‘কণ্ঠরোধে রাষ্ট্রযন্ত্র’

বাংলাদেশে গত এক বছরের চিত্র তুলে ধরে একটি মানবাধিকার সংগঠন বলেছে, এই সময়ে রাষ্ট্রের মাধ্যমে সাংবাদিকদের হয়রানির মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 May 2015, 12:53 PM
Updated : 4 May 2015, 06:17 AM

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে রোববার সাংবাদিক হত্যা, নির্যাতন ও হয়রানি নিয়ে ‘ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন ইন বাংলাদেশ-২০১৪’ প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘আর্টিকেল নাইনটিন’, বাক স্বাধীনতা ও সুরক্ষা নিয়ে কাজ করে যারা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে ২০৫ জন সাংবাদিক ও ৮ জন ব্লগার বিভিন্নভাবে আক্রমণের শিকার হয়েছেন।

সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীদের মধ্যে অধিকাংশই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী বলে আর্টিকেল নাইনটিনের পর্যবেক্ষণ। আর এর কোনোটিতেই হামলাকারীদের শাস্তি হয়নি।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদন উপস্থাপন করে আর্টিকেল নাইনটিনের বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক তাহমিনা রহমান বলেন, “আমরা বলতে চাই, আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করা, তদন্তে ধীরগতি এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি সাংবাদিকদের জন্য চরম বাস্তবতা হিসেবে দেখা দিয়েছে বাংলাদেশে।

“আইনের ফাঁক-ফোকর, মতামত প্রকাশের জন্য ভয়ভীতির সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণের (সেলফ সেন্সরশিপ) প্রবণতা বাড়িয়েছে।”

সাংবাদিকদের নিরাপত্তার জন্য একটি কার্যকর সুরক্ষা কৌশল ও নীতিমালার সুপারিশ করেছে আর্টিকেল নাইনটিন। তথ্য প্রযুক্তি আইন, মানহানি ও আদালত অবমাননা সংক্রান্ত আইনগুলোকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার সুপারিশও রেখেছে তারা।

হয়রানি বেড়েছে ১০৬%

প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে তাহমিনা রহমান বলেন, ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে সাংবাদিকদের ওপর হয়রানির ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে শতকরা ১০৬ ভাগ। এর মধ্যে রয়েছে ১০টি ফৌজদারি মামলাও।

কয়েকটি উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের পরিমাণ বেড়েছে ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ। ১৯টি মামলা পেয়েছি যেখানে হুমকি ও ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুসারে, ২৩ ভাগ ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা আক্রান্ত হয়েছে পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাইরে ১১ শতাংশ আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে সরকারিকর্মীদের দ্বারা।

এতে আরও বলা হয়, ৬৬ দশমিক ৩১ ভাগ আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বাইরে থেকে। এর মধ্যে ৩৩ দশমিক ৬৯ ভাগ ঘটনা ঘটিয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা।

২০১৪ সালে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংস একটি ঘটনায়ও বিচারের মাধ্যমে কাউকে শাস্তি দেওয়ার তথ্য পায়নি আর্টিকেল নাইনটিন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, মাত্র পাঁচটি ঘটনায় তদন্ত শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ২৭ শতাংশ ঘটনার তদন্ত প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ৭০ শতাংশ ঘটনা আইনের আওতার বাইরে রয়ে গেছে।

তাহমিনা রহমান বলেন, “সাংবাদিকরা বলেছেন, অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই কোনো ব্যবস্থা নেননি। অনেক ক্ষেত্রে তাদের ওপর চাপ এসেছে মীমাংসা করে নিতে। এ কারণে দেখা যাচ্ছে ৭০ ভাগ ঘটনা আইনের আওতার বাইরে রয়েছে।”

প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৫৬ দশমিক ৫৫ ভাগ আক্রমণের ঘটনায় কোনো আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অধিকাংশ ঘটনায় সাংবাদিকরা সাধারণ জিডি করেননি। অন্যান্য ঘটনার ক্ষেত্রে পুলিশ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

হত্যা ও নির্যাতন

প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০১৪ সালে ২০৫ জন সাংবাদিক ও আটজন ব্লগার বিভিন্নভাবে আক্রমণের শিকার হয়েছেন।

এর মধ্যে চারজন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। তারা হলেন শাহআলম মোল্লা, সরকার নিপুল, দেলোয়ার হোসেন, জি এম বাবর আলী।

সাংবাদিক শাহ আলম মোল্লার প্রসঙ্গ টেনে তাহমিনা বলেন, “রাজধানীর ঢাকার উত্তরা ট্রাস্ট কলেজের অধ্যক্ষের দুর্নীতি বিষয়ক পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ করায় উত্তরা মডেল থানা পুলিশ কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে থানার ছাদ থেকে পড়ে যান তিনি। তার স্বজনরা জানিয়েছেন, পুলিশ তাকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছে।”

