ভোট জালিয়াতি করে সবই হারালেন লুৎফুর

বিতর্কিত বাংলাদেশি লুৎফুর রহমান ভোট জালিয়াতি করে গত বছর লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসে মেয়র হয়েছিলেন বলে প্রমাণিত হয়েছে।

আজিজ হাসানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 April 2015, 11:34 AM
Updated : 23 April 2015, 11:34 AM

এ জন্য পূর্ব লন্ডনের স্থানীয় ওই কাউন্সিলে নতুন করে ভোট হবে, তবে সেই ভোটে আর অংশ নিতে পারবেন না তিনি। সেইসঙ্গে আড়াই লাখ পাউন্ড জরিমানাও গুণতে হচ্ছে তাকে।

গত বছর দ্বিতীয় মেয়াদে টাওয়ার হ্যামলেটসে মেয়র পদে ভোটে জয়ী লুৎফুরের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ। উগ্র ইসলামি গোষ্ঠীকে মদদ দেওয়ার পাশাপাশি লন্ডনে থাকা একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।

লুৎফুরকে ভোট না দিলে তা ‘ইসলামবিরোধী’ হবে বলে ২০১৪ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রচার চালানোর অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে, সেইসঙ্গে নির্বাচনে প্রভাব খাটানোর অভিযোগও ওঠে।

চার ভোটারের ওই অভিযোগ তদন্তের পর হাই কোর্টে শুনানি শেষে নির্বাচন কমিশনার রিচার্ড মওরি গত বছর অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচন বাতিলের রায় দিয়েছেন বলে বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম জানিয়েছে।

ভোট জালিয়াতি, ইমামদের দিয়ে ভোটে প্রভাব বিস্তার, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে বর্ণবিদ্বেষের অপপ্রচার এবং সরকারি অর্থ দিয়ে ভোট কেনার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে লুৎফুরের বিরুদ্ধে।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনার টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র পদ শূন্য ঘোষণা করে সেখানে পুনর্নির্বাচনের আদেশ দিয়েছেন। তবে সেই ভোটে লুৎফুরের অংশ নেওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

লুৎফুরকে আড়াই লাখ পাউন্ড জরিমানার পাশাপাশি নির্বাচনী আইন ভঙ্গে দোষী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন তার সহযোগী আলিবর চৌধুরীও।

শুরু থেকে সব অভিযোগ অস্বীকার করে আসা লুৎফুরের পক্ষ থেকে এই রায়ে হতাশা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, তারা এই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আইনি উদ্যোগ নেবেন।

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় লন্ডনের মেয়র বরিস জনসন বলেন, “আমি খুব আনন্দিত যে, ন্যায়বিচার হয়েছে এবং টাওয়ার হ্যামলেটস থেকে কালো মেঘ কেটে গেছে।

বরিস জনসন

“সামনের নির্বাচন নিয়ে এগিয়ে যাওয়া এবং এমনটি যাতে আর না ঘটে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা এখন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।”

এর আগে লুৎফুরের ক্ষমতা খর্ব করে কাউন্সিলের অনুদানের অর্থ বরাদ্দ ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বিক্রয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তার কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছিল সরকার।

বাংলাদেশি লুৎফুর এক সময় লেবার পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, দলটির হয়ে তিনি টাওয়ার হ্যামলেটস বারা কাউন্সিলে কাউন্সিলর হয়েছিলেন।

লেবার পার্টি থেকে মনোনয়ন না পেয়ে ২০১০ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মেয়র নির্বাচন করে বিজয়ী হন। চার বছর পর আবার তিনি স্বতস্ত্র প্রার্থী হিসেবে মেয়র পদে প্রার্থী হন।

প্রথম দফা ভোটে লুৎফুর রহমান পেয়েছিলেন ৪৩ শতাংশ ভোট। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী লেবার পার্টির জন বিগস পান ৩৩ শতাংশ ভোট।

কেউ ৫০ শতাংশ ভোট না পাওয়ায় দ্বিতীয় দফা ভোটে বিগসের ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশের বিপরীতে ৫২ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পেলে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় লুৎফুরকে।

ভোটের আগে থেকে লুৎফুরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠছিল। ভোটের পর চারজন ভোটার নির্বাচন কমিশনে ভোটে প্রভাব সৃষ্টিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ করেন।

রয়াল কোর্টস অফ জাস্টিসে সেই অভিযোগের বিষয়ে ১০ সপ্তাহ শুনানির পর রায় হল।

আদালতের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে অভিযোগকারীদের নেতৃত্বদানকারী অ্যান্ডি এরলাম বলেন, “গণতন্ত্রের জন্য এটা চমৎকার রায়। এবার নতুন করে মেয়র নির্বাচন হবে। জনাব রহমান দাঁড়াতে পারবেন না।”

