অর্থমন্ত্রণালয়ের সতর্কতা, বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়া নজরদারি এবং পরিচালনা পর্ষদে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়ার পরও বেসিক ব্যাংকের খেলাপী ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে।
Published : 24 Dec 2013, 05:15 PM
রাষ্ট্রায়াত্ত এই বিশেষায়িত ব্যাংকের নিজস্ব প্রতিবেদনগুলোতেই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন আর্থিক সূচকের দুরাবস্থা ফুটে উঠেছে।
ব্যাংকের নিজস্ব প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের নভেম্বর মাসের তাদের মোট খেলাপী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ২১ কোটি ৯৮ লাখ ৭৫ হাজার ৩৩৫ টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২০ শতাংশের বেশি।
এই খেলাপী ঋণের মধ্যে মন্দ বা ক্ষতিজনিত ঋণের (যা আর আদায়ের সম্ভাবনা নেই) পরিমাণ এক হাজার ৩৪৯ কোটি ৫ লাখ ৭৮ হাজার ৩৯২ টাকা।
এছাড়া খেলাপী হবে এমন ঋণের (স্পেশাল মেনশন একাউন্ট-এসএমএ) পরিমাণ ৮০৯ কোটি ৫৮ লাখ ৭২ হাজার ৫০২ টাকা।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, মাত্র দুই মাসে ব্যাংকটির খেলাপী ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১৬০ কোটি টাকা।
গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির দেয়া মোট ঋণের মধ্যে ১ হাজার ৮৬৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা খেলাপী ছিল, যা ওই সময়ের বিতরণকৃত ঋণের ১৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
অথচ ব্যাংকটির ঋণ বিতরণের পরিমাণ খুব বেশি বাড়েনি। গত সেপ্টেম্বরে তাদের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ১১২ কোটি ২ লাখ টাকা। আর নভেম্বরের শেষে এর পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ১৫০ কোটি টাকার মধ্যে।
নভেম্বর শেষে বেসিক ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩০৩ কোটি টাকা। আর মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬০০ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। একাধিকবার চেষ্টার পরও তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএস পাঠিয়ে সাক্ষাৎ চাইলেও তিনি সাড়া দেননি।
ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা হারুন অর রশিদের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা হলেও ফখরুল ইসলামকে পাওয়া যায়নি।
বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই বেসিক ব্যাংক থেকে ‘বিভিন্ন বেনামি ও অস্তিত্বহীন’ প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে ধরা পড়েছে।
ব্যাংকটির দিলকুশা, গুলশান ও শান্তিনগর শাখায় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার ঋণে অনিয়ম ধরা পড়ে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটির বেশ কিছু ঋণ হিসাবের বিপরীতে অর্থ বিতরণ স্থগিতও করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার জন্য গত ১৬ জুলাই বেসিক ব্যাংকের সঙ্গে এক সমঝোতা স্মারকে সই করে বাংলাদেশ ব্যাংক, যাতে খেলাপী ঋণ কমানো ও আদায় বাড়ানোর শর্ত দেয়া হয়।
এছাড়া অর্থমন্ত্রণালয় থেকে ব্যাংকটির পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে সতর্কও করা হয়।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেও কয়েকবার ব্যাংকটির পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, ডেপুটি গভর্নররাও এসব বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
তারপরও ব্যাংকটির মন্দ ঋণ কমার পরিবর্তে বাড়ছে। ঋণ আদায়েরও কোনো উন্নতি হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে গত ২৭ নভেম্বর বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
বেসিক ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এই বিশাল অংকের মন্দ ঋণের বোঝা তৈরি হয়েছে কয়েকটি শাখার মাধ্যমে।
ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংকটির প্রধান শাখা, দিলকুশা, গুলশান, শান্তিনগর, উত্তরা, বংশাল, খাতুনগঞ্জ, জুবিলি রোড, জিন্দাবাজার, খুলনা, বগুড়া ও মাধবদী শাখাতেই বড় অংকের খেলাপী ঋণের হিসাবগুলো রয়েছে।
প্রায় এক হাজার প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকটির এই অর্থ আটকে আছে।
এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে
রানী ফার্মিং কমপ্লেক্স, ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ফর রুরাল পিপলস (ড্রপ), হুমায়রা এন্টারপ্রাইজ, সেতু প্যাকেজিং, সিটি হার্ট মোবাইল সেন্টার, সিটি কমিউনিকেশনস, মাদারল্যান্ড সোয়েটার ইন্ডাস্ট্রিজ, অ্যাসেনশিয়াল প্রোটিন প্রোডাক্ট লিমিটেড, উর্দ হোল্ডিংস লিমিটেড, আলফা ফ্যাশন প্রোইভেট লিমিটেড, গ্রিন বাংলা স্পিনিং মিলস লিমিটেড, ওশান অ্যান্ড ডিজাইন (বিডি) লিমিটেড, ফোরাম ফর প্রভার্টি এলিভেশন, হাসান ব্রাদার্স, সিমেক্স লিমিটেড, আর কে ফুডস, কেয়া হাউজ হোল্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, আর এস কর্পোরেশন লিমিটেড, শহীদ রোটর স্পিনিং মিলস, শীতলক্ষ্যা স্পিনিং মিলস, ধ্রুব সোসাইটি, বি এ এন্টারপ্রাইজ, কুশিয়ারা স্টোন ক্র্যাশিং ইন্ডাস্ট্রিজ, মনির পোল্ট্রি, আহমেদ নূর, বৈশাখী ট্রেডিং, জে কে এন্টারপ্রাইজ, ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি, সেভ আওয়ার সোসাইটি (এসওএস), ভিলেজ ইকোনোমিক অ্যান্ড স্যোশাল ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড, রুপায়ণ হাউজিং লিমিটেডসহ বেশ কিছু প্রতষ্ঠান রয়েছে।