ছাত্রলীগ নামধারীদের অপকর্ম বুয়েটে

কেন্দ্রীয় কমিটির কোনো স্বীকৃতি না থাকলেও নিজেদের মতো করে ছাত্রলীগের একটি কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) সক্রিয় এক দল যুবক, যাদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে। শফিকুল ইসলাম মিল্টন ও মাসুম বিল্লাহ- এর প্রতিবেদন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 April 2011, 00:23 AM
Updated : 5 April 2011, 00:23 AM
শফিকুল ইসলাম মিলটন ও মাসুম বিল্লাহ
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
ঢাকা, এপ্রিল ০৫ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- কেন্দ্রীয় কমিটির কোনো স্বীকৃতি না থাকলেও নিজেদের মতো করে ছাত্রলীগের একটি কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) সক্রিয় একদল যুবক, যাদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে।
আওয়ামী লীগ সমর্থক পেশাজীবী সংগঠন বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদ স্বঘোষিত এ আহ্বায়ক কমিটিকে মদদ দিচ্ছে, যা কমিটির সদস্যরাই স্বীকার করেছেন।
বুয়েট শিক্ষার্থীরা বলছেন, ৬ বছর আগে গঠিত কমিটির সদস্যদের অধিকাংশ ক্যাম্পাসে না থাকার সুযোগই কথিত আহ্বায়ক কমিটির সদস্যরা নিচ্ছে।
বুয়েটে সংগঠনের নাম ব্যবহারের এ খবর কানে গেছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপনের কাছেও, যদিও তিনি জানালেন- বুয়েটে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই।
বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নির্বাচিত কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে পাঁচ বছর আগে। ওই কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ প্রায় সবাই ছাত্রত্ব শেষ করে চাকরিতে ঢুকে পড়েছেন। এতদিনেও কমিটি গঠন না করার জন্য সাবেক নেতারা কেন্দ্রীয় কমিটিকেই দায়ী করেছেন।
কথিত আহ্বায়ক কমিটিকে কেন্দ্রীয় কমিটি স্বীকার না করলেও এর যুগ্ম আহ্বায়ক রওনক হাসান দাবি করলেন, তাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে।
কথিত আহ্বায়ক কমিটিটি গঠন করা হয় গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর। এতে মাহমুদ হাসান আল রাজী সুমন আহ্বায়ক এবং অন্য সাত জনকে যুগ্ম-আহ্বায়ক। তারা হলেন- রওনক হাসান, বখতিয়ার উদ্দিন, আবদুল মোমিন, আবদুল্লাহ আল মারুফ, আরাফাত আফসার, আহমেদ রোদসি ও রেদোয়ান সাইদ।
রওনক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের কমিটি না থাকায় বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের পরামর্শে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে। কমিটি গঠনের পর আমরা কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে দেখাও করেছি।"
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক হাবিবুর রহমান বলেন, ছাত্রলীগের আগের কমিটির নেতাদের ছাত্রত্ব শেষ হওয়ায় এবং বর্তমানে অনুমোদিত কোনো কমিটি না থাকায় প্রশাসন মনে করে, ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই।
কথিত কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের মদদে ছাত্রলীগের নামে বেশ কয়েকজন বিভিন্ন ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে চাচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষার্থী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানায়, গত থার্টি ফার্স্ট নাইটে মদ্যপ অবস্থায় শহীদ মিনার এলাকায় এক তরুণীকে মটর সাইকেল থেকে টেনে নামিয়ে শ্লীলতাহানি করে ছাত্রলীগ নামধারী মোকাম্মেল।
একই যুবক গত ৩ মার্চ অন্য এক তরুণীকে নজরুল ইসলাম হলের অতিথি কক্ষে আটকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা চালায় বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই সময় সাধারণ শিক্ষার্থীরা ওই তরুণীকে রক্ষা করে।
মোকাম্মেলের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে রওনক বলেন, "এগুলো শুনেছি। তবে কেউ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।"
বিভিন্ন অজুহাত তুলে অন্য সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগও রয়েছে ছাত্রলীগের কথিত কমিটির নেতাদের বিরুদ্ধে।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের বুয়েট শাখার সাধারণ সম্পাদক মামুন মোর্শেদ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "তাদের (ছাত্রলীগ নামধারী) বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই সন্ত্রাসী হামলার শিকার হতে হচ্ছে। গত ফেব্র"য়ারি মাসে পোস্টার লাগাতে গিয়ে আমাদের কর্মীদের তিন দফা মারধরের শিকার হতে হয়।"
ব্লগে বা ফেইসবুকে সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজিবিরোধী লেখালেখি করলেও সাধারণ ছাত্রদের হুমকি-ধমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন মামুন।
অভিযোগ রয়েছে, কথিত কমিটির নেতারা লালবাগ এলাকার ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে ক্যাম্পাসে আধিপত্য সৃষ্টি করেছে এবং সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজিতে লিপ্ত রয়েছে। রওনক ও লালবাগ থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাসিবুর রহমান মানিককে বুয়েটে প্রায় এক সঙ্গে দেখা যায়।
এ বিষয়ে রওনক বলেন, "লালবাগ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হয়। এ জন্য তাদের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক রয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রিপন ভাই সহসভাপতি মানিক ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।"
ছাত্রলীগ নামধারীদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বিষয়ে কেন্দ্রীয় সভাপতি রিপনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "এ মুহূর্তে বুয়েটে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। ছাত্রলীগের নামে কেউ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করলে এর দায় আমরা নেবো না। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিচারের জন্য প্রশাসনের কাছে দাবি জানাচ্ছি আমি।"
এদিকে ছাত্রলীগের নামে এ ধরনের অভিযোগ ওঠায় বিগত কমিটির নেতারাও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। শ্লীলতাহানির অভিযোগ শুনে আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক অমিত কুমার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "এটি খুবই ন্যক্কারজনক অভিযোগ। যদি একাজ হয়ে থাকে, তবে তা খুবই খারাপ হয়েছে।"
বিগত কমিটির সহ-সভাপতি আবু রায়হান রুবেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়ার পর আমি অনেক দিন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছি। কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে অনেকবার বলেছি, নতুন কমিটি করতে। কিন্তু তারা করেননি।"
"আমাদের অবর্তমানে এখন স্বঘোষিত কমিটি ছাত্রলীগের নামে বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজি করে বেড়াচ্ছে। বুয়েটের প্রতিটি হল থেকে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। আর হলগুলোর ছোট দোকানগুলো থেকেও আদায় করা হয় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে", বলেন তিনি।
কেন্দ্রীয় কমিটিকে দায়ী করে রুবেল বলেন, "বুয়েটে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সব সময় একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছিলো। প্রতি দেড় বছর পর পর নির্বাচনের মাধ্যমে বুয়েট ছাত্রলীগের কমিটি হতো। কিন্তু বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর এ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে। তারা নিজেদের মনোনীতদের দিয়ে সংগঠন চালাতে চান। এ জন্যই বুয়েটে কমিটি হচ্ছে না।"
তবে এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে কেন্দ্রীয় সভাপতি রিপন বলেন, খুব শিগগিরই বুয়েটে নতুন কমিটি দেওয়া হবে।
ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদও ফুরিয়ে গেছে- এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে নতুন কমিটি গঠনের আগেই বুয়েটে কমিটি হবে কি না- জানতে চাইলে তিনি গত রোববারও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "হবে, হবে। শিগগিরই হবে।"
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/এসআইএম/প্রতিনিধি/এমআই/১২১২ ঘ.