অবশেষে ক্রিকেটেও এল বিশ্বকাপ

বছর চারেক বিরতিতে আরেকটি ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলে এসেছে প্রায়। অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ডে একাদশ বিশ্বকাপের খেলা মাঠে গড়ানোর আগে ফিরে দেখা যাক আগের ১০ আসর। প্রথমেই ১৯৭৫ সালে প্রথম বিশ্বকাপ আয়োজনের পটভূমি এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিশ্বজয়ের কাহিনী।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Feb 2015, 07:46 AM
Updated : 10 Feb 2015, 09:48 AM

বিশ্বকাপ - নামেই যার পরিচয়। ব্যাপারটা খেলাধুলার হলে বুঝে নিতে কারো বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় না যে এটা নির্দিষ্ট কোনো খেলার বিশ্বসেরাদের নিয়ে আয়োজিত শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতা।

ফুটবল, আইস হকি, টেবিল টেনিসের বিশ্বকাপের পথচলা শুরু দুই মহাযুদ্ধের মাঝের সময়টায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের বছর দশকের মধ্যে সে পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, বাস্কেটবল, রাগবি লিগ। ১৯৭১ আসতে আসতে হকিও চলে আসে সেই দলে। কিন্তু ক্রিকেটের বিশ্বকাপ? বিশ্বের প্রথম সংগঠিত দলীয় খেলা এক্ষেত্রে পিছিয়ে ঢের। ১৯৭৫ সালের আগ পর্যন্ত হয়নি যে ক্রিকেটের বিশ্বকাপ!

ঠিক বিশ্বকাপ নাম দিয়ে নয়, তবে ১৯১২ সালে ক্রিকেটে ওই ধরনের চেষ্টা হয়েছিল একবার। তখনকার টেস্ট খেলুড়ে তিন দেশ অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে আয়োজিত হয় চ্যাম্পিয়নশিপ। কিন্তু বাজে আবহাওয়ায় বেশিরভাগ খেলা বাধাগ্রস্থ হওয়ায় কলিতেই ঝরে যায় সেই প্রচেষ্টা। কালক্রমে টেস্ট আঙ্গিনায় যোগ হয় নিউ জিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত ও পাকিস্তান। ‘টাইমলেস’ যুগ থেকে পাঁচ দিনের জমানায় ঢোকে অভিজাত খেলাটি। তবু বিশ্বকাপ আয়োজন দুঃসাধ্য হয়ে ছিল দীর্ঘ দিন। একেকটি খেলাই যদি হয় পাঁচ দিন করে, তাহলে যে বিশ্বকাপ শেষ করতে লেগে যাবে দীর্ঘ সময়!

ওই সমস্যার সমাধান নিয়ে এল ওয়ানডে ক্রিকেট। ১৯৭১ সালের ৫ জানুয়ারি এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ চালু হল বলেই না এর চার বছরের মধ্যে মঞ্চস্থ হতে পারে বিশ্বকাপ!

ওয়ানডে ক্রিকেট চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যে সবাই হুড়মুড়িয়ে পড়ে সেদিকে, ব্যাপারটি মোটেই তেমন না। ১৯৭১ সালের ৫ জানুয়ারি পথচলা শুরুর পর ১৯৭৫ সালের ৭ জুন প্রথম বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ মাঠে গড়ানোর আগ পর্যন্ত মোট ওয়ানডে হয়েছে মোটে ১৮টি। অথচ ঠিক ওই সময়ে বিশ্বজুড়ে আয়োজিত টেস্ট ম্যাচের সংখ্যা ৮৪। দৈর্ঘ্যে পাঁচগুণ বেশি হওয়ার পরও যখন প্রায় পাঁচগুণ বেশি আয়োজিত হয় টেস্ট, ওয়ানডের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার অবস্থা তখন সহজেই অনুমেয়।

