায়নের হার ৩৬ শতাংশ।

রাজধানীর শেরে বাংলানগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনা সচিব ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম এবং সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (জিইডি) শামসুল আলম উপস্থিত ছিলেন।