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ৪০ জন সাংবাদিক গুরুতর জখম হন গত বছর। তাদের মধ্যে ২৪ জনকে রবার বুলেট, রাইফেল, লাঠি দিয়ে মারপিট এবং গ্রেনেড ও ককটেল দিয়ে আহত করা হয়েছে। এসব ঘটনায় হামলাকারীদের মধ্যে বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ছিলেন।

আক্রান্ত সাংবাদিকদের মধ্যে ১৯ জন বা ৮ দশমিক ৯ শতাংশ হুমকির শিকার হয়েছেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এসব মামলার ধরনগুলোতে দেখা গেছে, মৃত্যুর হুমকি, পরিবার পরিজনের প্রতি আক্রমণ ইত্যাদি।

প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে আটজন ব্লগার ও অনলাইন ব্যবহারকারীসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে ১৩ জন তথ্য প্রযুক্তি আইনের আওতায় গ্রেপ্তার হয়েছেন,  এদের আটজন এখনও কারাগারে।

সম্পাদক, প্রকাশক ও সাংবাদিক নেতাসহ ১৩ জন আদালত অবমাননার অভিযোগের মুখোমুখি হন গত বছর।

লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য

সংবাদ সম্মেলনে তাহমিনা রহমান বলেন, নারী সাংবাদিকরা এখনও কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে যখন তারা বিভিন্ন সমিতি বা প্রেস ক্লাব বা কোনো সংস্থায় নেতৃত্ব দিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তখন এই সমস্যা প্রকট হয়ে উঠছে।

উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, পাঁচজন জ্যেষ্ঠ নারী সাংবাদিক দীর্ঘদিন ধরে একটি জাতীয় পত্রিকায় চাকরিরত ছিলেন। এক পর্যায়ে নোটিস ছাড়াই তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। আদালতে মামলা করে পক্ষে রায় পেলেও এখনও বকেয়া পাওনা বুঝে পাননি তারা।

সুপারিশ

আইনের অস্পষ্টতা ও দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সাংবাদিক, ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের হয়রানির সুযোগ পায় বলে আর্টিকেল নাইনটিনের মূল্যায়ন।

তথ্য প্রযুক্তি আইনে ৫৭ ধারায় অপরাধকে সুস্পষ্ট না করার বিষয়টিও তুলে ধরেছে তারা। ওই ধারায় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা রয়েছে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ইমেজ ক্ষুণ্ন করা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা ইত্যাদি।

তাহমিনা রহমান বলেন, “সেগুলোকে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজেদের ব্যাখ্যা দিতে পারে এবং তার ফলে স্বেচ্ছাচারীভাবে সে আইনটাকে প্রয়োগ করতে পারে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে অনলাইনে নির্দোষ প্রচারণার কারণে সাংবাদিক ও ব্লগাররা আইনি হয়রানির শিকার হয়েছেন।”

সংবাদ সম্মেলনে কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরে তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে আইনের শাসনের অনুপস্থিতির কারণে রাষ্ট্রযন্ত্র এমনকি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা সহিংস আক্রমণের ঘটনা ঘটিয়েছে।

২০১২ সালে জাতিসংঘ গৃহীত সাংবাদিকদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত পরিকল্পনায় বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন দেওয়ার তথ্য তুলে ধরেন তাহমিনা।

সে অনুযায়ী মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর যে কোনো আঘাতকে সরকারিভাবে দ্ব্যর্থহীনভাবে নিন্দা জানানো, ঘটনার দ্রুত ও যথাযথ তদন্ত ও বিচার করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিতের সুপারিশ করেন তিনি।

তাহমিনা বলেন, “সাংবাদিকদের নিরাপত্তার জন্য একটি কার্যকর সুরক্ষা কৌশল ও নীতিমালার প্রয়োজন, যা গণমাধ্যমকর্মীসহ সবার মুক্ত চিন্তার প্রকাশে সহায়ক হবে। যেখানে একটি স্বাধীন সংস্থা কাজ করবে।”

তথ্য প্রযুক্তি আইন, মানহানি ও আদালত অবমাননা সংক্রান্ত আইনগুলোকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার সুপারিশ জানানোর পাশাপাশি কর্মীরা আক্রান্ত হলে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোগও চেয়েছে আর্টিকেল নাইনটিন।

আয়োজকরা জানান, বাক স্বাধীনতা নিয়ে আর্টিকেল নাইনটিন বিশ্বব্যাপী কাজ করছে। বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া কার্যালয়ের পক্ষ থেকে ২০১১ সাল ধরে নিয়মিতভাবে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ হচ্ছে।