তিস্তা চুক্তির জট অচিরেই খোলার আশা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যার কারণে চার বছর আগে এই চুক্তি হতে গিয়েও হয়নি।
Published : 21 Feb 2015, 01:03 PM
পানি এলে ইলিশও যাবে: মমতাকে হাসিনা
শহীদ মিনারে হাসিনা-মমতার কুশল বিনিময়
শনিবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে স্থল সীমান্ত চুক্তি কার্যকরে সংবিধান সংশোধনের বিল ভারতের পার্লামেন্টের আগামী অধিবেশনেই পাস হওয়ার সম্ভাবনার কথাও বলেছেন মমতা।
২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে তিস্তা চুক্তি সইয়ের কথা থাকলেও মমতার আপত্তিতে তা আটকে যায়। স্থল সীমান্ত চুক্তি কার্যকরেও বিরোধিতা ছিল তার।
তবে চার বছর পর ভারতের রাজনীতির পালাবদলে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রীর সুর এখন এই দুই বিষয়ে অনেকটাই নরম। এর মধ্যেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ১৭ বছর পর ঢাকায় এলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।
দুপুর সাড়ে ১২টায় গণভবনে পৌঁছালে সেখানে তাকে স্বাগত জানান শেখ হাসিনা। সবার উপস্থিতিতে শেখ হাসিনা ও মমতার মধ্যে ১৫ মিনিট বৈঠকের পর আধ ঘণ্টার বেশি সময় তারা একান্তে কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান সোবহান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর এই সফরের মধ্য দিয়ে ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের ভিত্তি তৈরি হল।
বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই তিস্তা চুক্তির প্রসঙ্গ তোলেন বলে ইকবাল সোবহান জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকায় আসার পর শুক্রবার এক অনুষ্ঠানেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, তিস্তা চুক্তির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করবেন তিনি।
শুক্রবারের ওই অনুষ্ঠানে মমতা তার প্রতি আস্থা রাখতে বাংলাদেশিদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, “আমার দিক থেকে এলবিএ’র (স্থল সীমান্ত চুক্তি) প্রবলেম সলভ করে দিয়েছি।.. তিস্তায়ও আস্থা রাখুন।”
“আমাদের প্রবলেম আছে, আপনাদেরও প্রবলেম আছে। আমি হাসিনাদির সাথে আলোচনা করব। আমাদের ওপর ছেড়ে দিন। এটা (তিস্তা চুক্তি) নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না।”
ইকবাল সোবহান বলেন, “পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ সংরক্ষণ করে একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখার আশ্বাস দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেছেন, তিনি বাংলাদেশকে ভালোবাসেন এবং বাংলাদেশের স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করেন।”
মমতা বলেছেন, “আমি সকল বাধা পেরিয়ে আপনাদের আমন্ত্রণে এসেছি। দুই দেশের মধ্যে বয়ে যাওয়া গঙ্গা ও যমুনা নদীর যেমন বিস্তৃতি, দুই বাংলার মধ্যে সম্পর্কও তেমন সুগভীর ও নিবিড়।”
বাংলাদেশের প্রতি ভালবাসা তুলে ধরে ভারতের বাংলাভাষী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমরা বাংলাদেশকে ভালোবাসি। বাংলাদেশ আমারও দেশ। আমরা বাংলাদেশের স্বার্থকে গুরুত্বের সাথে দেখে থাকি’।”
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাড়িতে মধ্যাহ্ন ভোজে অংশ নেন মমতা, যেখানে ইলিশও পরিবেশন করা হয় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে।
তার আগে বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের প্রিয় ইলিশ না পাওয়ার বিষয়টি শেখ হাসিনার কাছে তোলেন মমতা। তাকে ঊষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো শেখ হাসিনা তখন বলেন, “পানি এলে ইলিশও যাবে।”
ইকবাল সোবহান বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীকে বড় বোনের মতো দেখেন। প্রধানমন্ত্রীও তাকে ছোট বোনের মতো দেখেন।
এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, “তিনি (মমতা) পজিটিভ ইন্ডিকেশন দিয়েছেন, কোনও টাইমফ্রেম দেননি।
তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, ‘আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন’। তিনি এবং তার দলের পক্ষ থেকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেন।
“পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, ‘আপনি চিন্তা করবেন না। কোনো টেনশন রাখবেন না’।”
স্থল সীমান্ত চুক্তির বিষয়ে মমতা বলেন, “৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা স্থল সীমান্ত চুক্তি নিয়ে সৃষ্ট সব সমস্যার সমাধান করে দিয়েছি। লোকসভায় তা জমা দেওয়া আছে। চলতি মাসের ২৩ তারিখ থেকে শুরু হওয়া লোকসভার অধিবেশনে তা পাস হবে বলে আশা করি।”
এসব বিষয় দুই দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয় হলেও এক্ষেত্রে বাংলাদেশ লাগোয়া রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা রয়েছে।আর এক্ষেত্রে মমতার সম্মতিকে প্রধানমন্ত্রী স্বাগত জানিয়েছেন বলে ইকবাল সোবহান জানান।
উপদেষ্টা বলেন, প্রধানমন্ত্রী মমতাকে ছিটমহলের মানুষের দুর্ভোগের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
“পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, তিনি ছিটমহলে গেছেন এবং তাদের দুর্ভোগ নিজ চোখে দেখেছেন।”
বৈঠকে জঙ্গিবাদের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছি কি না- জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, “জঙ্গি তৎপরতা কোনো দেশের জন্য মঙ্গলের না- এ বিষয়ে দুজনেই একমত প্রকাশ করেছেন।”
বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা চালানোর ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ থেকে মদদ পাওয়ার বিষয়টি সম্প্রতি প্রকাশ্যে আসে। এনিয়ে মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেসের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে।
বাংলাদেশ ও পশ্চিমঙ্গের মধ্যে সম্পর্ক আরও হৃদ্যতাপূর্ণ করার ওপর জোর দিয়ে মমতা বলেন, এই সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে যে ভূমিকা রাখার দরকার তিনি তা করবেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্মরণ করে এক সময়ের এই কংগ্রেস নেত্রী বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি অনেক ছোট ছিলেন। কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানগুলো নিয়মিত শুনতেন তিনি।
বাংলাদেশ অমর একুশের অনুষ্ঠানে অতিথি করায় নিজেকে ধন্য মনে করছেন বলে মমতা উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয়গুলোও বৈঠকে আলোচিত হয়।
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যোগাযোগ বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন মমতা। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সাংস্কৃতিক উৎসবের জন্য একটি কমিটি করে দেওয়ার কথাও বলেন তিনি।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সংস্কৃতি বিষয়কমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরকে এজন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানান ইকবাল সোবহান।
পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল প্রচার এবং চলচ্চিত্র প্রচারে উদ্যোগ নেবেন বলেও আশ্বাস জানান মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ঢাকায় প্রথম সফরে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদেরও নিয়ে এসেছেন মমতা, যার মধ্যে রয়েছেন মুনমুন সেন, গৌতম ঘোষ, প্রসেনজিৎ, দেব, নচিকেতা, ইন্দ্রনীল।
রাজ্যের মন্ত্রিসভার আগামী বৈঠকেই অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতায় ‘বঙ্গভবন’ তৈরিতে বাংলাদেশ সরকারকে জমি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে বলে বৈঠকে উপস্থিত তার কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেন মমতা।
মমতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার এবং বঙ্গভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বলেও জানান ইকবাল সোবহান।
কলকাতা থেকে আগরতলা সরাসরি বাস চলাচলের বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর সোনারগাঁও হোটেলে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যান মমতা। রাতেই তিনি ঢাকা ছাড়েন।
গণভবনে বৈঠকের আগে একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে শেখ হাসিনার সঙ্গে তার কুশল বিনিময় হয়।
শুক্রবার রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে মমতা দেখা করেন। ওই দিন বঙ্গবন্ধু জাদুঘরও পরিদর্শন করেন তিনি।