রোহিঙ্গাদের ‘আড়াল করছে’ মিয়ানমার

গত সপ্তাহে পাচারকারীদের একটি নৌযান আটক করে মিয়ানমার ঘোষণা দেয় সেখান থেকে উদ্ধার দুইশ মানুষের অধিকাংশই বাংলাদেশি, যারা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় গিয়ে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি চেয়েছিলেন।

>>রয়টার্স
Published : 27 May 2015, 05:58 PM
Updated : 27 May 2015, 06:07 PM

তবে বার্তাটি স্পষ্ট যে, ওই নৌযানের আরোহীদের অনেকে এবং আন্দামান ও বঙ্গোপসাগরে ‘নৌভাসাদের’ অনেকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্য। রোহিঙ্গাদের প্রতি বৈষম্য বা নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে বাঁচতে তাদের পালানোর বিষয়টি অস্বীকার করছে মিয়ানমার।

তবে ওই নৌযানের কয়েক আরোহী রয়টার্সকে বলেছেন, নৌযানের একটি পয়েন্টেই দেড়শ থেকে দুইশ রোহিঙ্গা ছিলেন। মিয়ানমার নৌবাহিনী নৌযান আটকে তীরে আনার আগের সপ্তাহে পাচারকারীরা সেখান থেকে চুপিসারে রোহিঙ্গাদের নামিয়ে আনে।

রয়টার্সের আগের প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা সম্পর্কে যা বলা হয়েছিল, তার চেয়ে প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি ছিল।

“সব রোহিঙ্গাকে জাহাজ থেকে নামিয়ে আনা হয়েছিল। শুধু বাংলাদেশিরা সেখানে ছিল,” রয়টার্সকে বলেন ২৭ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা নারী, যিনি তার পাঁচ সন্তানকে নিয়ে নৌকায় ছিলেন।

গত বৃহস্পতিবার নৌযানটি আটকের আগেই নিজেদের গ্রাম থেক কে পাইনে ফিরে এসেছিলেন তারা ছয়জন।

আরাফা নামের ওই নারীর বক্তব্য নিরপেক্ষ কোনো সূত্র থেকে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। তবে আরও ছয় গ্রামবাসী বলেছেন, অন্য রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তারাও ওই নৌযানে ছিলেন।

পাচারকারীরা কেন শুধু রোহিঙ্গাদের নৌকা থেকে নামিয়ে নিল সে বিষয়টি স্পষ্ট নয়। দক্ষিণপূর্ব এশিয়াভিত্তিক ফর্টিফাই রাইটস গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক ম্যাথু স্মিথ যুক্তরাষ্ট্র  কংগ্রেসে এক শুনানিতে বলেছেন, মানবপাচারের সঙ্গে মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী জড়িত এবং তারা পাচারকারীদের কাছ থেকে বখরাও পায়।

তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে মিয়ানমার সরকার।

সরকারি প্রচারণা

গত সপ্তাহে রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, নৌকা থেকে উদ্ধারদের মধ্যে আটজন রোহিঙ্গা। মিয়ানমার সরকার প্রথমে উদ্ধারদের সবাইকে বাংলাদেশি এবং আটজনকে ‘মিয়ানমারের বাঙালি’ বলে জানিয়েছিল। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে ‘মিয়ানমারের বাঙালি’ বলে তারা।

জ টাই নামে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা মঙ্গলবার বলেন, নৌকায় বাংলাদেশি এবং আট ‘বাঙালি’ ছাড়া আরও কেউ ছিল না কি না তা তার জানা নেই।

“আগেই কেউ কেউ নৌযান থেকে চলে গেছেন-এমন কোনো তথ্য আমাদের দপ্তরে আসেনি,” রয়টার্সকে বলেন তিনি।

বাংলাদেশি অভিবাসীদের দেখতে জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল মিয়ানমার সরকার এবং নৌযান থেকে তাদের উদ্ধারের বিষয়টি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে খুব গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা হয়।

মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে দমন অভিযানের পর চলতি মাসের শুরুর দিকে থাইল্যান্ড মানবপাচারের রুটগুলো বন্ধ করার পাশাপাশি ‍কিছু নৌযান থেকে লোকজনকে তাড়িয়ে দেয়। সে সময় মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার তীরে ওঠে কয়েক হাজার মানুষ। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ঊপকূলে পাচারকারীদের নৌযানে আটকা পড়ে অন্যরা।

ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশীয় কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে, ওই সব নৌযানের আরোহীরা বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা।

