কিন্তু কক্সবাজারে গিয়েই ট্রলারে ওঠার আগেই স্বপ্নভঙ্গ হয় মাগুরা সদরের ডেফুলিয়া গ্রামের এই দুই যুবকের। কিন্তু ফেরার উপায় ছিল না।
এর পর সাগরে অভুক্ত থাকার পাশাপাশি নানা নির্যাতনে মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে দেখে লুকিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে ঢুকে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন তারা।
ইমরান ও শাহিনের ভাষায়- ৪ মাসের ‘দোজখ যন্ত্রণা’ থেকে ফিরেছেন তারা। ভুল থেকে উপলব্ধির পর এখন তাদের পরামর্শ, আর কেউ যেন এই পথে পা না বাড়ায়।
“এমন ভুল যেন জীবনে অন্য কেউ না করেন। দেশের মাটিতে কামলা খেটে খেলেও কেউ যেন অবৈধ পথে বিদেশ না যায়,” বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন ইমরান।
সাগরে অবৈধ পথে মালয়েশিয়া পাড়ি জমাতে গিয়ে অনেক বাংলাদেশি এখনও আটকা পড়ে আছে বলে দেখে এসেছেন তারা।
তাদের ফেরাতে যেন সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নেয়, সেই প্রত্যাশাও এই দুই যুবকের। “তারা আমাদেরই ভাই, এ দেশের সন্তান,” বলেন শাহিন।
চার মাসের দুর্বিষহ জীবন কাটানোর পর মঙ্গলবার বাড়ি ফিরেছেন ডেফুলিয়া গ্রামের মফিজার শেখের ছেলে ইমরান এবং নূর ইসলামের ছেলে শাহিন।
হারাতে বসা সন্তানদের ফিরে পেয়ে আত্মহারা ইমরান ও শাহিনের বাবা-মা। ইমরানের মা হাসিনা বেগম বলেন, “আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই তিনি আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।”
বাড়ি ফেরার পর পুলিশ ও মাগুরার আদালতে তারা তুলে ধরেন পাচারকারীদের সংঘবদ্ধ নেটওয়ার্ক ও তাদের উপর চালানো নির্যাতনের কথা; জানান সাংবাদিকদেরও।
অবৈধভাবে বিদেশ পাচারের অভিযোগে ইমরানের ভাই রাজু শেখ মাগুরা সদর থানায় মানব পাচারের অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেছেন।
মাগুরার পুলিশ সুপার একেএম এহসান উল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, “মামলার ২ আসামী রবিউল ওরফে রানা ও কামরুলকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। প্রধান আসামি রাজ্জাককে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।”
পুলিশ পাচারকারীদের হাত থেকে ফিরে আসা দুই যুবকের সঙ্গে কথা বলে মাগুরার বাইরের পাচাকারীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানান পুলিশ সুপার।
অবিলম্বে গোটা চক্রকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের আশা প্রকাশ করেন পুলিশ সুপার এহসান উল্লাহ।
মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে পাড়ি জমাতে গিয়ে আন্দামান সাগরে আটকে পড়াদের কথা এখন বিশ্ববাসীর জানা।
মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড মানব পাচারকারীদের দমন এবং অবৈধ অভিবাসীদের ঢুকতে না দেওয়ার কঠোর সিদ্ধান্ত নিলে এই সঙ্কটের সৃষ্টি হয়।
পরে বিশ্ব সম্প্রদায়ের আহ্বানে অনেককে আশ্রয় দিতে রাজি হয় ইন্দোনেশিয়া। মিয়ানমারেও আশ্রয় নেন অনেকে। তাদের মধ্যে বাংলাদেশিদের জাতীয়তা যাচাই করে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে।
দেশ ছাড়ার আগেই স্বপ্নভঙ্গ
নিজের গ্রামের রবিউল ও কামরুলের মাধ্যমে দালালদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ইমরান ও শাহিনের। দুজনকে ঝিনাইদহের হাটগোপালপুর এলাকার রাজ্জাকের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয় ওই দুই দালাল।
ইমরান ও শাহিন জানান, মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য আড়াই লাখ টাকায় মৌখিকভাবে চুক্তিবদ্ধ হন তারা।
রাজ্জাক তাদের বলেছিল, মালয়েশিয়া পৌঁছে খাওয়া-থাকা বাদে মাসে কমপক্ষে ২৫ হাজার টাকা বেতনের চাকরি দেওয়া হবে।
