যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া জামায়াত নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন সোমবার আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে আসছে।
Published : 08 Mar 2015, 12:54 PM
ওই রিভিউ আবেদনের শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন শুনে রোববার চেম্বার বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বিষয়টি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে তোলার এই দিন ঠিক করে দেন।
আপিল বিভাগের সোমবারের কার্যতালিকা প্রকাশিত হওয়ার পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চেম্বার জজ আদেশ দিয়েছেন, আগামীকাল এটা তালিকাভুক্ত হবে। এরপর আপিল বিভাগ শুনানির তারিখ দিতে পারে।”
অবশ্য সোমবারই এ বিষয়ে শুনানি শুরু হবে বলে এর আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছিলেন তিনি।
এদিকে এ বিষয়ে শুনানির আগে চার সপ্তাহ সময় চেয়ে আবেদন করেছেন কামারুজ্জামানের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন।
আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় এই সম্পূরক আবেদন জমা দেওয়ার পর কামারুজ্জামানের অপর আইনজীবী শিশির মোহাম্মদ মনির বলেন, “এই মামলায় আমাদের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তিনি আদালতের কাছে চার সপ্তাহ সময় চেয়েছেন।”
প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চে এই রিভিউ শুনানি হবে। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুরে ১২০ জন পুরুষকে ধরে নিয়ে হত্যার দায়ে জামায়াতে ইসলামীর আজকের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ আপিল বিভাগের এই বেঞ্চই বহাল রাখে।
একাত্তরে ময়মনসিংহের আল বদর নেতা কামারুজ্জামান হলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি, যার সর্বোচ্চ সাজার রায় কার্যকরের আগে রিভিউয়ের পর্যায়ে এল।
২০১৩ সালের ৯ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। গতবছর ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগ ফাঁসির আদেশই বহাল রাখে।
ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর গত ১৯ ফেব্রুয়ারি তার মৃত্যু পরোয়ানায় সই করেন ট্রাইব্যুনাল-২ এর তিন বিচারক। এরপর মৃত্যু পরোয়ানা পাঠিয়ে দেওয়া হয় কারাগারে, কামারুজ্জামানকে তা পড়ে শোনানো হয়।
রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের দিন থেকে ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন করার সুযোগ থাকায় গত ৫ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় ৪৫ পৃষ্ঠার এই পুনর্বিবেচনার আবেদন জমা দেয় আসামিপক্ষ, যাতে ৪৪টি যুক্তি দেখিয়ে কামারুজ্জামানের খালাস চাওয়া হয়।
কামারুজ্জামানের অন্যতম আইনজীবী তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, আপিল বিভাগের রায়ে একজন বিচারক দণ্ডের বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। তার পয়েন্টগুলো ধরেই এই রিভিউ আবেদন করা হয়েছে।
ওই আবেদন জমা পড়ার পর কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানার কার্যকারিতা স্থগিত হয়ে গেছে বলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানিয়েছেন।
আসামিপক্ষ আবেদন করার পর এ বিষয়ে শুনানির তারিখ পেতে ওইদিনই চেম্বার আদালতে যান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। চেম্বার বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী এ বিষয়ে আদেশের জন্য রোববার দিন রাখেন।
এখন রিভিউ শুনানিতে কত সময় লাগতে পারে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা আদালতের বিষয়। আমি আশা করি, বেশি সময় লাগবে না। ... রিভিউ’র শুনানিতো একনাগাড়েই হওয়া উচিৎ।”
তিনি বলেন, এর আগে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রিভিউয়ের রায়ে বলে দেওয়া হয়েছে যে এটি ‘রিভিউ’, ‘আপিল’ নয়। এখানে বিস্তারিত শুনানির অবকাশ নেই। আদালতের যদি কোনো ভুল থাকে, ‘শুধু সেটাই দেখিয়ে দেওয়া’।