১৯৭৫ সালের ‘ইংলিশ সামার’-এর ১৫টি দিন কিভাবেই না চিরতরে পাল্টে দিল ক্রিকেটের মানচিত্র!
প্রথম বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব ইংল্যান্ডকে দেওয়া হয় ১৯৭৩ সালে। ঐতিহ্য ও অবকাঠামোগত সামর্থ্য এক্ষেত্রে রেখেছে প্রভাবকের ভূমিকটা। যেমনটা ইংল্যান্ডের গ্রীষ্মের দীর্ঘ দিনও। তখনকার দিয়ে ওয়ানডে ক্রিকেট খেলা হত ৬০ ওভারে। গ্রীষ্মে ইংল্যান্ডে যেহেতু সন্ধ্যা নামে বেশ দেরি করে- সে কারণে আইসিসির অনুমোদন পেয়ে যায় তারা। আর স্পন্সর প্রুডেনশিয়াল ইন্সুরেন্সের কাছ থেকে এক লাখ পাউন্ড পাওয়ায় ইংল্যান্ডের জন্য আয়োজনটা হয়ে যায় সহজ। ওই স্পন্সরের কারণে বিশ্বকাপের 'অফিসিয়াল' নামকরণ ‘প্রুডেনশিয়াল কাপ’।
টেস্ট আঙ্গিনা থেকে নির্বাসিত তখন দক্ষিণ আফ্রিকা। কুলীন পরিবারের সদস্য ছয়টি দেশ ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত ও পাকিস্তান। এদের সঙ্গে শ্রীলঙ্কা ও পূর্ব আফ্রিকাকে নিয়ে বসে প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপের মেলা। আটটি দলকে দুই গ্রুপে ভাগ করে হয় লিগ পর্বের খেলা। দুই গ্রুপের পয়েন্ট তালিকায় ওপরে থাকা দুটি করে দল যায় সেমি-ফাইনালে। ১৯৭৫ সালের ৭ জুন শুরু হয়ে টুর্নামেন্ট শেষ ২১ জুন। ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয় ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে।
ওয়ানডে ক্রিকেটের তখন ‘হাঁটি হাঁটি পা পা’ যুগ। এই খেলার ধাঁচ বুঝে উঠতে পারেনি অনেক দেশ ও ক্রিকেটার। এর মধ্যে সবচেয়ে হাস্যকর কাণ্ডটি ঘটায় ভারত; আরো নির্দিষ্ট করে বললে সুনীল গাভাস্কার। সেটি ছিল বিশ্বকাপের প্রথম খেলা। ওপেনার ডেনিস অ্যামিসের সেঞ্চুরিতে আগে ব্যাটিং করা ইংল্যান্ড নির্ধারিত ৬০ ওভারে চার উইকেটে তোলে ৩৩৪ রান। ওই রান টপকে জয় পাওয়া কঠিন। ভারত হয়তো তাই খেলল টেস্ট ম্যাচ ড্র করার মতো। নির্ধারিত ওভার শেষে স্কোরবোর্ডে তাদের তিন উইকেটে ১৩২ রান। সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে স্বীকৃত গাভাস্কার পুরো ৬০ ওভার ক্রিজে থেকে ১৭৪ বল খেলে অপরাজিত থাকলেন ৩৬ রানে! টেস্টে যেটি হতে পারত ড্র, ওয়ানডেতে তাতে ২০২ রানে হারে ভারত। তাতে লজ্জা ছিল যত, বিব্রত হওয়ার উপাদান এর চেয়ে কম ছিল না।
ইংল্যান্ড, নিউ জিল্যান্ড, ভারত ও পূর্ব আফ্রিকাকে নিয়ে গড়া গ্রুপ ‘এ’ থেকে সেমি-ফাইনালে ওঠে প্রথম দুটি দল। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকে পিছু ফেলে গ্রুপ ‘বি’ থেকে ওঠে যেমন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও অস্ট্রেলিয়া। গ্রুপ পর্বের ম্যাচগুলোর মধ্যে জাভেদ মিঁয়াদাদের অভিষেক ওয়ানডে আলাদা উল্লেখের দাবি রাখে। সেটি অবশ্য সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানের প্রথম ম্যাচ হিসেবে না, এখনো পর্যন্ত বিশ্বকাপের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর খেলাগুলোর একটি হিসেবে। আগে ব্যাটিং করে পাকিস্তান তোলে ২৬৬ রান। এরপর ১৬৬ রানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের আট উইকেট ফেলে জয়ের সঙ্গে স্পর্শের দূরত্বে চলে আসে তারা। ২০৩ রানের মাথায় নবম উইকেট তুলে নিয়ে আরেকটু কাছাকাছি যায় পাকিস্তান। কিন্তু শেষ উইকেটে ডেরেক মারে (৬১*) ও অ্যান্ডি রবার্টস (২৪*) ৬৪ রান তুলে অবিশ্বাস্য এক জয় এনে দেয় ক্যারিবিয়ানদের। পরদিন ১৮ পূর্ণ করা মিঁয়াদাদ জন্মদিনটি কাটিয়েছেন কেঁদে কেঁদে।
আত্মবিশ্বাসের নাগরদোলায় চড়ে বসা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আর থামানো যায়নি। সেমি-ফাইনালে নিউ জিল্যান্ডকে পাঁচ উইকেটে তারা হারায় প্রায় ২০ ওভার হাতে রেখে। ফাস্ট বোলার ব্রেন্ডন জুলিয়েন চার উইকেট পেলেও ম্যাচসেরা হন স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান আলভিন কালিচরন তিন নম্বরে নেমে ৯২ বলে ৭২ রানের ইনিংসের জন্য।
অন্য সেমি-ফাইনালেতে স্বাগতিকদের স্বপ্নযাত্রা থামিয়ে দেয় অস্ট্রেলিয়া। হেডিংলির পেসবান্ধব উইকেটে আগুন ঝরান বাঁহাতি ফাস্ট বোলার গ্যারি গিলমোর। তাঁর ছয় উইকেটে ইংল্যান্ড অলআউট মাত্র ৯৩ রানে। অস্ট্রেলিয়া ছয় উইকেট হারিয়ে পৌঁছে যায় গন্তব্যে।
গিলমোর ঝলসে উঠেছিলেন ফাইনালেও। কিন্তু এবার আর ঝলসে দিতে পারেননি প্রতিপক্ষকে। ক্লাইভ লয়েডের অসাধারণ সেঞ্চুরিতে ৬০ ওভারে আট উইকেটে ২৯১ রান তোলে ক্যারিবিয়ানরা। জবাবে অস্ট্রেলিয়া অলআউট ২৭৪ রানে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস ব্যাটারির মধ্যে কিথ বয়েস (৪/৫০) ছিলেন সফলতম। তবে অস্ট্রেলিয়ার পতনে সবচেয়ে বড় ভূমিকাটা তার না; সেটি রান আউটের। ইনিংসে পাঁচ-পাঁচটি রান আউট যে তাদের! এর মধ্যে তিনটি ভিভ রিচার্ডসের থ্রোতে। ১৭ রানে ফাইনাল জিতে তাই প্রথম বিশ্বকাপ জিতে নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
আর সফল ওই আয়োজনের মাধ্যমে শুরু ওয়ানডে বিশ্বকাপের জয়যাত্রাও!
সবচেয়ে বেশি রান:

