মেয়র লুৎফরের অনিয়ম: নিরীক্ষায় যা পাওয়া গেছে

লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলটেস কাউন্সিলের মেয়র বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপার্সের নিরীক্ষা প্রতিবেদনের উল্লেখযোগ্য অংশ-

>>বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Nov 2014, 06:05 AM
Updated : 7 Nov 2014, 06:05 AM

১. সার্বিকভাবে করদাতাদের অর্থ যথাযথভাবে ব্যয়ের ক্ষেত্রে টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র লুৎফুর রহমান উপর্যুপরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। স্বজনপ্রীতি, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, স্বেচ্ছাচরিতা, স্বচ্ছতার অভাব এবং নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করার অসংখ্য প্রমাণ মিলেছে নিরীক্ষায়।

২. পপলার টাউন হল বিক্রি নিয়ে অনিয়মের আরও নতুন তথ্য এসেছে এই নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, যাদের কাছে পপলার টাউন হল বিক্রি করা হয় নিলামে তারা সর্বোচ্চ দরদাতা ছিলেন না। তারা ছিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা। এছাড়া দরপত্র দাখিলের সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও তাদের দরপত্র গ্রহণ করা হয়, যা ছিল নিয়মের বরখেলাপ। এতে করে দরপত্রে কারচুপির সুযোগ তৈরি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত পপলার টাউন হল যাদের কাছে বিক্রি করা হয় (ড্রিমস্টার কোম্পানি) তাদের একজন মেয়রের অনুগ্রহভাজন বলে নিরীক্ষায় সত্যতা পাওয়া যায়।

পপলার টাউন হল নামের ভবনটি মাত্র ৮ লাখ ৭৫ হাজার পাউন্ডে বিক্রি করা হয় মেয়র লুৎফর রহমানের নির্বাচনী প্রচারে সরাসরি যুক্ত ছিলেন এমন এক ব্যক্তির কাছে। কাউন্সিলের একজন কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ৮ লাখ ৭৬ হাজার পাউন্ডের দরদাতাই যে সর্বোচ্চ দরদাতা, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার পর কর্পোরেট ডাইরেক্টর (ডিঅ্যান্ডআর) তার সঙ্গে একমত হন। কিন্তু তারপরও ‘উপরের নির্দেশের’ অজুহাত দিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দর গ্রহণ করা হয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ড্রিমস্টার নামের যে কোম্পানির দরপত্র গ্রহণ করা হয়, তাদের চার সপ্তাহের মধ্যে অর্থ জমা দেওয়ার কথা থাকলেও সেই অর্থ তাদের ছিল না। মূল চুক্তিতে পপলার টাউন হল সাবলেট দেওয়ার অনুমতি ছিল না। কিন্তু পরে ড্রিমস্টারের আবেদনে চুক্তি সংশোধন করে সাবলেটের অনুমতি দেওয়া হয়।

বর্তমানে ওই ভবনকে একটি পাঁচতারা হোটেল বানানোর প্রক্রিয়া চলছে।

৩. সাটন স্ট্রিট ডিপো নিলামে বিক্রির ক্ষেত্রেও অনিয়ম দেখতে পেয়েছেন নিরীক্ষকরা। এক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ দরদাতাকে এই প্রোপার্টি দেওয়া হয়নি। বরং সময়সীমা শেষ হওয়ার ২১ দিন পর জমা পড়েছে এমন একজন দরদাতাকে সাটন স্ট্রিট ডিপো দেওয়া হয়।

এক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া হয় যে ওই দরদাতা স্থানীয়দের জন্য অনেক সুযোগ সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। কিন্তু অন্য দরদাতাদের এরকম প্রস্তাব দেওয়ার কোনো সুযোগ দেওয়া হয়েছিল বলে প্রমাণ পাননি নিরীক্ষকরা। সাটন স্ট্রিট ডিপো এবং পপলার টাউন হলের মতো আরও অনেক প্রোপার্টি যথাযথ নিয়ম না মেনে বিক্রি করা হয়েছে বলেও নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

৪. মেয়র এমন সব প্রতিষ্ঠানকে কাউন্সিলের অনুদান দিয়েছেন যাদের অনুদান পাওয়ার যোগ্যতা ছিল না। মোট ৪ লাখ ৭ হাজার ৭শ’ পাউন্ড অনুদান দেওয়া হয় এধরনের ‘ভুয়া’ প্রতিষ্ঠানকে। অনুদান পাওয়ার জন্য কাউন্সিলের যে ন্যূনতম নিয়ম-নীতি মেনে চলতে হয়, এসব প্রতিষ্ঠানের তারও বালাই ছিল না।

৫. কাউন্সিলের কর্মকর্তারা অনুদানের জন্য যেসব প্রতিষ্ঠানকে বাছাই করে সুপারিশ করেন, তার ৮০ শতাংশই মেয়র লুৎফর রহমান এবং তার কাউন্সিলাররা সরাসরি হস্তক্ষেপ করে বদলে দেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

৬. প্রতিবেদনে বলা হয়, টাওয়ার হ্যামলেটসের ইহুদি, শিখ ও হিন্দু কমিউনিটির বিভিন্ন ক্লাবের জন্য অনুদানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই প্রস্তাবের সূত্র ধরে বাংলাদেশি এবং সোমালীয় বিভিন্ন ক্লাবকে ৯৯ হাজার ২১২ পাউন্ড বরাদ্দ করা হয়, যদিও এরা অনুদানের জন্য আবেদনই করেনি।

