সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বদলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ করার কৌশল নেয়ায় মূল্যস্ফীতি বাজেটের প্রত্যাশা অনুযায়ী ‘সহনীয় পর্যায়ে’ রাখা সম্ভব হবে বলেই মনে করছেন একজন অর্থনীতিবিদ।
Published : 10 Jul 2014, 10:51 AM
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখতের মতে, সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়ায় সরকারের ‘এই কৌশল’ কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বাজেটের ঘাটতি পোষাতে সরকার যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিত, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংককে নতুন টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়তে হতো। সেক্ষেত্রে বাজারে টাকার সরবরাহ বেড়ে যেত; বাড়ত মূল্যস্ফীতি।”
গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে আটকে রাখার প্রত্যাশার কথা জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। আর পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মে মাস শেষে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
জায়েদ বখত মনে করছেন, পুরো অর্থবছরের মূল্যস্ফীতির হিসাব পাওয়া গেলে তা সরকারের প্রত্যাশার কাছাকাছিই থাকবে।
গত অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণ নেয়ার পরিমাণ ছিল সাত হাজার ৯৫১ কোটি টাকা, যা ২০১২-১৩ অর্থবছরের ঋণের তিন ভাগের এক ভাগেরও কম। আর বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার এক চতুর্থাংশের মতো।
ঘাটতি মেটাতে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক থেকে ২৫ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা ধার করার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল সরকার। পরে সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ২৯ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা করা হয়।
কিন্তু ৩০ জুন অর্থবছর শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার নিট ঋণ নিয়েছে সাত হাজার ৯৫০ কোটি ৯২ লাখ টাকা।
এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নেয়া হয়েছে ২৪ হাজার ১০ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয়া আগের ঋণের ১৬ হাজার ৬০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
এই হিসাবে বিদায়ী অর্থবছরে ব্যাংক থেকে সরকারের নেয়া নিট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৯৫১ কোটি ৯২ টাকা।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছরে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ নেয়নি। উল্টো বাণিজ্যক ব্যাংকগুলো থেকে নেয়া ঋণের টাকায় আগের নেয়া ঋণের সুদ-আসল শোধ করেছে।
এ প্রসঙ্গে জায়েদ বখত বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে দেয়া মানে নতুন নোট ছাপিয়ে বাজারে দেয়া। তাতে মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা থাকে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে সরকার। আর বর্তমানে ব্যাংকগুলোর কাছে উদ্বৃত্ত তারল্য থাকায় কোনো সমস্যা হয়নি।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঞ্চয়পত্র বিক্রি সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিদায়ী ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) এ খাত থেকে দশ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে সরকার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে চৌদ্দ গুণ বেশি এবং মোট বাজেট ঘাটতির ২০ শতাংশ। এই অংক বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আড়াই গুণ বেশি।
পুরো অর্থবছরের হিসাব পেলে এই ঋণের পরিমাণ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন জায়েদ বখত।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “শেয়ারবাজারে দীর্ঘদিনের মন্দা এবং ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদের হার কম হওয়ায় পুরো অর্থবছরজুড়ে মানুষ বেশি বেশি সঞ্চয়পত্র কিনেছে।”
গত ৫ জুন অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সুদের ওপর কোনো কর না নেয়ার ঘোষণা দেয়ায় বিক্রি আরো বেড়েছে উল্লেখ করে জায়েদ বখত বলেন, “জুন মাস শেষে পুরো অর্থবছরের হিসাব যোগ হলে নিট সঞ্চয়পত্রের বিক্রি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি হবে।”
বিদায়ী ২০১৩-১৪ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) মোট ২১ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের আসল-সুদ বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ১১ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ, নিট বিক্রির পরিমাণ হচ্ছে দশ হাজার ১৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা।
ঘাটতি মেটাতে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে চার হাজার ৯৭১ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল সরকার। বিক্রি বেশি হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে তা প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে আট হাজার কোটি টাকা করা হয়।
তারই ধারাবাহিকতায় নতুন বাজেটে (২০১৪-১৫) সঞ্চয়পত্র থেকে নয় হাজার ৫৬ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার। সঞ্চয়পত্রের এই ঋণ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ না হলে সরকারের ঋণের বোঝা আরো বাড়বে বলে মনে করেন জায়েদ বখত।
“সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি। কোনো কোনটা ১৩ শতাংশেরও বেশি। ফলে বিনিয়োগকারীদের বেশি সুদ দিতে হচ্ছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই ঋণের বোঝা বাড়বে। তবে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের এই অর্থ যদি উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ হয়, তাহলে বিনিয়োগ বাড়বে। অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।”
নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মোট পরিমাণ থেকে আগে বিক্রিত সঞ্চয়পত্রের নগদায়নের পরিমাণ বাদ দেয়ার পর অবশিষ্টাংশকে সঞ্চয়পত্রের প্রকৃত বিক্রি বলা হয়। নগদায়নের ক্ষেত্রে গ্রাহককে সুদসহ আসল পরিশোধ করা হয়।