বিনিয়োগ বাড়ার প্রবণতায় ‘কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধির’ আশা

গেল দুই বছরের মতো রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা না থাকায় দেশে বিনিয়োগের আবহ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন দেশের অর্থনীতির নীতি নির্ধারকরা।

আবদুর রহিম হারমাছিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Feb 2016, 07:22 AM
Updated : 7 Feb 2016, 02:19 PM

তারা বলছেন, অস্থিরতা না থাকায় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়ছে, কমছে ব্যাংক ঋণের সুদের হার। বেড়েছে শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি এবং কাঁচামাল আমদানি।

সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে সাত শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) অর্জনের ব্যাপারে আশাবাদী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

শুক্রবার মিন্টো রোডের বাসায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মুহিত বলেন, “উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থা ফিরে এসেছে। তারা বিনিয়োগ করছেন। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে। নানা তৎপরতায় ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল এবং খাদ্যপণ্যের কম দামে বেশ স্বস্তি পাচ্ছি।

“সবচেয়ে ভালো যেটা সেটা হল- ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি বেশ বাড়ছে। বাড়ছে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি। গতি বেড়েছে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহে। সে কারণেই আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি এবার আমরা ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অবশ্যই অর্জন করব।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর শেষে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বেড়েছে ১৪ দশমিক ১৯ শতাংশ, যা প্রায় তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

চলতি ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরের ষষ্ঠ মাস পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। আর ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ঋণের পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৪৩ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা।

এ হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বেড়েছে ১৪ দশমিক ১৯ শতাংশ। নভেম্বরেও তা ছিল ১৩ দশমিক ৭২ শতাংশ।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধি থাকলেও এক মাস পরে তা ১৪ শতাংশে নেমে আসে। এরপর এবারই প্রথম বেসরকারি ঋণের প্রবাহ ১৪ শতাংশ ছাড়াল।

২০১৩ সালের শুরুতে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ঋণ প্রবাহে ভাটা পড়ে, যা পরের বছরেও প্রলম্বিত হওয়ায় ঋণ প্রবাহে মন্দাভাব ছিল।

অবশ্য বেসরকারি খাতের বিপরীতে সরকারি বিনিয়োগে গতি আসেনি। চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ২৪ শতাংশ।

গত বছর একই সময়ে এডিপিতে খরচ হয়েছিল ২৮ শতাংশ অর্থ। এর আগে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ছয় মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ২৪ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থাত্ আট অর্থবছরের মধ্যে বাস্তবায়ন হার সর্বনিম্ন।

তবে এই ছয় মাসে সরাসরি নিট বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বেড়েছে আট শতাংশের বেশি।

এ সময়ে বাংলাদেশে ৭৯ কোটি ৫০ লাখ ডলারের নিট এফডিআই এসেছে। গত বছরের একই সময়ে এই অংক ছিল ৭৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার।

জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ২৯ শতাংশ। আর নিষ্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে ১৫ শতাংশ।

এই সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ২৪০ কোটি (২ দশমিক ৪ বিলিয়ন) ডলারের এলসি (ঋণপত্র) খোলা হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১৮৬ কোটি ডলার।

এলসি নিষ্পত্তি ১৪৭ কোটি ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ১৬৯ কোটি ডলার।

অন্যদিকে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে ৮২১ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের। এই অংক গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের চেয়ে প্রায় ৪ শতাংশ বেশি। এলসি নিষ্পত্তি বেড়েছে প্রায় এক শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, “ছোট-বড় সব খাতেই বিনিয়োগ বাড়ছে। সব বিনিয়োগ অনেক সময় চোখে পড়ে না।

“গত কয়েক বছরে আইসিটি খাতে প্রচুর বিনিয়োগ হয়েছে। কৃষি খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে। প্রধান রপ্তানি আয় তৈরি পোশাক, ওষুধ শিল্প খাতসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে।।”

ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের দীর্ঘদিনের দাবির পর ব্যাংকগুলো ঋণের সুদ হার সর্বোচ্চ ১৪ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। কমিয়ে আনা হয়েছে আমানতের সুদ হারও।   

সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক, বিডিবিএল ও কৃষি ব্যাংক ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে নতুন এই সুদ হার কার্যকর করেছে।

উদ্যোক্তারা এখন মেয়াদি ঋণ পাবেন ১৩ শতাংশ সুদে, চলতি মূলধন ১৪ শতাংশে, বাণিজ্যিক সাধারণ ঋণ ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ, এসএমই খাতে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৪ শতাংশ এবং নারী উদ্যোক্তা হলে ১০ শতাংশ, আমদানি ঋণ ১৪ শতাংশ, স্বীকৃত বিলের বিপরীতে সৃষ্ট ফোর্সড ঋণে ১৪ শতাংশ, নগদ সহায়তার বিপরীতে আগাম ঋণে ১৪ শতাংশ, আইবিপি ১৪ শতাংশ হারে।

আগে ব্যাংকগুলো ১৬ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নিচ্ছিল এসব ঋণে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারিতে বেসরকারি ব্যাংকগুলোও শিল্প ঋণের সুদের হার ধীরে ধীরে কমিয়ে আনছে।

সর্বশেষ অক্টোবরের হিসাব অনুযায়ী ৫৬টি ব্যাংকের গড় সুদ হার আগের চেয়ে কমে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশে, যা সেপ্টেম্বরে ১১ দশমিক ৪৮ শতাংশ এবং অগাস্টে ১১ দশমিক ৫১ শতাংশ ছিল ।

ঋণের সুদ কমার প্রেক্ষিতে গত কয়েক মাস ধরে আমানত ও ঋণ উভয় ক্ষেত্রে সুদ হারও কমছে। ফলে গত মার্চে আমানত ও ঋণের সুদ হারের ব্যবধান (স্প্রেড) রেকর্ড পরিমাণ কমে ৫ শতাংশীয় পয়েন্টের নিচে নেমে এসে দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৮৭ পয়েন্টে।

অর্থনীতি গবেষক জায়েদ বখত বলেন, “পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ অনেক বড় বড় প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এ সব মেগা প্রকল্পকে ঘিরে দেশে এক ধরনের বিনিয়োগের আবহ তৈরি হয়েছে। রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা রয়েছে। আগামীতে অস্থির হওয়ার আশংকাও তেমন নেই।

“সবমিলিয়েই দেশে বিনিয়োগের অনুকুল পরিবেশ ফিরে এসেছে। বাড়ছে বিনিয়োগ।”

আগামীতে এ ধারা অব্যহত থাকবে বলে প্রত্যাশা করছেন অগ্রণী ব্যাংকের এই চেয়ারম্যান।