বিনিয়োগকারীদের ‘প্রলুব্ধ’ করতে খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড কোম্পানির মুনাফা বাড়িয়ে দেখালেও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও বাজার কর্তৃপক্ষ বলছে, এ বিষয়ে তাদের কিছুই করার নেই।
Published : 30 Apr 2014, 10:30 AM
সম্প্রতি প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) ঘোষণাপত্রে কেপিপিএল কোম্পানির আয়ে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি দেখালে তা নিয়ে অনুসন্ধানে নামে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
কোম্পানিটি যে পরিমাণ আয় হয়েছে বলে দাবি করেছে, ব্যবসা ও পুরো খাতের আকারের সঙ্গে এর সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
চলতি বছরের ৪ মার্চ বাজার থেকে ৪০ কোটি টাকা পুঁজি সংগ্রহের জন্য প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং খাতের এই কোম্পানিকে চার কোটি শেয়ার ছাড়ার অনুমতি দেয় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
বিএসইসির অনুমোদনের পর কেপিপিএলের আইপিও ঘোষণাপত্রে দেখা যায়, ২০০৯-১০ অর্থবছরে কোম্পানির আয় ছিল ৩৪ কোটি টাকা। কিন্তু পরের বছরেই তা প্রায় আড়াইশ ভাগ বেড়ে ১১৯ কোটি টাকায় দাঁড়ায়।
২০১১-১২ অর্থবছরে আয় আগের বছরের চেয়ে আরো বেড়ে ২০৮ কোটি টাকা হয়। তবে পরের অর্থবছরেই তা কিছুটা কমে ১৯১ কোটি টাকায় নেমে আসে।
আইপিও ঘোষণাপত্রে কেপিপিএল বলছে, কোম্পানির আয়ের ৬৭ শতাংশই প্রধানত চিংড়ি রপ্তানিসহ সামুদ্রিক খাবারের ব্যবসাসংশ্লিষ্ট সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আসে।
এই খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্যাকেজিং পণ্য বিক্রি করে ২০০ কোটি টাকা আয় করতে হলে কোনো কোম্পানিকে অন্তত দুই হাজার কোটি টাকার সামুদ্রিক খাদ্য পণ্য রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত হতে হবে, যা এই খাতের মোট পরিমাণের প্রায় অর্ধেক।
২০১১-১২ অর্থবছরে মাছ ও চিংড়ি রপ্তানি থেকে বাংলাদেশের মোট আয় ছিল চার হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে, দেশ থেকে রপ্তানি হওয়া মোট সামুদ্রিক খাদ্য পণ্যের অর্ধেক প্যাকেটজাতকরণ কী কেপিপিএল একা করে?
কোম্পানির আইপিও ঘোষণাপত্র অন্তত তা সমর্থন করে না; তাতে বলা আছে, প্যাকেজিং খাতে জাতীয় বাজারে কেপিপিএলের শেয়ার মাত্র ১৮ ভাগ।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলছে, নিরীক্ষকের প্রতিবেদন ও ইস্যু ব্যবস্থাপকের প্রত্যয়ন থাকলে অনুমোদনে কোনো বাধা নেই।
আগামী ৫ মে বাজারে ছাড়ার অপেক্ষায় থাকা এই আইপিও’র ইস্যু ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে আছে সোনালী ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড। আর কেপিপিএলের আর্থিক প্রতিবেদনের নিরীক্ষণের দায়িত্বে ছিল চার্টার্ড অ্যাকাউটেন্ট প্রতিষ্ঠান সাহা মজুমদার অ্যান্ড কোং।
কেপিপিএলের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আইপিও অনুমোদন বা নাকচ করার ক্ষেত্রে কমিশনকে পাবলিক ইস্যু বিষয়ক বিধান, নিরীক্ষকের প্রতিবেদন ও ইস্যু ব্যবস্থাপকের প্রত্যায়নপত্র (ডিউ ডিলিজেন্স সার্টিফিকেট) অনুসরণ করতে হয়।
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (পাবলিক ইস্যু) বিধান ২০০৬ অনুযায়ী, কোনো কোম্পানি মিথ্যা তথ্যকে ঘষা-মাজা করে উপস্থাপন করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রক সংস্থার রয়েছে।
ওই বিধানের ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে, “যদি কোনো শেয়ার ইস্যুকারী বা তার প্রতিনিধি যদি এই বিধানের কোনো ধারা লঙ্ঘন করে বা মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর তথ্য সাজিয়ে উপস্থাপন করে বা কোনো তথ্য চেপে রাখে, তাহলে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ১৯৬৯ সালের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ অনুসারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে।”
কর্তৃপক্ষের ‘হাত গুটিয়ে বসে থাকার’ নীতি
মাসখানেকের মধ্যে কেপিপিএলের শেয়ার বাজারে ছাড়ার কথা থাকলেও এই কোম্পানির কর্মকাণ্ড নিয়ে নিজেদের কোনো ধারণা নেই বলে জানিয়েছে দুই স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্বপন কুমার বালা বিডিনউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডিএসই এখনো কেপিপিএলের ঘোষণাপত্র যাচাই করে দেখছে।”
এই প্রতিবেদক তাকে ঘোষণাপত্র পড়ে মন্তব্য করতে অনুরোধ করলে তিনি সম্মত হন। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পরে বেশ কয়েকবার তার ফোনে কল করা হলেও সাড়া মেলেনি।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও একই ধরনের প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।
সিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ সাজিদ হুসাইন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি এখনো কেপিপিএল সম্পর্কে জানি না, সংশ্লিষ্ট বিভাগ এটা নিয়ে কাজ করছে।”
ডিএসইর এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, বিক্রির পরিমাণগুলো বাড়িয়ে দেখিয়েছে কেপিপিএল।
‘আমাদের (ডিএসই) মন্তব্য দিয়ে কিছু হবে না’ মন্তব্য করে তিনি আরো বলেন, আইপিওর আর্থিক প্রতিবেদন বিষয়ে মূল্যায়ন করা বা তা নিয়ে মন্তব্য করা পুঁজিবাজারের কাজ নয়।
কেপিপিএলের বিভান্তিমূলক প্রতিবাদলিপি
আইপিও ঘোষণায় কেপিপিএলের দাবির বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম খবর প্রকাশের পর কোম্পানির পক্ষে এক প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, “যার ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে তা ‘সত্য নয়’।
“আমাদের মতে, এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রকাশের আগে কোম্পানির যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সঠিক তথ্য জানা উচিৎ।”
ইস্যু ব্যবস্থাপক সোনালী ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের পরামর্শক্রমে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কেপিপিএল পরিচালক আমজাদ হোসেনের মন্তব্য খুব যত্নের সঙ্গে খবরে তুলে ধরে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকের সঙ্গে কথোপকথনের সময় আমজাদ হোসেন এক বারের জন্যও বলেননি যে, এ বিষয়ে তার মন্তব্য করার এখতিয়ার নেই।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকের বিশ্লেষণকে মিথ্যা বলে দাবি করে প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, তারা সামুদ্রিক খাদ্য পণ্য ছাড়াও অন্যান্য পোশাক ও খাদ্য পণ্যের প্যাকেটজাতকরণের কাজ করে। পাশাপাশি প্যাকেটজাতকরণের জিনিসপত্রও রপ্তানি করা হয়।
কোম্পানিটি দাবি করেছে, কেপিপিএলের আয়ের মাত্র ২৫ শতাংশ চিংড়ি ও মাছের প্যাকেজিং থেকে আসে।
ঘোষণাপত্রের ২২তম পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, কেপিপিএলের ৬৩ শতাংশ পণ্যের ভোক্তা এর সহযোগী পাঁচ প্রতিষ্ঠান।
২৫ নম্বর পৃষ্ঠায় সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা আলাদাভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
এর মধ্যে ১২ শতাংশ পণ্য কেনে লকপুর ফিস প্রসেসিং, রূপসা ফিস অ্যান্ড অ্যালাইড ইন্ডাস্ট্রিজের ১৩ শতাংশ। বাগেরহাট সি-ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ কেনে ১৪ শতাংশ। সাদার্ন ফুডস লিমিটেড কেনে ১১ শতাংশ এবং শ্ম্পা আইস ও কোল্ড স্টোরেজ কেনে ১৩ শতাংশ।
কোম্পানির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, পাঁচটি কোম্পানিই সামুদ্রিক খাদ্য পণ্যের রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত।
সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর ৬৩ শতাংশ পণ্য ক্রয়ের কেপিপিএলের দাবি অনুযায়ী, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৯১ কোটি টাকার আয়ে এই পাঁচ সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অবদান হওয়া উচিত ছিল ১২০ কোটি টাকা।
সামুদ্রিক খাদ্য পণ্য থেকে আয়ের মাত্র ২৫ শতাংশ আসে বলে কেপিপিএল যে দাবি করেছে, তার সঙ্গেও এই হিসাব মেলে না।