দেওয়ালে পিঠ ঠেকার পরিস্থিতি

গত সপ্তাহে মিয়ানমার সফরকালে যুক্তরাষ্ট্রের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টোনি ব্লিনকেন বলেন, এ মাসে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় আশ্রয় নেওয়া তিন হাজারের বেশি অভিবাসীর অধিকাংশ রোহিঙ্গা মুসলিম, যারা মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে ‘যে প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়’ তার থেকে বাঁচাতে পালিয়েছিলেন।

পরে এ বিষয়ে রাখাইন প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মাউং মাউং ওন রয়টার্সকে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে অভিযোগ করা হয়েছে তাতে আমি হতাশ এবং ‘অবাস্তব’ এই অভিযোগ পুরোপুরি নাকচ করছি।

“এটা মানবপাচার, রাষ্ট্রীয় বা ধর্মীয় বৈষম্যের কারণে এটা মোটেও ঘটছে না।”

মিয়ানমারের অন্য কর্মকর্তাদের দাবি, জাতিসংঘের সহায়তা পেতে বাংলাদেশিরা নিজেদের রোহিঙ্গা বলে দাবি করছে।

মিয়ানমারের ১১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমের অধিকাংশই দেশহীন এবং রাখাইন প্রদেশে তারা বর্ণবাদী সমাজের মতো পরিস্থিতিতে বসবাস করে। ২০১২ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুৎ হয়। তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয় না এবং দীর্ঘকাল ধরে তারা রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার হওয়ার অভিযোগ করে আসছে।

রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে কর্মরত গ্রুপ ‘আরাকান প্রজেক্ট’র তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা অন্য দেশে পালিয়ে গেছে।

নাম প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়ে সাত গ্রামবাসী ও দুই কম্যুনিটি লিডার রয়টার্সকে বলেন, যে নৌযানটি মিয়ানমার নৌবাহিনী আটক করেছে সেটির মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার কথা ছিল। অবৈধভাবে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুদের তুলতে প্রায় দুই মাস ধরে সেটি মিয়ানমারের জলসীমায় নোঙর করা ছিল।

নৌযানে দুইশ’র মতো বাংলাদেশি এবং দেড়শ থেকে দুইশ রোহিঙ্গা উঠানোর মধ্যে থাইল্যান্ডে মানবপাচারের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়।

ওই নৌযান থেকে ফিরে আসা সাত রোহিঙ্গা অভিবাসী জানান, গত বৃহস্পতিবার নৌবাহিনী জাহাজটি তীরে আনার আগের এক সপ্তাহে ছোট ছোট মাছ ধরার নৌকা সেখানে গিয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসে।

আরাফা নামের ওই নারী জানান, মালয়েশিয়ায়ে স্বামীর কাছে যেতে চেয়েছিলেন তিনি এবং তাকে বিনা পয়সায় জাহাজে নেমে আসার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। অন্যদের অধিকাংশকেই নিজেদের গ্রামে ফিরে আসার জন্য পাচারকারীদের ২০০ থেকে ৩০০ ডলার করে দিতে হয়েছিল।

তাদের একজন ১৮ বছর বয়সী মোহামেদ আনিস রাখাইন প্রদেশের রাজধানী সিতের কাছের একটি গ্রামের বাসিন্দা।

“প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য খাবার আমরা ভাগাভাগি করে খেতাম এবং যে দুর্বল তাকে সবাই মিলে সহযোগিতা করতাম,” বলেন তিনি।

আনিস ও আরাফা জানান, দিনে দুই কাপ পানি ও অল্প কয়টা ভাত দেওয়া হত তাদের। কেউ কথা বললে রড দিয়ে পেটানো হত।

হাত ও পায়ে অনেকগুলো সাদা দাগ দেখিয়ে আনিস বলেন, বেশ কয়েকবার মারধরের শিকার হয়েছিলেন তিনি।

“আমাদের অপেক্ষার মধ্যে ছয় বাংলাদেশি দুর্বলতায় অসুস্থ হয়ে মারা যান। নাবিকেরা সাগরে তাদের লাশ ফেলে দিয়েছিল,” বলেন তিনি।

জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের সামনে যখন সাগর থেকে উদ্ধার বাংলাদেশিদের হাজির করা হয়েছিল সে সময় রয়টার্সের তোলা কিছু ছবি দেখে আলাদা আলাদাভাবে শনাক্ত করেন আনিস, আরাফা ও অন্য গ্রামবাসী। সঠিকভাবে তাদের নামও বলেন তারা। তাদের সঙ্গে একই নৌযানে কাটানোর কথাও জানান তারা।