“প্রয়োজনবোধে আদালত সেটা সংশোধন করবে। এটা যত দ্রুত সম্ভব নিষ্পত্তি করতে হবে।... যে বেঞ্চ রায় দিয়েছিলেন, তারাই শুনানি করবেন।”
আরেক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, “আপিল বিভাগে মৃত্যুদণ্ড হওয়ার পর রিভিউয়ে তা কমেছে বলে বাংলাদেশে কোনো ঘটনা আমি দেখিনি। এ ব্যাপারে আগাম কোনো মন্তব্য করা ঠিক না। আদালত কি করবে, সেটা আদালতই জানে।”
তিনি জানান, রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারে। কামারুজ্জামান তেমন কোনো আবেদন করলে তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে।
“মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দিন ঠিক করার আগেই যদি তিনি তা করেন, সেক্ষেত্রে তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। ২৪ ঘণ্টা আগেও তিনি প্রাণভিক্ষা চাইলে তা পৌঁছানো হবে। রাষ্ট্রপতি যে সিদ্ধান্ত দেবেন তা কার্যকর হবে।”
মাহবুবে আলম বলেন, যুদ্ধাপরাধ মামলায় দণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে কারাবিধি প্রযোজ্য হবে না। কাদের মোল্লার রিভিউয়ের রায়েও এ কথাই বলা আছে।
যে অভিযোগে ফাঁসির রায়
জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে মোট সাতটি অভিযোগ ছিল। এর মধ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে ফাঁসির আদেশ দেয়। এর মধ্যে তৃতীয় অভিযোগে সোহাগপুর গণহত্যা ও ধর্ষণ এবং চতুর্থ অভিযোগে গোলাম মোস্তফা তালুকদারের হত্যার ঘটনা রয়েছে।
প্রথম অভিযোগে শেরপুরের নালিতাবাড়ির কালীনগরের বদিউজ্জামানকে হত্যা এবং সপ্তম অভিযোগে রোজার দিনে টেপা মিয়ার ছেলেসহ পাঁচজনকে হত্যার কথা রয়েছে। এ দুই অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে যাবজ্জীবন দেয়।
এছাড়া শেরপুর কলেজের তৎকালীন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ আব্দুল হান্নানকে নির্যাতনের ঘটনায় দ্বিতীয় অভিযোগে তার ১০ বছরের সাজা হয়।
পঞ্চম ও ষষ্ঠ অভিযোগ থেকে কামারুজ্জামানকে খালাস দেয় ট্রাইব্যুনাল।
আপিলের রায়ে প্রথম অভিযোগ থেকে কামারুজ্জামানকে খালাস দেয়া হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দ্বিতীয় ও সপ্তম অভিযোগে সাজা বহাল থাকে।
তৃতীয় অভিযোগে আসামির অপরাধের বিষয়ে চার বিচারপতি একমত হলেও মৃত্যুদণ্ডের রায় আসে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে।
বিচারপতি ওয়াহহাব মিয়া সোহাগপুর গণহত্যায় কামারুজ্জামানকে অভিযুক্ত করলেও এ অভিযোগে তিনি তাকে যাবজ্জীবন দণ্ডের পক্ষে মত দেন। সেই সঙ্গে ১, ২, ৪, ৭ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া দণ্ড থেকে কামারুজ্জামানকে খালাস দেওয়ার পক্ষে মত দেন তিনি।
আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি (বর্তমানে প্রধান বিচারপতি) এসকে সিনহা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী সর্বোচ্চ সাজার পক্ষে মত দিলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আসামির দণ্ড নির্ধারিত হয় মৃত্যুদণ্ড।
চতুর্থ অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করা হলেও মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়।
এর আগে আপিল বিভাগে আসা যুদ্ধাপরাধের প্রথম মামলায় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবনের সাজা বাড়িয়ে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। তার রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে গেলে দণ্ড কার্যকর করা হয় ১২ ডিসেম্বর।
আর আপিলে আসা দ্বিতীয় মামলায় জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির দণ্ড কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় সর্বোচ্চ আদালত, যার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি এখনো প্রকাশিত হয়নি।