বিভিন্ন সময় হামলা হলেও সেগুলোর বিচারে অগ্রগতি না আসাকে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের ওপর হামলার কারণ বলে দেখছেন ব্লগারদের কয়েকজন।
Published : 28 Feb 2015, 10:54 PM
বিচারহীনতার কারণে অভিজিৎ হত্যা: সিপিজে
অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ঢাবিতে ধর্মঘট আহ্বান
পুলিশ ব্যর্থ, নির্বিকার: অভিজিৎহত্যা নিয়ে ইমরান
ইন্টারনেটের কল্যাণে প্রায় এক দশক আগে পরিচিতি পাওয়া ‘ব্লগ সংস্কৃতি’ সময়ের সঙ্গে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বাংলাদেশে, যা বর্তমানে স্বাধীন মত প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম।
মুক্তমত প্রকাশ করতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের হামলার মুখে পড়েছেন অনেক ব্লগার, বিগত সময়ে নিহতও হয়েছেন।
গত ২০১৩ সালে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের যুদ্ধাপরাধ বিরোধী অবস্থান শুরুর কয়েকদিনের মধ্যে জঙ্গি হামলায় নিহত হন ওই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ব্লগার রাজীব হায়দার।
আর বৃহস্পতিবার একই কায়দায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় হত্যা করা হয় জনপ্রিয় ব্লগ মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়কে।
সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লেখালেখির কারণে দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হুমকি পেয়ে আসছিলেন এই লেখক।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ব্লগাররা বর্তমানে দেশের শক্তিশালী কণ্ঠস্বর হয়ে উঠছে। যেই কাজগুলো করা প্রয়োজন ছিল শিক্ষকদের, বুদ্ধিজীবীদের, সাংবাদিকদের, রাজনীতিবিদদের, তাদের সুবিধাবাদী চরিত্র, মেরুদণ্ডহীনতার দায় নিজেদের কাঁধে তুলে ব্লগাররা এখন সবার সামনে দাঁড়াচ্ছে। তাই ব্লগাররাই আগে আক্রান্ত হবে।”
“মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো জানে কারা সব চাইতে বিপদজনক, তাদের মতাদর্শের ক্ষতি কারা করতে পারে। তাদের মূলে কারা সজোরে আঘাত দিতে পারে। আগে যেই আক্রমণ ছিল আহমদ শরীফ, জাহানারা ইমাম, হুমায়ুন আজাদদের ওপর, সেই একই আক্রমণ এখন ব্লগারদের ওপর। প্রধানত মুক্তচিন্তার ব্লগারদের ওপর। ”
ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে ব্লগিং করতে গিয়ে ২০১৩ সালের ১৪ জানুয়ারি উগ্রবাদীদের হামলার মুখে পড়েন আসিফ। বর্তমানে জার্মানিতে রয়েছেন তিনি।
ব্লগারদের ওপর বারবার হামলার জন্য সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করেন তিনি।
বিভিন্ন সময় হামলা হলেও এক্ষেত্রে সরকার বরাবরই নীরব থেকেছে বলে মন্তব্য করেন আরেক ব্লগার বাকী বিল্লাহ।
তিনি বলেন, “সরকার টেলিফোন কথোপকথন ও ইন্টারেনেট ট্র্যাকিং করতে যন্ত্র কিনলেও গত কয়েক বছর ধরে যে ফেইসবুকে অব্যাহতভাবে অভিজিতকে মৃত্যুর হুমকি দেওয়া হচ্ছিলো সেটির বিষয়ে কোন সুরাহা করতে পারেনি।”
ব্লগার পারভেজ আলম বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর দলীয় ও গোষ্ঠী স্বার্থে মৌলবাদকে তোয়াজ করার কারণে এ ধরনের হামলা ঘটছে।
তিনি বলেন, “জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সরকারের নেই এটি বিশ্বাস করি না। দেশের কোন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে যদি কেউ প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাকে গ্রেপ্তার হতে আমরা দেখেছি। কিন্তু এক্ষেত্রে (ব্লগারদের ওপরে হামলা) আমরা কোন অগ্রগতি দেখিনি।”