৭. কাউন্সিলের বিভিন্ন বাজেটের উদ্বৃত্ত তহবিল দিয়ে মেয়র ‘নাইন ফিফটি ফোর ফান্ড’ নামের ১ মিলিয়ন পাউন্ডের একটি তহবিল গঠন করেন। এই তহবিল থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অনুদান দেওয়া হয়। অনুদানের জন্য কোনো উন্মুক্ত আবেদন প্রক্রিয়া রাখা হয়নি। মেয়র তার নিজের পছন্দমাফিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অর্থ বরাদ্দ করেন। এমন এক প্রতিষ্ঠানকে ৩৬ হাজার পাউন্ড অনুদান দেওয়া হয়, যাদের অন্য একটি চুক্তির অধীনে আগেও অর্থ দেওয়া হয়েছিল।

৮. অনুদানপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাউন্সিলের চুক্তির কোনো স্বাক্ষরিত দলিলপত্র রাখা হয়নি। এসব অনুদানের যথাযথ হিসাব বা তদারকিও ছিল না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

৯. বিবিসির প্যানোরমা অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হওয়ার পরও মেয়র কোনো ব্যবস্থা নেননি। প্যানোরমার অনুসন্ধানী রিপোর্টে বলা হয়েছিল, কিছু কিছু স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের অনুদানের পরিমাণ বাড়াতে মেয়র ব্যক্তিগতভাবে হস্তক্ষেপ করেন। এতো অভিযোগের পরও কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ তদন্তের পরিবর্তে বিষয়গুলো চোখ-কান বুজে অস্বীকার করতে চেয়েছেন বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

১০. নিরীক্ষকরা বলছেন, বিবিসির প্যানোরামা অনুষ্ঠান বন্ধের জন্য মেয়র সিটির একটি ল’ ফার্ম ‘টেলর ওয়েসিং’ এবং পাবলিক রিলেশন্স ফার্ম ‘চ্যাম্পোলিনে’র পেছনে কাউন্সিল বাজেটের ১ লাখ ১ হাজার ৪৭৯ পাউন্ড খরচ করেছেন।

১১. মেয়র লুৎফুর রহমান প্রধান নির্বাহী পদের অনেক ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন বলে উল্লেখ করা হয় নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, তিনি গুরুত্বপূর্ণ অনেক উচ্চপদে কর্মকর্তা নিয়োগ করেননি, করলেও অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ করতেন। তার কাউন্সিলাররা নিয়মিতভাবে করদাতাদের অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের দেওয়া বিভিন্ন উপদেশ অগ্রাহ্য করতেন।

১২. টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের ২৫ লাখ পাউন্ড এক ‘ইয়ুথ প্রোগ্রামে’ খরচ করা হয়। এক্ষেত্রে সম্ভাব্য কারচুপি এবং অনিয়মের অভিযোগ পুলিশ তদন্ত করছে। কিন্তু পিডব্লিউসির নিরীক্ষকরা দেখেছেন, অন্তত ১১টি অনুদানের মধ্যে ৯টির অর্থে যে কেনাকাটা হয়েছে, কাগজেপত্রে তার কোনো রেকর্ড নেই। পিডব্লিউসি তাদের এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পুলিশকে দেবে বলে জানিয়েছে।

১৩. নিরীক্ষকরা বলছেন, লন্ডনের পাঁচটি বাংলা টিভি চ্যানেলে জনগনের ট্যাক্সের অর্থে কাউন্সিলের যে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয় তাতে মেয়রকেই ইতিবাচকভাবে তুলে ধরা হয়, যা সম্প্রচার নীতিমালার লংঘন। নিরীক্ষার সময় মেয়রের লোকজন পাঁচটি টিভি চ্যানেলকে অর্থ দেওয়ার কথা স্বীকার করেন। এই পাঁচটি টেলিভিশন হচ্ছে এটিএন বাংলা, বাংলা টিভি, প্রাইম বাংলা লিমিটেড, চ্যানেল এস গ্লোবাল লিমিটেড এবং রানার্স টিভি লিমিটেড। মেয়রের নির্বাচনী প্রচারেও করদাতাদের অর্থ ব্যয়ের প্রমাণ পেয়েছেন নিরীক্ষকরা।

১৪. নিরীক্ষকরা মেয়র অফিসের ৩ জন মিডিয়া অ্যাডভাইজরের বিষয়েও খোঁজ খবর নেন। মেয়রের প্রথম মেয়াদে এদের পিছনে ৩ লাখ ১৩ হাজার ৫শ’ পাউন্ড খরচ করা হয়, যা জগনের ট্যাক্সের অর্থ। মেয়র অফিসের প্রধান অ্যাডভাইজরদের এসব পেমেন্ট টাইমশিট বা ভাউচার অনুযায়ী অনুমোদন করেন। কিন্তু তারা কী কাজ করেন তার কোনো বর্ণনা এতে নেই।

মেয়রের মিডিয়া অ্যাডভাইজরদের পেছনে অর্থব্যয় কাউন্সিল কর্তৃপক্ষের সুবিধার জন্য নাকি মেয়রের রাজনৈতিক দলের জন্য সে প্রশ্নও তোলা হয়েছে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে।

১৫. কাউন্সিলের বিভিন্ন প্রয়োজন মেটাতে বিভিন্ন ঠিকাদার কোম্পানি কাজ করে। নিরীক্ষায় দেখা গেছ,ে মেয়র যেসব কোম্পানিকে চান না, তা তিনি চিহ্নিত করে দিয়েছেন।