নেলসনের প্রবাসী বাংলাদেশিদের এই 'বাংলাদেশ আওয়াজ' বিফলে যেতে দেননি সাকিব আল হাসান আর তামিম ইকবালরা। দারুণ এক জয় উপহার দিয়ে তাদের কষ্ট সার্থক করেছে বাংলাদেশ দল।
'তোমার দেশ, আমার দেশ; বাংলাদেশ বাংলাদেশ'-লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে সকাল থেকে ম্যাচ শেষ হওয়া অবধি এই স্লোগানে স্যাক্সটন ওভালের গ্যালারি মুখরিত করে প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
ক্লান্তিহীন এই মানুষগুলো বৃ্হস্পতিবার নজর কেড়েছে নেলসনবাসীর। এদের একজনও বাংলাদেশের জার্সি ছাড়া নেই। প্রায় সবাই সঙ্গে নিয়ে এসেছেন প্রিয় দেশের পতাকা। স্থানীয় এক হাসপাতালের নার্স মারিয়া জানান, এমন প্রাণবন্ত মানুষজন জীবনে খুব কম দেখেছেন তিনি।
নেলসনের এই মাঠের দর্শক ধারনক্ষমতা ৫ হাজার। ম্যাচ উপভোগ করতে আসার সংখ্যা সব মিলিয়ে হাজার তিনেক হবে। এদের বেশিরভাগই স্কটল্যান্ডের দর্শক। বিভিন্ন স্কুল থেকে শিক্ষার্থীদের খেলা দেখাতে নিয়ে আসেন শিক্ষকরা।
এলাকার লোকজন নানাভাবে সহায়তা করছিলেন। স্বেচ্ছাসেবক হয়েছেন এলাকার নানা বয়সী মানুষ। কেউ কেউ লোকজনকে ঘুরে ঘুরে খাবার পানি দিচ্ছিলেন। কেউ আবার দর্শকদের 'সান ক্রিম'।
বৃহস্পতিবার এখানে তাপমাত্রা ছিল ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। নেলসনের মানুষ বিশ্বকাপকে নিচ্ছেন গর্ব হিসেবে। বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে অনেক পর্যটক এসেছেন নেলসনে। অনেকের কাজের সুযোগ হয়েছে। এর জন্যেও খেলাটি তাদের জন্যে আর্শীবাদের মতো হয়েছে।
বাংলাদেশের ম্যাচ দেখতে আসা প্রবাসী বাংলাদেশিদের কেউ নেলসনে থাকেন না। মাঠে উপস্থিত সবাই-ই পথের কষ্ট ভুলে ৫১০ কিলোমিটার দূরত্ব পেরিয়ে ক্রাইস্টচার্চ থেকে নেলসনে আসেন প্রিয় দেশের খেলা দেখতে।
এদের অনেকে সেখানে পড়াশুনা করেন, অনেকে নির্মান-শ্রমিক। ক্রাইস্টচার্চের সর্বশেষ ভূমিকম্পের পর শহরটি আবার নতুন করে সাজানোর কাজ চলছে। এর জন্য বাংলাদেশি কিছু শ্রমিককে সিঙ্গাপুর থেকে নিয়ে এসেছে স্থানীয় একটি রিক্রুটিং এজেন্সি।
এমন একজন প্রবাসী বাংলাদেশি শাহীন জানান, এই ম্যাচটিকে কেন্দ্র করে কাজ থেকে তিন দিনের ছুটি নেন তিনি। এর জন্য তার তিন দিনের মজুরি কাটা যাবে। তবে এর তোয়াক্কা করেন না তিনি। বাংলাদেশের জয়টাই সব ভুলিয়ে দেবে তাকে।
বাংলাদেশের একজন সিনিয়র সাংবাদিকের সন্তান তনয় কাইটেরিটরি নামের একটি শহরে চাকরি নিয়ে এসেছেন মাত্র দু'মাস। খেলা দেখতে ছুটে এসেছেন তিনি। বললেন, "খেলাটিকে কেন্দ্র করে আমাদের যে কী আবেগ তা ব্যাখ্যা করার দরকার নেই।"
ঢাকার টিয়াস-সামিনা দম্পতি খেলা দেখতে এখন অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ড ঘুরছেন। মেলবোর্নের এমসিজিতে শ্রীলংকার সঙ্গে খেলাটা দেখতে গিয়ে দল হেরে যাওয়ায় মন খারাপ হয়েছিল। নিউ জিল্যান্ডের নেলসনেও আসেন তারা। বৃহস্পতিবার খেলার মাঠে দলের বিজয় মূহুর্তে তারা আনন্দ আড়াল করে রাখতে পারেলেন না। টিয়াস বলেন, "দল হারলে মনে হয় জীবনটা ষোল আনাই মিছে। আজ মনে হচ্ছে উসুল ষোল আনাই!"
বৃহস্পতিবার নেলসনের স্যাক্সটন ওভালে উপস্থিত বাংলাদেশি দর্শকদের সবারই যেন মনের কথা ফুটে উঠেছে এই দম্পতির কথায়।
ম্যাচটির পরতে পরতে স্যাক্সটন ওভালে উপস্থিত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মনের রং বদলেছে।
স্কটল্যান্ড দল যখন ৩১৮ রান করে ফেলে, তখন তাদের অনেকে টস জিতে আগে ব্যাট না নেয়ায় মাশরাফিকে দুষছিলেন। তবে এদের কারোরই মনে হয়নি যে, দল হারবে। ক্রিকেট বোদ্ধার মতো অনেকেই বলছিলেন-মাঠটা ছোট, একটু বুঝেশুনে মারলে সহজে চার-ছয় করাটা কোন ব্যাপার নয়।
ক্রাইস্টচার্চ থেকে আসা আমিনুল বলেন, "সৌম্য একাই চারটা ক্যাচ নেওয়ার পর মনে হচ্ছিল, আজ দিনটা সৌম্যর (সৌম্য সরকার)।"
সৌম্য আউট হওয়ার পর এই আমিনুলের চোখেমুখেই দেখা মেলে দুশ্চিন্তার কালো মেঘের! কিন্তু তামিম ইকবাল-মাহমুদুল্লাহ জুটি দাঁড়িয়ে যাওয়াতে এই মুখগুলো আবার উজ্জ্বল হতে শুরু করে।
ক্রিকেট মাঠে গ্যালারিতে যারা সেজেগুজে, বাঘের পুতুল নিয়ে আসেন তাদের অনেকের লক্ষ্য থাকে টিভি ক্যামেরার দৃষ্টি আকর্ষণ করা! বৃহস্পতিবার যেহেতু বাংলাদেশ দলের সমর্থক দর্শক কম ছিলো সে কারনে একই লোকজনকেই একাধিকবার দেখিয়েছে!
মুশফিকের বাবা, দুই চাচাও দর্শক গ্যালারিতে বসে খেলা দেখেছেন। বাংলাদেশের জয়ে আরও উজ্জ্বল হয় মুশফিকের বাবার মুখ।
খেলা শেষে মিছিল করে ফিরে যাচ্ছিলেন ক্রাইস্টচার্চের প্রবাসীরা। বিদায় নেবার আগে তাদের অনেকে জড়িয়ে ধরে বলছিলেন, "ভাই সব কষ্ট ভুলে গেছি। পয়সা উসুল। কারণ আমাদের দল যে জিতেছে।"
আসলে পয়সা উসুলের আনন্দ নয়, প্রিয় দল জেতায় দারুণ প্রশান্তি আর তৃপ্তি নিয়ে ফিরেছে তারা।