খেলোয়াড় (দেশ)

ম্যাচ

রান

সেরা

গড়

১০০/৫০

গ্লেন টার্নার (নিউ জিল্যান্ড)

৩৩৩

১৭১*

১৬৬.৫০

২/০

ডেনিস অ্যামিস (ইংল্যান্ড)

২৪৩

১৩৭

৬০.৭৫

১/১

মাজিদ খান (পাকিস্তান)

২০৯

৮৪

৬৯.৬৬

০/৩

কিথ ফ্লেচার (ইংল্যান্ড)

২০৭

১৩১

৬৯.০০

১/১

অ্যালেন টার্নার (অস্ট্রেলিয়া)

২০১

১০১

৪০.২০

১/০



সবচেয়ে বেশি উইকেট:

 

খেলোয়াড় (দেশ)

ম্যাচ

উইকেট

সেরা

গড়

ইকোনমি

গ্যারি গিলমোর (অস্ট্রেলিয়া)

১১

৬/১৪

৫.৬৩

২.৫৮

বার্নার্ড জুলিয়েন (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)

১০

৪/২০

১৭.৭০

২.৯৫

কিথ বয়েস (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)

১০

৪/৫০

১৮.৫০

৩.৫৫

রিচার্ড হ্যাডলি (নিউ জিল্যান্ড)

৩/২১

২০.২৫

৩.৫২

অ্যান্ডি রবার্টস (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)

৩/৩৯

২০.৬২

২.৯১

ডেনিস লিলি (অস্ট্রেলিয়া)

৫/৩৪

২৭.৮৭

৪.২০