“দেশে ফেইসবুক ব্যবহার করে, ওয়েবসাইট ব্যবহার করে জঙ্গিবাদীরা তাদের স্থান পোক্ত করছে। সরকারের এত শক্তিশালী নজরদারি করার যন্ত্র তারপরও কেন তারা ধরা পড়ছে না।”
তৃণমূলে জনসম্পৃক্ততা না থাকাকে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণ হিসেবে মনে করছেন ব্লগার আইরিন সুলতানা।
তিনি বলেন, “তৃণমূলের সাথে আমাদের যোগাযোগ খুবই অল্প। এ কারণে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা খুব সহজে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারছে। এর জন্য আমাদেরও (ব্লগার, লেখক, বুদ্ধিজীবী) দায় রয়েছে। কোন ঘটনা ঘটলে আমরা আইনকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাই।”
“উদাহরণ স্বরূপ কিছুদিন আগে রোদেলা প্রকাশনীর স্টল বইমেলায় বন্ধ করে দেওয়া হলো, আমরা কোন প্রতিবাদ করলাম না। প্রকাশনীটি কোন ব্যাখ্যা চাইলো না। এরকম ঘটনা বারবার ঘটছে।”
প্রতিবাদকে শুধু মাত্র ‘শাহবাগ মোড় বা পত্রিকার পাতায়’ বেধে না রাখার পরামর্শও দিয়েছেন এই ব্লগার।
ব্লগার রাসেল পারভেজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হতাহতের তালিকায় যাদের নাম আছে এবং যাদের বিরুদ্ধে খুনের হুমকি দেওয়া হচ্ছে এরা সবাই কোনো প্রথাগত ধর্মে বিশ্বাসী না। তাদের বিরুদ্ধে একমাত্র অভিযোগ তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে।”
হেফাজত ইসলাম নামের একটি সংগঠনের দাবির প্রেক্ষাপটে ২০১৩ সালে ১ এপ্রিল রাতে তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে গ্রেপ্তার হন ব্লগার রাসেল পারভেজ, সুব্রত শুভ সহ আরও দুই ব্লগার। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তারা ব্লগিংয়ের মাধ্যমে ধর্ম অবমানননা করেছেন।
নিরাপত্তাহীনতা বোধ করেন কিনা- জানতে চাইলে রাসেল বলেন, “নিরাপত্তা বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো- সরকার নিজ উদ্যোগে ধর্মবিদ্বেষী হিসেবে আমাকে প্লেটে সাজিয়ে উপস্থাপন করেছে। আমাকে মেষশাবক বানিয়ে হেফাজত সিংহের সামনে বরশি গেঁথে উপস্থাপন করার এই নির্মম সরকারি কৌতুকের খেসারত আমাকে এখনও দিতে হচ্ছে।”
“বাংলাদেশের কোন সরকার ধর্মীয় সহিঞ্চুতা ও রাষ্ট্রে ধর্মীয় পাণ্ডাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। বরং প্রতিনিয়ত মৌলবাদীদের তোষামোদ করে ভোট রাজনীতি করে যাচ্ছে।”
জনসম্মুখে অভিজিৎ রায়কে হত্যার পরও অপরাধীরা আইনের আওতায় না আসার জন্য সরকারও পুলিশের ব্যার্থতা দেখছেন এ ব্লগার।
লেখক ও ব্লগার অভিজিতের ওপরে হামলার ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও অপরাধীদের চিহ্ণিত না করার জন্য পুলিশ প্রশাসনের নির্বিকার ভূমিকাকে দায়ী করেন গণজাগরণমঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার।
বইমেলা চলার মধ্যে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা আসেন অভিজিৎ। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে নিয়ে বইমেলা থেকে ফেরার পথে টিএসসি এলাকায় মিলনচত্বরের উল্টোদিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন ফুটপাতে হামলার শিকার হন তিনি।
গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হলে কিছুক্ষণ পর চিকিৎসকরা অভিজিৎকে মৃত ঘোষণা করেন। হামলায় তার স্ত্রী বন্যাও আহত হন। চাপাতির আঘাতে তার হাতের একটি আঙুল পড়ে গেছে, মাথায়ও জখম হয়েছেন তিনি।
এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন অভিজিতের বাবা অজয় রায়। মামলায় কারো নাম উল্লেখ করা না হলেও ধর্মীয় উগ্রবাদীরাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে মনে করছেন তিনি।