অভিযোগকারী আজমল হুসাইন, অ্যাঞ্জেলা মুফাত ও অ্যান্ডি এরলাম

‘দুর্নীতি ও ভোটারদের ভয় দেখিয়ে’ লুৎফুর রহমান গত বছরের মে মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেন ওই চারজন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে পুনর্নির্বাচনের পাশাপাশি তাতে অংশগ্রহণে লুৎফুরের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয়েছিল।

বিচারক বলেছেন, নির্বাচনী প্রচারে ‘ধর্ম’ ও ‘বর্ণবাদ’কে কাজে লাগিয়েছেন লুৎফুর রহমান। নির্বাচনের পুরো সময় ‘রেইস ও ইসলামফোবিয়া কার্ড’ খেলেছেন তিনি।

“নিঃসন্দেহে তিনি দুর্নীতি ও অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন।”

ভোটের দিন লুৎফুর রহমানের সমর্থকদের আচরণ নিয়েও আদালতের উত্থাপিত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তাকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন বিচারক।

“বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা জনগোষ্ঠী থেকে এটা আসেনি। কোনো সামাজিক বা অন্য কোনো বঞ্চনা থেকেও এটা হওয়ার নয়। কোনো একজন ব্যক্তির ভয়ানক লালসার ফল এটা। এই ঘটনায় প্রকৃত অর্থে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা টাওয়ার হ্যামলেটসের জনগণ।”

কোনো এক ব্যক্তিই কয়েকশ ব্যালট পেপার পূরণ করেছেন-এ অভিযোগের পক্ষে আদালতে একজন হস্তলিপি বিশেষজ্ঞের অভিমত তুলে ধরা হয়।

প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী লেবার পার্টির জন বিগসের চরিত্র সম্পর্কে ভুয়া বিবৃতি তৈরির অভিযোগও রয়েছে লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে।

লুৎফুর রহমান

আবেদনকারীদের একজন আদালতে বলেন, তিনি একটি ভোটকেন্দ্রের বাইরে একজন ভোটারকে কাঁদতে দেখেন, যাকে বলা হয়েছিল লুৎফুর রহমানকে ভোট না দিলে তা ‘অনৈসলামিক’ হবে এবং ‘আপনি যদি তাকে ভোট না দেন তাহলে আপনি ভালো মুসলিম নন’।

ভোটে জিততে ঘুষ প্রদান এবং ভোট কেন্দ্রের ভেতরে ভোটারদের ভয় দেখানোর বিষয়গুলো আদালতে উঠে আসে।

অনিয়মের মাধ্যমে নিজের সমর্থকদের সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি নিজের নির্বাচনী প্রচারে লুৎফর কাউন্সিলের অর্থ ব্যয় করেন বলে যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা হিসাব নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটারহাউজ কুপারসের নিরীক্ষায় উঠে আসে।

গত নভেম্বরে ওই নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশের পর মেয়র লুৎফুর রহমানের ক্ষমতা খর্ব করে কাউন্সিলের অনুদানের অর্থ বরাদ্দ ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বিক্রয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কেড়ে নেয় সরকার।

২০০৮ সালে ‘জার্নালিস্ট অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কারে ভূষিত অ্যান্ড্রু গিলিগান গত বছর তার এক লেখায় লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে উগ্রপন্থী গোষ্ঠী ‘ইসলামি ফোরাম অব ইউরোপ’র সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তোলেন।

এন্ড্রু গিলিগান

উগ্রপন্থি এই সংগঠনটি ব্রিটেনে ‘ইসলামি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা’ চালু করতে চায়। 

লুৎফুরের সঙ্গে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর সম্পর্ক  নিয়ে সে সময় সরব হয়েছিলেন টাওয়ার হ্যামলেটসের অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি। এতে তাদের কম্যুনিটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছিলেন তারা।

তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, লুৎফুরের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে লন্ডনভিত্তিক জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের, যারা চৌধুরী মুঈনুদ্দিনের মতো দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীকে বাঁচানোর চেষ্টায় আছেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত সাবেক এই আলবদর কমান্ডার তাকে দেশে ফিরিয়ে বিচারের মুখোমুখি করতে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগকে পাত্তা দেননি।

পূর্ব লন্ডনের এক প্রবাসী বাংলাদেশি পেশাজীবী সে সময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,“লুৎফুর রহমানের রাজনীতির সঙ্গে মৌলবাদী ও স্থানীয় পাকিস্তানিদের সম্পর্ক আছে, যা যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশিদের উপর বদনাম ছড়াচ্ছে। ১৯৭১ সালের আগে-পরে অনেক ভোগান্তির শিকার, আমরা বাঙালিরা এইসব পাকিস্তানিদের সঙ্গে থাকাকে ঘৃণা করি।”

তবে সম্ভাব্য প্রতিশোধের আশঙ্কায় তিনি নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি।

তিনি বলেন, লুৎফুর মোল্লাদের সমর্থনপুষ্ট, যারা হোয়াইট চ্যাপেল রোডে পূর্ব লন্ডন মসজিদে চরমপন্থিদের জন্য আস্তানা তৈরি করেছে।