রাজ্জাককে অগ্রিম ৫০ হাজার টাকা করে দিয়েছিলেন এই দুই যুবক। এরপর গত ১২ মার্চ রাতে ঢাকার সায়েদাবাদে রফিক নামে আরেকজন তাদের কক্সবাজারের বাসে তুলে দেয় বলে জানান তারা।
কক্সবাজারে আরও কজন যুবকের সঙ্গে তাদের একটি ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল বলে জানান ইমরান ও শাহিন।
ইমরান বলেন, “অবস্থা বে-গতিক দেখে বিদেশ যাব না বললে সেখানকার লোকেরা মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গালি দিয়ে বলে, ‘তোদের পেছনে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। এখানে আসলে আর ফিরে যাওয়া যায় না’।”
১৪ মার্চ ইমরান ও শাহীনসহ ৮/১০ জনকে একটি ট্রলারে তোলা হয়েছিল। দেড় দিন পর গভীর সমুদ্রে একটি কার্গো জাহাজে উঠানো হয় তাদের। সেখানে আগে থেকেই আরও প্রায় ২০০ জন ছিল।
বেশ কিছু দিন জাহাজটি ওই স্থানেই অবস্থান করে আরও সাড়ে ৪০০ লোক নিয়ে ২ এপ্রিল থাইল্যান্ডের উদ্দেশে রওনা হয়। মাঝপথে মিয়ানমার থেকে নারী-পুরুষ, শিশুসহ আরও ৪০০ জন যুক্ত হয় বলে জানান ইমরান ও শাহিন।
খাবার চাইলে কিল-ঘুষি-লাথি
তিন মাসের বেশি সময় অথৈ সাগরে জাহাজে অবস্থানের সময় পাচারকারীরা অমানুষিক নির্যাতন চালাত বলে জানান ইমরান-শাহীন।
ইমরান বলেন, “২৪ ঘণ্টায় মাত্র একবার আধা প্লেট ভাত দিত, একটা শুকনা মরিচের সঙ্গে এক কাপ পানি। কেউ আরও ভাত বা পানি চাইলে পেত কিল, ঘুষি আর লাথি। লাঠি ও চাবুক দিয়ে পেটানো ও পিস্তলের দিয়ে মাথায় আঘাত করা হত অনেককেই।”
মাঝে-মাঝে আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য কোনো কারণ ছাড়াই সবাইকে পেটানো হত বলে জানান তারা।
“অতিরিক্ত পানি চাওয়ায় পাচারকারীরা নরসিংদীর এক জনকে পিটিয়ে, জাহাজের পিলারে মাথা ঠুকে হত্যা করে সমুদ্রে ফেলে দেয়। আমাদের সামনে এভাবে চারজনকে হত্যা করে দালালরা,” বলেন শাহিন।
জাহাজের খোলে ৮০০ মানুষ গাদাগাদি করে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে চলার প্রতি মুহূর্তে মরনের ভাবনাই ছিল এই দুই যুবকের মাথায়।
জাহাজ থাইল্যান্ডে ঢুকতে ব্যর্থ হলে জাহাজের খাবার ও পানি ফুরিয়ে আসে, জ্বালানি তেলও প্রায় ফুরিয়ে যায়।
ওই সময় মে মাসের শেষ বা জুনের প্রথম দিকে পাচারকারী চক্রের সদস্যরা অন্য একটি জাহাজে উঠে চলে যায়।
যাওয়ার সময় তারা রান্নার চুলাটিও নষ্ট করে রেখে যায় বলে জানান ইমরান ও শাহিন।
ভাসমান জাহাজের ওই যাত্রীরা তিন দিন ধরে না খেয়ে থাকার পর একটি জেলে ট্রলারের সন্ধান পায়, সেখান থেকে দুই বস্তা চাল ও জ্বালানি হিসেবে ৪০ লিটার তেল আসে।
এরপর মিয়ানমারের নৌবাহিনীর সদস্যরা এসে ইমরানদের উদ্ধার করে। খাবার পানি দিয়ে একটি তালিকা তৈরি করে একটি মানবাধিকার সংগঠনের ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়।
ক্যাম্পে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এসে দেশে ফেরৎ পাঠানোর আশ্বাস দিলেও পরে আর খোঁজ-খবর নেননি বলে অভিযোগ দুই যুবকের।
পালিয়ে দেশে ফেরা
ক্যাম্পে থাকার এক পর্যায়ে ইমরান ও শাহিনসহ কয়েকজন জানতে পারেন, বাংলাদেশের সীমান্ত খুব কাছে।
ইমরান বলেন, “আমরা দুজনসহ সিরাজগঞ্জের তিনজন মোট পাঁচ জন রাতে কাঁটাতারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে ক্যাম্প থেকে পালাই।”
তিন দিন তিন রাত রোদে-বৃষ্টিতে বিভিন্ন পাহাড়ে লুকিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে মিয়ানমার সীমান্তে এক মুসলিম পরিবারের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন তারা।
ওই পরিবারের সহায়তায় নদী পার হয়ে বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফ পৌঁছান বলে জানান ইমরান ও শাহিন।
কক্সবাজার থেকে মাগুরায় ফিরে আনন্দিত ইমরান ও শাহিন। তবে ওই সময়ের কথা বলার সময়ও আতঙ্ক ঠিকরে বেরুচ্ছিল তাদের চোখ-মুখ দিয়ে।