ব্যাংক খাতে বাড়ছে সরকারের ঋণ

সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে মোটা অঙ্কের টাকা এলেও ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বাড়ছে।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Sept 2014, 06:09 AM
Updated : 20 Sept 2014, 07:29 AM

সরকার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে জোর দেওয়ার কারণেই এমনটা ঘটছে বলে মনে করা হচ্ছে।

এছাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য অনুন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিয়মিত খরচ মেটানোর বিষয়টিও এক্ষেত্রে কাজ করছে।

তবে ব্যাংকগুলোর কাছে এখন পর্যাপ্ত উদ্বৃত্ত তারল্য থাকার পরও বিনিয়োগে ভাটা থাকায় সেখান থেকে সরকার ঋণ নেওয়ায় কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলে অভিমত একজন বিশেষজ্ঞের।

চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের দুই মাস আট দিনে (পহেলা জুলাই থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) সরকার প্রয়োজনীয় খরচ মেটানোর জন্য দুই হাজার ৭৬২ কোটি ১৯ লাখ টাকা ধার করেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা বেশি।

২০১৩-১৪ অর্থবছরের এ সময়ে ব্যাংক থেকে সরকারের ধার করা টাকার পরিমাণ ছিল এক হাজার ৭২৭ কোটি টাকা।

অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা, যা এর আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই এক মাসে এতো বেশি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়নি।

প্রতিদিন নতুন যে টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় তা থেকে আগের বিভিন্ন সময়ে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল শোধের পর যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটাই নিট বিক্রি।

সুদ-আসল পরিশোধের পর নিট বিক্রির টাকা সরকারের কোষাগারে থেকে যায়। প্রয়োজনে সেখান থেকে ঋণ নিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটায় সরকার।

গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেশি হওয়ায় সরকারকে ব্যাংক থেকে খুব বেশি ধার করতে হয়নি। পুরো অর্থবছরে মাত্র সাত হাজার ৯৫১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল সরকার।

অথচ তার আগের বছরে (২০১২-১৩) যার পরিমাণ ছিল প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা।

সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গতি আসায় সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আসার পরও ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বাড়ছে বলে মনে করেন অর্থনীতির গবেষক জায়েদ বখত।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শেয়ার বাজারে দীর্ঘদিনের মন্দা এবং ব্যাংকগুলো আমানতের সুদের হার কমানোয় নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছিলেন সবাই। স্বাভাবিকভাবে বিক্রি বাড়ায় এখান থেকে টাকা পাওয়ায় খরচ মেটাতে ব্যাংকের কাছ থেকে খুব বেশি ঋণ করতে হয়নি সরকারকে।

“চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ আরও বেড়েছে। তারপরও ব্যাংক থেকে সরকারের বেশি ধার করার প্রধান কারণ হচ্ছে, অর্থবছরের শুরু থেকেই উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ বেশ জোরেসোরেই শুরু হওয়ায় তার ব্যয় মেটাতে ব্যাংক থেকে বেশি ধার নিতে হচ্ছে।”

রাজস্ব আয়ের মন্থর গতি ‘ব্যাংক থেকে সরকারের বেশি অর্থ ঋণ নেওয়ার’ আরেকটি কারণ বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এক হাজার ৮৫৮ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই মাসে যার পরিমাণ ছিল ৬২৪ কোটি টাকা।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের পহেলা জুলাই থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে মোট দুই হাজার ৬৭২ কোটি ১৯ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে।

এই ঋণের মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নেয়া হয়েছে তিন হাজার ৯৫৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার কোনো ঋণ না নিয়ে উল্টো আগের নেওয়া ঋণের এক হাজার ২৮৬ কোটি শোধ করেছে।

এ হিসাবে আলোচ্য সময়ে ব্যাংক থেকে সরকারের ধার করা টাকার পরিমাণ হচ্ছে দুই হাজার ৬৭২ কোটি ১৯ লাখ টাকা।

জায়েদ বখত বলেন, “দুই ঈদ সামনে রেখে সারা দেশে রাস্তা-ঘাট মেরামত করতে গিয়ে হঠাৎ করে সরকারের বড় অঙ্কের নগদ টাকার প্রয়োজন দেখা দেয়।

“এছাড়া দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প পদ্মা সেতুসহ অন্যান্য প্রকল্পের জন্যও নগদ অর্থের প্রয়োজন পড়ায় বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে সরকারকে।”

সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন কর্মসূচি, বিভিন্ন খাতে ভর্তুকিসহ অনুন্নয়নমূলক (সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য খরচ) কর্মকাণ্ডেও সরকারের মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয়।

ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বাড়ায় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না- এ প্রশ্নের উত্তরে জায়েদ বখত বলেন, ব্যাংকগুলোর কাছে এখন এক লাখ কোটি টাকার বেশি উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে। এর মধ্যে একেবারে অলস পড়ে আছে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।

“যেহেতু ব্যাংকে প্রচুর অর্থ পড়ে আছে। সেগুলোই বিনিয়োগ হচ্ছে না। সরকারের ঋণ বাড়লে তাতে এই মুহূর্তে তেমন সমস্যা হবে না।”

বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৩১ হাজার ২২১ কোটি টাকা ধার করবে বলে লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার।

গত অর্থবছর ২৫ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা ধরা হলেও সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা করা হয়। যদিও মাত্র ৭ হাজার ৯৫০ কোটি ৯২ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে অর্থবছর শেষ হয়।

গত কয়েক বছর সরকারের ব্যাংক ঋণের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আগের মেয়াদে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯-১০ অর্থবছরে ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ না নিয়ে উল্টো আগের নেওয়া ঋণের ৭  হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা পরিশোধ করেছিল।

তবে এরপর থেকে প্রতি বছরই ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে ব্যাংক থেকে সরকারের নিট  ঋণের পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা।

পরের বছরে নেওয়া হয় ২১ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে আরও বেশি ২৪ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা ধার করে সরকার।