‘নারীমুক্তির জন্য ভাঙতে হবে সমাজ কাঠামো’

নারীর শ্রমকে সমাজে অদৃশ্য না রেখে মূলধারায় নিয়ে এলে দেশের জিডিপির পরিমাণ বাড়বে বলে মনে করেন তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 March 2015, 07:20 PM
Updated : 27 March 2015, 07:20 PM

তিনি বলেন, “ইতিহাস, অর্থশাস্ত্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞান- সবক্ষেত্রেই নারীকে আমরা অদৃশ্য রাখতে চাই। কিন্তু নারীর শ্রম ছাড়া পুরুষের অস্তিত্ব নেই। নারীর শ্রমকে মূলধারায় আনলে জিডিপি বা জাতীয় উৎপাদন শতকরা ৬০ ভাগ বেড়ে যাবে। আর নারী নিরাপদ হলে তার স্বামী, বাবা-ভাইও নিরাপদ হবে।”

শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বিএমএ মিলনায়তনে বিপ্লবী নারী সংহতির দশম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

সম্মেলনে নারীকে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে আনু মুহাম্মদ বলেন, “নারীর চিন্তাশক্তির জট খুলতে হবে, সংগঠিতভাবে প্রতিরোধ করতে হবে এবং নতুন সমতার সমাজের লক্ষ্য গ্রহণ করতে হবে।”

সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন বলেন, “পুরো সমাজ এতই সহিংস যে নারী নিয়ে কথা বলাই দুরূহ হয়ে পড়েছে। যেখানে শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণেই নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নারী আজ যৌতুকের জন্য নির্যাতিত হচ্ছে, কারণ সে মেয়ে। সে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, কারণ সে ধর্ষণযোগ্য ও ভোগ্যপণ্য। ফলে সরাসরি নির্যাতন তো হচ্ছেই, তার উপর নারী হওয়ার কারণে তা আরো বেশিমাত্রায় হচ্ছে।”

বিশ্বকাপ ক্রিকেটেও নারীকে হেয় করার অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, নারী এখন হাসাহাসির বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিশ্বকাপে হ্যাপী ও আনুশকাকে নিয়ে যা হল! আমরা সমতার সমাজ চাই। কিন্তু যতদিন বৈষম্য থাকবে ততদিন তা অসম্ভব। তাই আমাদের যুদ্ধ নারীকে হেয় করার সংস্কৃতি থেকে বের করে আনা।

মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান মূল্যায়িত হয়নি বলেও দাবি করেন অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন।

তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান কেবল সে ধর্ষিত। কিন্তু নারী যে আহত হয়েছে, কিংবা তারচেয়ে গুরুতর তার গুরুত্ব আমরা দেই না। সমাজ মনে করে, নারী আসলে মানুষ নয়, মানুষের চেয়ে কম।”

বিপ্লবী নারী সংহতির সমন্বয়কারী শ্যামলী শীল বলেন, “আমাদের সংগ্রাম হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম, আর এ সংগ্রাম রাজনৈতিক সংগ্রাম। কারণ পুরুষতান্ত্রিকতার কেন্দ্র হচ্ছে রাষ্ট্র। সেজন্যই ভবন ধসে যখন নারী জীবন দেয় তখন রাষ্ট্র সাক্ষী-গোপালের ভূমিকা পালন করে। এজন্য আমাদের রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হতে হবে।”

পুরুষ সমাজ মুনাফার জন্য প্রয়োজনীয় অধিকার দেয় দাবি করে তিনি বলেন, দেশে শতকরা ৮০ ভাগ নারী কর্মক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন। যোগ্যতা থাকলেও তারা বড় জায়গায় যেতে পারছেন না।

ধর্ষণ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে নারীর কোন স্বীকৃতি মেলেনি বলেও দাবি করেন শ্যামলী শীল।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাসিম আখতার হোসাইন বলেন, মুক্তিযুদ্ধে নারীর স্বীকৃতি মেলেনি। অথচ যুদ্ধাপরাধের বিচারে ধর্ষণের প্রমাণ দিতে নারীকে সাক্ষী হিসেবে দাঁড় করানো হচ্ছে।

তিনি বলেন, কৃষিকাজে নারীর স্বীকৃতি নেই। দৃশ্যমান ও অদৃশ্য বাউন্ডারি দিয়ে তাকে আটকিয়ে রাখা হচ্ছে। তাই নারীর মুক্তির জন্য এ সমাজ কাঠামো ভেঙে নতুন করে একে গড়তে হবে।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জুনায়েদ সাকী বলেন, “দুই লক্ষ মায়ের সম্ভ্রমহানির সংখ্যার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা হারিয়ে যাচ্ছে। এর বাইরে আমরা নারীকে স্বীকৃতি দেইনি।”

লড়াইয়ের মাধ্যমে নারীদের অধিকার আদায়ের তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, “নারী শ্রমিকের চলাফেরায় জন্য পরিবহন নেই, পাবলিক টয়লেট নেই। আসলে ভোটাধিকারসহ নারীর সব অধিকার আদায় হয়েছে লড়াইয়ের মাধ্যমে। লড়াই থামিয়ে দিলে নারী বঞ্চিত হবে।”

সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আহমেদ কামাল, বাংলাদেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রী সাইদা খানম, নারায়ণগঞ্জে হত্যার শিকার তানভীর মোহাম্মদ ত্বকীর মা রওনক রেহানা, রানা প্লাজায় আহত শ্রমিক মিলি খাতুন প্রমুখ।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই মুক্তিযোদ্ধা ও ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী সম্মেলনের মনোগ্রাম উন্মোচন করেন।

এর আগে বিকাল সাড়ে ৩টায় প্রথম সম্মেলন উপলক্ষে বিপ্লবী নারী সংহতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম থেকে বিএমএ মিলনায়তন পর্যন্ত শোভাযাত্রা করে।

২০০৫ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে নারীর মুক্তির লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল বিপ্লবী নারী সংহতি। দশম বর্ষপূর্তিতে সংগঠনটি দুর্নীতি, দুঃশাসন ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত নারী-পুরুষ সমতার ভিত্তিতে সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছে।